মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (২য় পর্ব)

-অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

।।দ্বিতীয় পর্ব।।

অধ্যাপক সুস্নাত দাশ (ফাইল ছবি)

লেনিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক রচনাটির নাম অবশ্য ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ (State and Revolution)। ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে লিখিত এই রচনাটি প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে। ওই সময় রাশিয়ার কেরেনস্কি সরকার (জারের পতনের পর যে সরকার ক্ষমতায় এসেছিল একটি উদার বুর্জোয়া সরকার হিসাবে; কেরেনস্কি নিজে অবশ্য সমাজতন্ত্রী ছিলেন।)  লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় তিনি ফিনল্যান্ড সীমান্তে আত্মগোপন করেছিলেন। এই আত্মগোপন পর্বে তিনি State and Revolution লেখেন। এই গ্রন্থটি ছয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। লেনিন নিজেই পরে জানিয়েছেন যে ১৯০৫ এবং ১৯১৭ সালে সালে রুশ বিপ্লবগুলির উপর আরও একটি অধ্যায় লেখার পরিকল্পনাও তাঁর ছিল। কিন্তু ১৯১৭-র নভেম্বর বিপ্লবের কারণে তাঁর আর লেখা হয়নি। তাঁর নিজের কথায়, বিপ্লব সম্পর্কে লেখার চেয়ে বিপ্লবের অভিজ্ঞতার শরিক হওয়া বেশি আনন্দদায়ক এবং প্রয়োজনীয়।
উইলিয়াম ইবেনস্টাইন লিখেছেন, মার্কসবাদ এবং সাম্যবাদের ইতিহাসে লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব-এর গুরুত্ব অপরিসীম। মার্কস এবং এঙ্গেলস যেখানে উনিশ শতকীয় স্বভাবসুলভ উদারবাদী রীতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা নামক ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করেছিলেন, লেনিন সেখানে রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি মার্কসের এই তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে পুঁজিবাদ এবং সাম্যবাদের মধ্যবর্তী উত্তরণকালটিতে একমাত্র সর্বহারার একনায়কতন্ত্রই থাকতে পারে। পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্র পরস্পর সহাবস্থানযোগ্য, এই মত লেনিন মানতেন না। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গণতন্ত্র সবসময়ই একটি সংখ্যালঘু শ্রেণির জন্য গণতন্ত্র; তা কেবলমাত্র সম্পন্ন শ্রেণিগুলির জন্য, ধনীদের জন্য কাজ করে। লেনিন বর্ণনা করেছেন কিভাবে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। কমিউনিস্ট ইস্তাহারের ভাষায়, আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনবিভাগ আসলে বুর্জোয়ার বিষয়কর্ম দেখাশোনা করার একটি সংস্থা ছাড়া আর কিছু নয়।

পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিকতার পিছনে বাস্তবে লেনিন দেখেছেন বুর্জোয়ার একনায়কত্ব। তিনি এটাও মানেন নি যে ধনতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ নেহাতই সহজভাবে, সরাসরি ও মসৃণতার সঙ্গে ঘটে। যদিও লিবেরার পণ্ডিতবর্গ এবং পাতি-বুর্জোয়া সুযোগ সন্ধানীরা আমাদের এমনটাই বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন। লেনিন লিখেছেন, সাম্যবাদের পথে উত্তরণ অবশ্যই ঘটে সর্বহারার একনায়কত্বের মধ্য দিয়ে। এর আর অন্যথা হতে পারে না, কেননা ধনতন্ত্রী প্রতিরোধ কারোর দ্বারা বা অন্য কোনও ভাবে ভাঙ্গা সম্ভব নয়। ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডস এর মত রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলিতে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে শান্তিপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা মার্কস উন্মুক্ত রেখেছিলেন। অন্যদিকে লেনিন দাবি করেছিলেন ১৯১৭ নাগাদ মার্কসের এই ব্যতিক্রমী ভাবনা আর কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। কারণ ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা যে সব আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল তারা সবকিছুকেই পদানত করেছিল। মার্কসের কাল থেকে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা সামাজিক সংস্কারের পথে ধারাবাহিকভাবে অগ্রসর হয়েছে- একথা লেনিন আদৌ স্বীকার করেননি। বরং তিনি মনে করতেন, ইতিমধ্যে উভয় দেশই আরও বেশি উৎপীড়ক, কর্তৃত্ববাদী এবং বড়লোকপন্থী হয়ে উঠেছিল। ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন লিবারেল নেতা স্যার উইলিয়াম হারকোর্ত (Harcourt) বলেছিলেন, আমরা সবাই এখন সমাজবাদী। তিনি এর দ্বারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ঐ দেশের সমস্ত দলই সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি সাধারণভাবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু লেনিন-এর মতে, স্যার উইলিয়ামের বলা উচিৎ ছিল, আমরা সবাই এখন রুক্তপিপাসু সামরিক চরিত্রের পুঁজিবাদী।

