মতামত

মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

– ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু

চট্টগ্রাম শহরের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্র উপকুলে উত্তর কাট্টলিতে জননেতা মরহুম আহমদ চৌধুরীর জন্ম। ছায়াঢাকা সুনিবির গ্রাম এবং সমুদ্র উপকুল এ এলাকায় বৃটিশবিরোধি বিপ্লবীদের যাতায়াত ছিল। সমুদ্র উপকুলবর্তী অঞ্চল হওয়ায় অস্ত্র পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের জন্য ছিল উত্তর কাট্টলি একটি আদর্শ স্থান। স্বয়ং মাস্টারদা সূর্যসেন উত্তর কাট্টলিতে পদধূলি দিয়েছেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাবে  আক্রমনের পূর্বে কাট্টলির সাগর তীরে প্রীতিলতা ও তার সাথিদের অস্ত্র শিক্ষা চলে। এভাবে কাট্টলি হয়ে ওঠে বৃটিশবিরোধী বিপ্লবীদের অন্যতম চারণভূমি। এমন এক বিপ্লবী পরিবেশে শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করা জহুর আহমদ চৌধুরীর রক্তে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। জহুর আহমদ চৌধুরী অন্য দশজন মানুষের মতো নিজেকে নিয়ে আত্মমগ্ন ছিলেন না। একদিকে বিপ্লবীদের প্রভাব অন্যদিকে জন্মের পর থেকেই তিনি প্রত্যক্ষ করলেন বৃটিশদের অমানবিক শোষণ নির্যাতন।

তাই দেশের মানুষকে শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি ১৯৩৮ সালে রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তিনি অনুধাবন করলেন মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে হলে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা গরিব মেহনতি ও শ্রমিকশ্রেনিকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি রাজনীতি ক্ষেত্র হিসেবে শ্রমিকশ্রেনিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতার খিদিরপুরে শ্রমিক রাজনীতি শুরু করেন। খিদিরপুরে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ছিলেন ভিভি গিরি। তিনি পরবর্তীতে ভারতের রষ্ট্রপতি হন। ভিভি গিরিকে জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক রাজনীতির গুরু বলা যায়। ১৯৪৬ সালে জননেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী জ্যোতি বসুর সাথে ডক ইয়ার্ডে কার্সি ইউনিয়ন করতেন। সমস্ত ভারতবর্ষে ১ কোটির মতো শ্রমিক হলেও পূর্ব বঙ্গে শ্রমিক ছিল মাত্র ২৫ হাজার। পূর্ববঙ্গে ২৫ হাজার শ্রমিককে পুঁজি করে শ্রমিক রাজনীতি বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী অন্যতম ছিলেন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সংগঠিত বন্দর শ্রমিকদের আন্দোলনে জহুর আহমদ চৌধুরী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তিনি চট্টগ্রাম মেরিনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। বেঙ্গল মেরিনার্স ইউনিয়নের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, মাহবুবুল হক, আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করার প্রমাণ পাওয়া যায়। উনাদের সাথে ১৯৫০ সালে এক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনে কাজ করেন। জহুর আহমদ চৌধুরী এই সংগঠনের সহ-সম্পাদক ছিলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জহুর আহমেদ চৌধুরী ছিলেন স্বশিক্ষিত এবং পণ্ডিত ব্যক্তি। সময় সুযোগ পেলেই তিনি বই পড়তেন। প্রচুর দেশি-বিদেশি বই পড়ার কারনেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও দক্ষতায় এক উচ্চ আসনে তিনি নিজেকে আসীন করেছিলেন। তার পড়াশোনার পরিধি এত বিস্তৃত ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীরাও তার কাছে হার মানত। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন।
জেমস ফিনলে, বার্মা অয়েল কোম্পানি, রবিন সন্স ইত্যাদি যে সব বিদেশি প্রতিষ্ঠানে তাঁহার ট্রেড ইউনিয়ন বা সিবিএ ছিল-সেখানে সাদা চামড়ার সাহেবদের সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে ইংরেজিতে দর কষাকষি করতেন। বার্মা অয়েল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার উইলিয়াম বেল, জেমস ফিনলে, ম্যাক ডোনাল্ড, রবিন সন্স গ্রুপের পিটারসন ও শেল অয়েলের রিচার্জসনের জবানিতে জহুর আহমদ চৌধুরীর ইংরেজি জ্ঞানের প্রশংসার উল্লেখ পাওয়া যায়।
জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন অপোষহীন একজন সংগ্রামি নেতা। তিনি অদম্য সাহসী আর অপরিসীম মনোবলের অধিকারী ছিলেন। রাষ্ট্রে ও সমাজে যেখানেই অন্যায় অবিচার দেখেছেন সেখানেই তিনি ইস্পাতের দৃঢ়তা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর এই দৃঢ়চেতা ও সাহসী মনোভাব তৎকালীন পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর পছন্দ হতো না। পাকিস্তান আমলে ২৪ বছর মেয়াদে তিনি আট বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। তিনি একসাথে ৪টি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন। মন্ত্রী হিসাবে জহুর আহমদ চৌধুরীর বড় অবদান হলো তৎকালীন শাহবাগ হোটেলকে পিজি হাসপাতালে রূপান্তর করা। যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত লাভ করেছে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রমনীতি প্রণয়ন করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর মতো সাহসী ও অপোষহীন নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুণে বৃটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকশ্রেনি অধিকার আদায় করার সম্ভব হলেও স্বাধীন বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বর্তমানে বিরাট শূন্যতা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি শ্রমিক। যাদের প্রায় ৮৫% অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। শ্রম আইনে তাদের অধিকারের ব্যাপারে তেমন কিছুই ঊল্লেখ নেই। আবার বাকি ১৫% প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরাও শ্রম আইনে বর্ণিত সুযোগ সুবিধা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমান করোনা মহামারির সময় যদি জহুর আহমদ চৌধুরী মতো একজন যোগ্য শ্রমিকনেতা থাকত তাহলে শ্রমিকেরা যথাযথ দিক নির্দেশনা পেত এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তলতে সক্ষম হতো। তাই আজ শ্রমিক তথা গরিব মেহনতি মানুষের দুর্দিনে জহুর আহমদ চৌধুরীর শূন্যতা বড় বেশি অনুভব করছি।

মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আজ তাঁর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)