বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৭৯):  শিক্ষার শিখা জ্বলে উঠুক

-বিজন সাহা

ফিরে আসা যাক বোলন সিস্টেমে। রাশিয়া ২০০৩ সালে বোলন সিস্টেমে যোগদান করে আর ২০১১ সালে পুরোপুরি এর সাথে সম্পৃক্ত হয়। প্রথম থেকেই শিক্ষক সমাজের একটা বিরাট অংশ এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। কারণ এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র বেশি করে দেখা দেয়। সেই সময় রাশিয়ার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ভ্লাদিমির ফিলিপভ। উনি আমাদের ক্যালকুলাস পড়াতেন সেই ১৯৮৫ সালে। সবে মাত্র ডেনমার্ক থেকে ফিরেছেন পোস্ট ডক করে। ছিলেন আমাদের ফ্যাকাল্টির পার্টি সেক্রেটারি, পরে ডীন। সেই সময় পেরেস্ত্রোইকার ঝড় বইছিল সারা সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে। সব জায়গায় গণতন্ত্র। ঠিক হল আমাদের রেক্টর বা চ্যান্সেলর ভোটে নির্বাচিত হবেন। ফ্যাকাল্টির ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আমারও ভোটাধিকার ছিল। তাঁকেই ভোট দিয়েছিলাম স্তানিসের বিপক্ষে। তখন তাঁর বয়স কত হবে? চল্লিশ? সব মিলিয়ে অনেক আশা ছিল। এটা ঠিক সেবার তিনি হেরে যান, তবে ১৯৯২ সালে রেক্টর নির্বাচিত হন। পরে রাশিয়ার শিক্ষামন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৯০ এর দশকে যখন চারিদিকে সমস্যা, তিনি গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। মনে রাখতে হবে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে, তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের সুফল ছড়িয়ে দিতে। সমাজতন্ত্রের আলো বয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরা আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজকর্ম করছে আর সেটা করছে সুনামের সাথেই। পৃথিবীতে এটাই এক মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ১৪০ দেশের ২৯ হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করছে। ৭৭ হাজারের অধিক বিশেষজ্ঞ যার মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার পিএইচডি হোল্ডার আজ ১৭০ দেশে কর্মরত আছে। এদের অনেকেই সোভিয়েত চিন্তা ভাবনা সাথে নিয়ে গেছে। সমাজতন্ত্র তার আগের আবেদন হারালেও ঐ সিস্টেমে যে মানবতাবাদী দিকটা ছিল, মানুষের বিশেষ করে শ্রমিক, কৃষক, খেঁটে খাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর যে শিক্ষা আমরা পেয়েছিলাম, অনেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সেই দায়িত্ব পালন করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তনীরা আজ শুধু নিজ নিজ ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব রাখছে। এরা অন্যান্য সোভিয়েত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত লাখ লাখ বিশেষজ্ঞের সাথে এখনও হারিয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কঠিন সময়ে টিকিয়ে রাখা ও বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসা, সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। তবে অনেকের মতই বোলন সিস্টেমে চলে যাওয়া আমিও সমর্থন করতে পারিনি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমার কোন দ্বিধা ছিল না। হতে পারে বাংলাদেশের বাইরে আমি আর কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত নই। যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেটিংএর দিকে তাকাই আমেরিকা, ইউরোপের শিক্ষা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অনেক ভাল। কিন্তু? আমার মনে পড়ে করোনার কথা। আমেরিকা তার সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া? এখানেও মৃত্যুর পরিমাণ অনেক। তবে সেটা যতটা না বিনা চিকিৎসায় তার চেয়ে বেশি নাগরিকদের অবহেলার কারণে। দীর্ঘদিন সোভিয়েত শাসনের লৌহ বেষ্টনীতে থাকার পর এরা যা কিছু সরকারি তাই এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। ফলে ভ্যাক্সিন থাকা সত্ত্বেও মানুষ ঠিক মত সেটা গ্রহণ করেনি। এর উপর ছিল বাইরের প্রোপ্যাগান্ডা। কিন্তু সেই সোভিয়েত ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আবার তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। করোনার প্রথম ভ্যাক্সিন কিন্তু এদেশেই আবিষ্কৃত হয়েছে যদিও রাজনৈতিক কারণে সেটা পশ্চিমা বিশ্বে মুক্তি পায়নি। একই ভাবে হয়তো আমেরিকা বা ইউরোপের এলিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদের তুলনায় অনেক ভাল, তবে সব দেখে মনে হয় সাধারণের জন্য সোভিয়েত সিস্টেম ছিল অনেক বেশি কার্যকরী। এমনকি পরবর্তীতে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাই কেন এ দেশ তার শিক্ষানীতি পরিবর্তন করে বোলন সিস্টেম গ্রহণ করবে এ নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ছিল। মনে রাখতে হবে ১৯৯১ সালে না বাইরের শক্তির সাথে যুদ্ধে হেরে, না গণবিক্ষোভের কারণে সোভিয়েত দেশ ভেঙেছিল। সেটা হয়েছিল পার্টির দ্বিতীয় সারির নেতাদের ক্ষমতার লোভ আর পার্টির সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করতে না পারার কারণে। এমনকি ১৯৯১ সালে মিখাইল গরবাচেভ যে গণভোটের আয়োজন করেন সেখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইউনিয়নের পক্ষেই রায় দেয়। কিন্তু ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন তারা বিশেষ করে রাশিয়া কমিউনিস্ট রেভেঞ্জের ভয়ে ভীত ছিল। আর এ কারণেই যত দ্রুত সম্ভব দেশের শিল্প বিজাতীয়করন করা হয়, উদ্দেশ্য যেন কোন অবস্থাতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ফিরে না আসে। আর এ জন্যে দরকার ছিল নতুন শিক্ষায় মানুষকে শিক্ষিত করা, ধীরে ধীরে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া। মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ নয়, বরং নব্য পুঁজিবাদের দাস বানানো। আগে যেখানে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন এসবের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হত, নতুন ব্যবস্থায় তত্ত্বের চেয়ে ব্যবহারিক দিকের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু সমাজ ও দেশের মূল চালিকা শক্তি অর্থনীতি তাই শিক্ষা ক্ষেত্রেও এদিকটাই প্রাধান্য পেতে শুরু করে। তাছাড়া দীর্ঘ দিন পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কার্যত আইসোলেট থাকার ফলে বাইরের সব কিছুকে ভালমন্দ বিচার না করেই দু হাতে বুকে টেনে নেওয়ার প্রবনতা দেখা দেয় নতুন শাসক শ্রেণির মধ্যে। বোলন সিস্টেম গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণের একটা ছিল যাতে এদেশের ছেলেমেয়েরা সহজেই ইউরোপ আমেরিকার ব্যবস্থায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আর এখানেই অনেকের মত আমারও কিছু রিজার্ভেশন ছিল। কেন?