যাই হোক বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় এর ফল হলো, কারখানার মালিকেরা অবাধ্য শ্রমিকদের শায়েস্তা করার জন্য কারখানা বন্ধ বা লক-আউট ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিল। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেল, শ্রমিকদের নামে ‘কারখানা কমিটি’ কারখানাগুলি নিছক অধিগ্রহণ করতেই ব্যস্ত; কিন্তু একটা কারখানা পরিচালনা করার জন্য যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, শৃংখলা কিংবা হিসাবনিকাশ রাখার জন্য যে বিদ্যার প্রয়োজন সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি দেওয়া হলো না। সুতরাং, বহু ক্ষেত্রে দেখা গেলো যে, অধিকৃত কারখানাগুলির জমা টাকা ভেঙ্গে খরচ করা হলো এবং মজুত মাল আর কারখানার যন্ত্রপাতি তাদের নিজেদের স্বার্থসাধনের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হলো। কর্তৃপক্ষকে অস্বীকার করে রেলওয়ে শ্রমিক এবং কারিগরী বিভাগের কর্মচারীরা যৌথভাবে দীর্ঘকাল ধরে রেলওয়ের কাজকর্ম পরিচালনা করতেও দ্বিধা করল না। কারখানায় এই যে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া শুরু হল তার জন্য শ্রমিকনিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাকেই শুধুমাত্র দায়ী করা চলে না। বিপ্লবের অনেক আগেই এই ভাঙ্গনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কাঁচামালের অভাব, যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে অবহেলা এবং যুদ্ধের ফলে উদ্ভুত ক্লান্তিকর পরিবেশ ও হতাশার মধ্যে নিহিত ছিল এই ভাঙ্গনের বীজ। বিপ্লব এইসব অশুভ ঘটনাবলীকে আরও উসকে দিয়ে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে মাত্র।
E.  H.  Carr- এর মতে, ভাঙ্গনের এই প্রক্রিয়ার জন্য বলশেভিকদের কার্যকলাপ আংশিকভাবে দায়ী।
অর্থনৈতিক অচল অবস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা পর্যায় পর্যন্ত বলশেভিকদের কর্মকাণ্ডের এক অপরিহার্য ভূমিকা ছিল কারণ বিজয়ী বিপ্লবের পক্ষে বুর্জোয়া শাসনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল বলশেভিকদের কাছে প্রধান শর্ত। এ সম্পর্কে Maurice Dobb মন্তব্য করেছেন, শ্রমিক কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বৈপ্লবিক উদ্দেশ্য সাধনে তর্কাতীতভাবে কর্তব্যকর্ম পালন করেছিল। কারণ নতুন কিছু গড়ার  প্রারম্ভে পুরানো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার প্রয়োজন ছিল।কিন্তু একটা পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর ধংসের কাজ চালিয়ে গেলে তা নতুন শাসন ব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে পড়ে।

বিল্পবের সলতে পাকানো

লেনিন যেহেতু অনুভব করেছিলেন যে খোলামেলা আলাপ আলোচনা ও প্রচারের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টদের পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নাও হতে পারে, তাই কমিনিস্টদের প্রতি তার উপদেশ ছিল যে, যাবতীয় রাজনৈতিক সামরিক সমবায়গত, শিক্ষাগত, শিল্প সংক্রান্ত এবং খেলাধূলার সংগঠনগুলিতে তাদের নিজেদের সমিতি বা গোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে। এই ধরনের কমিউনিস্ট সমিতি বা কমিটি হবে হয় খোলামেলা নয়তো গোপনীয়। এই ব্যাপারটি নির্ভর করত বিশেষ বিশেষ সমিতির পরিস্থিতি বা অবস্থার উপর। কমিউনিস্ট দলগুলির কেন্দ্রীয় কমিটি এই জাতীয় সমিতিগুলির কাজকর্ম অত্যন্ত কঠোরভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবে। প্রতিটি গোষ্ঠী, অংশ বা পেশার- যাদের মধ্যে কমিউনিস্টরা অনুপ্রবেশ করেছেন – মনস্তত্ব তাঁদের ভালভাবে বুঝতে হবে। লেনিন আরও বলেছিলেন যে এমনকী যেখানে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি মুক্ত প্রকৃতির, সেখানেও কমিউনিস্টদের উচিৎ আইনি কাজের সঙ্গে বে-আইনি কাজ এবং আইনি সংগঠনের সঙ্গে বেআইনি সংগঠনকে সঙ্গে মেলানো। কারণ, বুর্জোয়া সরকারগুলি সবসময়ই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে হিংসা প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত হয় এবং কমিউনিস্টদের অধিকারের প্রশ্নে গণতান্ত্রিক সংবিধানের নিশ্চয়তাকে একেবারেই বিশ্বাস করা যায় না। লেনিন যদিও জোর দিয়ে বলেছেন যে সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী এবং পুলিশের মধ্যেই বে-আইনি কাজের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তথাপি কমিউনিস্টদের তিনি এই বলে সতর্কও করে দিয়েছেন যে কেবলমাত্র বেআইনি কাজ না করে আইনি পথে সুযোগের সদ্ব্যবহার করারও প্রয়োজন আছে। যেমন, আইনগ্রাহ্য সংবাদ মাধ্যম গড়ে তোলা এবং নানাবিধ শিরোনামে আইনি সংগঠন তৈরি করা। লেনিন লিখেছেন, কমিউনিস্টরা যেহেতু ছেদহীন সংগ্রামে লিপ্ত এবং শ্রেণিসংগ্রাম আসলে নির্মম লড়াই-এর একটি ধরন, এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁদের যাবতীয় সম্ভাব্য কৌশল ও প্রকরণ ব্যবহার করতে হবে। আর তাঁদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য একটাই; বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল।

বিপরীত চিত্রও দেখা যায় রাশিয়ায়। গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা মনে করতেন একটি লিবারেল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রের পথে চালিত করা যায়।  উদাহরণ, ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন। এমনক্ষেত্রে কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যমগুলি একতরফাভাবে পুঁজিবাদীদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ব্যাপারে লেনিন আরও বেশি নিরাশাবাদী। তিনি বলেছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ শ্রমজীবীই ধনতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে অপারগ। একমাত্র শ্রেণি সচেতন বিপ্লবীদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী- যাঁরা আসলে সর্বহারাদের কমিউনিস্ট অগ্রদূত- পরিস্থিতির ঠিক ঠিক বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন। ধনতন্ত্রের পুনঃ পুনঃ প্রাদুর্ভাবের বিপদ থেকে সাম্যবাদকে রক্ষা করার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ব প্রয়োজন। আর যতদিন না বেশিরভাগ শ্রমিক নিজেদের ধনতান্ত্রিক মতাদর্শ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারছে, ততদিন প্রয়োজন সর্বহারার উপর কমিউনিস্ট নেতৃত্বের একনাকয়ত্ব। লেনিন শেষ বিচারে সর্বহারার  একনাকয়ত্ব নামক আধিপত্যবাদকে এই যুক্তিতে ন্যায়সঙ্গত বলে দাবি করেছিলেন যে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই সঠিকভাবে ভাবতে বা সঠিক কাজ করতে অক্ষম। সমাজ এবং ইতিহাসের নীতিসূত্রগুলির সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী কমিউনিস্টদের জনসাধারণকে একটি নতুন পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার এবং দায়িত্ব দুটিই আছে। তবে পুরোনো দুনিয়া যেহেতু দূষিত এবং নীতিভ্রষ্ট, তাই কমিউনিস্টরা তাঁদের সমাজ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের কারণে, সর্বহারার সাধারণ ইচ্ছার ( General Will of the proletariat) প্রতিনিধিত্ব করেন। অবশ্য সর্বহারার অন্তর্ভুক্ত সকলের ইচ্ছা (Wills of All) এই সত্য স্বীকার করতে অনিচ্ছুক।