আগেই বলেছি সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষা ছিল সার্বজনীন ও বিনামূল্যে। এমনকি আমরা যেসব বিদেশিরা এখানে পড়াশুনা করতাম, তারাও পড়তাম বিনামূল্যে, পেতাম স্টাইপেন্ড যার পরিমাণ খারাপ ছিল না। উল্লেখ্য তখন সাধারণ মানুষদের গড় বেতন ছিল ১২০ রুবল আর আমাদের স্টাইপেন্ড ছিল ৯০ থেকে ১১০ রুবল। শুধু গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদেশী ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষা লাভ করত। সোভিয়েত সরকারের উদ্দেশ্য ছিল (অন্তত সেটাই বলা হত) যে এসব ছেলেমেয়েরা দেশে গিয়ে নিজ নিজ দেশের জনগণের সেবায় নিজেদের নিয়োগ করবে। যদি ইউরোপ আমেরিকায় পড়তে যাওয়া বিদেশী ছেলেমেয়েরা মূলত নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে সেসব দেশে যেত আর তাদের এক বিরাট অংশই সেসব দেশে থেকে যেত, সোভিয়েত ইউনিয়নে যারা আসত তাদের অধিকাংশই আসত আদর্শগত কারণ থেকে। যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নে থেকে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব তাই তারা দেশে ফিরে যাবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ কারও মনে তখন ছিল না। আর এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তখন ছিল জনসেবা মূলক। যেহেতু প্রাইভেট সেক্টর বলতে কিছু ছিল না বললেই চলে তাই সবাই পাশ করে সরকারি চাকরি করত। আর সরকারি চাকরি মানেই তুলনামূলক কম বেতন ও সেবা দেওয়া। যেহেতু আমরা এ পরিবেশেই গড়ে উঠছি তাই এমনকি পুঁজিবাদী দেশ থেকে এলেও সমাজসেবা মূলক এক ধরণের মনোভাব এমনিতেই গড়ে উঠেছে। আজও আমাদের দেশে বিশেষ করে সোভিয়েত ফেরত ডাক্তারদের দেখে মনে হয় আমি খুব একটা কিছু ভুল বলছি না। অর্থাৎ সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাই ছিল নিজ নিজ দেশের জনগণের উন্নয়নের সাথে জড়িত। কিন্তু যখন বলা হল শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হবে যাতে এখান থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা অনায়াসে ইউরোপ আমেরিকায় খাপ খাইয়ে নিতে পারে এর অর্থ দাঁড়ায় এই দেশ এখন নিজেদের নয়, ইউরোপ আমেরিকার জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরি করছে, তৈরি করছে নিজের পয়সায়।