উপরিউক্ত রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে বাস্তবায়িত করেই জারতান্ত্রিক রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করা হয়। এর ড্রেস-রিহার্সাল শুরু হয়েছিল প্রথম রুশ বিপ্লবের (১৯০৫) মধ্য দিয়ে। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের রাজত্বকালে সরকারি কাজকর্মের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জনগণের মনে অসন্তোষ ও সরকার বিরোধী মনোভাব প্রকট হয়ে ওঠে। সরকারের দমননীতি এবং শাসনব্যবস্থার দুর্নীতি সাধারণ মানুষের বিপ্লবী প্রবণতা বৃদ্ধি ঘটায়। নির্যাতিত কৃষকদের অসন্তোষকে ভিত্তি করে জর্জ প্লেখানভ ‘ভূমি ও স্বাধীনতা’ (Land and Liberty) প্রাপ্তির জন্য বিপ্লবের ডাক দিলেন। ঠিক এই সময়ে রুশ-জাপান যুদ্ধে (১৯০৫) রাশিয়া পরাজিত হয়। এই পরাজয় জনগণের মনে তীব্র বিক্ষোভ সঞ্চার করে। তারা সরকারি শাসনতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর উপর বিশ্বাস হারায়। সংস্কারপন্থীরা অবিলম্বে আন্দোলন শুরু করে। আবার একথাও বোঝা যায় যে সংস্কার দ্বারা সমাজ পরিবর্তনের আশা নেই। সুতরাং বিপ্লবই একমাত্র পথ। এই বিপ্লবী প্রচেষ্টা প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে। এই ঝাঁকুনি সদ্য জাপান কর্তৃক পরাজিত রুশ রাজতন্ত্র সামলাতে পারে নি। তবে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব সংগঠনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভূমিকা সর্বাধিক। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়াতে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক্সের জন্ম নিয়েছিল। ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত যে যুগ অতিবাহিত হয়েছে, এটি সাম্রাজ্যবাদের যুগ নামে পরিচিত। তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর্যালোচনা করতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একদিকে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া।  তারা ইতিহাসে ‘মিত্র পক্ষ’ (Allied Powers) নামে পরিচিত। জার্মানীর নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বিসমার্ক অস্ট্রিয়া ও ইতালির সঙ্গে যে সামরিক চুক্তি স্থাপনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রি-শক্তি (Triple Alliance) চুক্তিতে পরিনতি লাভ করে। এর প্রত্যুত্তরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং রাশিয়া ত্রি-শক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইউরোপীয় দেশগুলি যখন দুটি পরস্পর বিরোধী ‘যুদ্ধ শিবিরে’ পরিনত হয়েছিল তখন যে-কোন ঘটনার আন্তর্জাতিক সূত্র ধরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা স্বভাবতই ছিল। অধ্যাপক এ জে পি টেলর অবশ্য প্রথম যুদ্ধে সকল শক্তির দায়িত্ব মেনে নিয়েছেন। যাই হোক না কেন, সন্দেহ নেই  যে পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বপ্রথম সর্বাত্মক যুদ্ধ (Total War) এর পূর্বে অপর কোন যুদ্ধ এত ব্যাপকতা লাভ করেনি। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রুশ বিপ্লবের পরবর্তীকালে বলশেভিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেন লেনিন।

চলবে-

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।