আমাদের ছাত্র জীবনে শুধু ইউরোপ আমেরিকাতেই নয় সোভিয়েত ডিগ্রি নিয়ে নিজ নিজ দেশে চাকরি পাওয়াও বেশ কষ্টকর ছিল। এর একটা প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ছিল কোন না কোন ইউরোপিয়ান দেশের উপনিবেশ। ফলে সেসব দেশে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ এসব সিস্টেম চালু ছিল। তাই হুট করে সোভিয়েত সিস্টেমের বিশেষজ্ঞরা সেখানে ঢুকে পড়ুক সেটা ঐ সব দেশের আকাডেমিশিয়ানরাও চাইতেন না। ছিল মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং লবি। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পাশ করা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ফিজিক্স, ম্যাথেম্যাটিক্স, কেমিস্ট্রি ইত্যাদি ন্যাচারাল সাইন্স বাদে অন্য যেকোনো বিষয়ে, বিশেষ করে টেকনিক্যাল বিষয়ে চাকরি পেতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হত। শুধুমাত্র এদেশের বিজ্ঞানের কদর ছিল সব জায়গাতেই আর ইউরোপ আমেরিকা এদের দু’ হাতে লুফে নিত। আমাদের অনেক বন্ধু যারা পরবর্তীতে ইউরোপ বা আমেরিকায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন তাদের বিভিন্ন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আর যেহেতু প্রায় সবাই সেসব পরীক্ষায় পাশ করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন সেটা থেকেও বলতে পারি যে সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল।

এটা তো নতুন কথা নয় যে দেশের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করে তার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। বিপ্লব পরবর্তী খুবই অল্প সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু নিরক্ষরতাই দূর করেনি, হাজার হাজার বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞ জন্ম দিয়েছে যেমন নিজ দেশের জন্য তেমনি তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য। আর সেটার পেছনে মূল কারণ ছিল শিক্ষানীতি। সেজন্যে দেশে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতেই হবে এমন কথা নেই। ফিনল্যান্ড সেটা না করেই নিজ দেশে সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থার কপি নয়, নিজ দেশের উপযোগী করে সেই শিক্ষা ব্যবস্থার স্থানীয় ব্যবহার। আমরা নিজেরাও চাইলে সেটা মাথায় রাখতে পারি। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থাও আকাশ থেকে পড়েনি। তারা নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল জার্মানির দিকে খেয়াল করে। অন্যের ভাল অভিজ্ঞতা নিজের কাজে লাগানোর মধ্যে লজ্জা তো নেইই বরং নতুন পরিবেশে, নতুন বাস্তবতায় সেটার সঠিক প্রয়োগ কৃতিত্বের দাবিদার।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো