বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৪১): রাশিয়ার নির্বাচন ও তার পর 

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হল এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী ভ্লাদিমির পুতিন আরও ৬ বছরের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন। তবে যেটা ছিল অপ্রত্যাশিত তা এত বিপুল ভোটে তাঁর বিজয় এবং এত বেশি মানুষের ভোট প্রদান। রাশিয়ার নির্বাচন কভার করার জন্য দেশ থেকে অনেকেই এখানে এসেছিলেন, দেশ থেকেও অনেকেই যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন এই নির্বাচন সম্পর্কে। তাতে করে কী ধরণের প্রশ্ন দেশের মানুষদের মনে জাগে সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়েছে। এরই মধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব থেকেও এ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। তাই গত সপ্তাহের লেখার সূত্র ধরে এসব বিষয়েই আজ কথা বলব।

অনেকের মনেই প্রশ্ন এই নির্বাচন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

এটা আমার দেখা অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেগুলো আমি কাছ থেকে ফলো করেছি। সোভিয়েত আমলে নির্বাচন ছিল রেফারেন্ডম টাইপের। একজন প্রার্থী থাকত – তাঁর পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করত মানুষ। পেরেস্ত্রইকা আর গ্লাসনস্তের হাত ধরে আসে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে থেকে নির্বাচন করার সুযোগ। ১৯৯১ সালের ১২ জুন তখনও সোভিয়েত ইউনিয়নের এই অঙ্গ রাজ্য রাশিয়ান ফেডারেশনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। সেই সময় ৬ জন প্রার্থী এতে অংশগ্রহণ করেন – বরিস ইয়েলৎসিন, নিকোলাই রিঝকভ, ভ্লাদিমির ঝিরিনভস্কি, আমান তুলিয়েভ, আলবার্ট মাকাশভ ও ভাদিম বাকাতিন। ৭৬.৬৬% ভোটার সেই নির্বাচনে ভোট দেন। ৫৭.৩% ভোট পেয়ে ইয়েলৎসিন রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তখন একেবারেই ভিন্ন সময়। আমি নিজেও বন্ধুদের মাঝে ইয়েলৎসিনের পক্ষে ভোট চেয়েছি। সেটা ছিল সত্যিকার অর্থেই যুগান্তকারী নির্বাচন। তবে তখন মানুষ জানত না এর ফলাফল কী হতে পারে। কিছু দিনের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙবে, ভাঙবে অর্থনীতি (সেটা অবশ্য অনেক আগেই ভেঙে পড়েছিল), ভাঙবে লাখ লাখ মানুষের কপাল। দেশ পরিণত হবে আমেরিকার উপনিবেশে। ইতিমধ্যে দেশ পার হবে ১৯৯৩ সালের রাজনৈতিক বিপর্যয়। কয়েক বছর আগে যারা ইয়েলৎসিনের জন্য লড়াই করেছিল তাদের অনেকেই আজ বিরোধী শিবিরে। প্রায় শূন্যের কোঠায় তাঁর জনপ্রিয়তা। সেটা পুঁজি করে আবার নির্বাচনে নামেন তিনি। এবারের স্লোগান – ভোট দাও, নইলে হেরে যাবে। সেই সাথে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির বদলা নেবার ভয় জাগানো গল্প। ফ্যাক্সের কাগজের কার্টুনে হাজার হাজার ডলার এহাত ওহাত করার দৃশ্য। নব্য ধনী ও পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর ব্যাপক হস্তক্ষেপে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটে ইয়েলৎসিনের বিজয়। পরে অবশ্য অনেক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে বলা হয়েছে যে ঐ বিজয় ছিল আসলে জুগানভের কাছ থেকে চুরি করে নেয়া। তাই পশ্চিমা বিশ্ব যখন ভোট কারচুপির কথা বলে তখন এসব ইতিহাস তাদের মনে করা একান্তই দরকার।

আসলে সেই সময় ছিল একটা দেশের ধ্বংসের ইতিহাস। সত্তর বছর ধরে অনেক রক্ত, ঘাম আর কান্নার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা ব্যাপক সামাজিক সম্পদের ব্যক্তি মালিকানায় যাবার ইতিহাস। একের পর এক প্রধানমন্ত্রী বদলের ইতিহাস। পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্টের চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বের ইতিহাস। এর মধ্যে আসবে ১৯৯৮ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়। চেচনিয়ার যুদ্ধ। মানুষের চোখে ভূলুণ্ঠিত হবে রাশিয়া ও সে দেশের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের মান সম্মান। এই এক অনিশ্চিত পরিবেশেই ইয়েলৎসিন পুতিনকে দেবেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। সেই সময় মনে হয়েছিল অন্যান্য বহু প্রধানমন্ত্রীর মত পুতিন নিজেও ইয়েলৎসিনের দাবার আরেকটা ঘুঁটি। বিশাল বপু ইয়েলৎসিনের পাশে ছোটখাটো পুতিন বড়ই বেমানান। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই চেচনিয়ার যুদ্ধে তাঁর দৃঢ়তা প্রমাণ করতে এ অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। এরপর আসবে সেই বিখ্যাত দিন – ১৯৯৯ সালে ৩১ ডিসেম্বর। নতুন বছরের, নতুন শতাব্দীর, নতুন সহস্রাব্দীর আগমনের কয়েক ঘণ্টা আগে ইয়েলৎসিন ঘোষণা করবেন রাজনীতি থেকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে তাঁর অবসর নেবার কথা। পুতিন হবেন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। সেই সময় ইয়েলৎসিন ছিলেন আমেরিকা আর নিজের তৈরি অলিগারখদের খেলার পুতুল – ক্ষমতালোভী এক নেতা। অনেকের ধারণা এত ধ্বংস, এত মৃত্যুর মধ্যে পুতিনকে ক্ষমতায় বসানোই হল ইয়েলৎসিনের একমাত্র ভালো কাজ। তখন পশ্চিমা বিশ্বে প্রশ্ন উঠবে কে এই মিঃ পুতিন?

চেচিনায় যুদ্ধে সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে পুতিন অচিরেই মানুষের মন জয় করবেন। ২০০০ সালের মার্চের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রথম ট্যুরেই ব্যাপক ভোটে বিজয়ী হবেন। তখনও তিনি মনে প্রাণে চাইবেন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশ চালাতে। এর মধ্যে ডুববে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কুরস্ক। বন্ধ হবে ভিয়েতনামের সামরিক ঘাঁটি। তবে ইতিমধ্যেই অলিগারখদের ক্ষমতা কমবে। শোনা যায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পরেই তিনি বড় বড় ব্যবসায়ীদের ডেকে রাজনীতিতে নাক না গলানোর অনুরোধ করেন। সে সময় খাদারকভস্কি তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ভয় দেখান। সেটাই খাদারকভস্কি ও ইউকসের জন্য কাল হয়। তিনি সে সময় ছিলেন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ধনী। এই একজনকে ঠাণ্ডা করেই পুতিন সবাইকে বুঝিয়ে দেন দিন বদলের কথা। এ গল্প রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন প্রধান গেরাসিমভ বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। সত্যতা যাচাই করা কষ্ট সাপেক্ষ হলেও সেই রাশিয়ায় এ ধরণের ঘটনা অসম্ভব ছিল না। বেরজভস্কি, গুসিনস্কি সহ অনেকেই যারা ইয়েলৎসিনের আমলে রাজনীতিতে বিশাল প্রভাব রাখতেন তারাও ধীরে ধীরে পাত্তারি গুটিয়ে চলে জান। এ বিষয়ে এক সুন্দর চুটকি আছে।
দেশত্যাগের আগে বেরেজভস্কি আসেন পুতিনের কাছে বিদায় নিতে।
ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ, ভোত রিসিল ভ আংলিই পায়েখাত – ইংল্যান্ডে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পুতিন – অচিন খারাশো। আ কাক না শত পাসিদেত পেরেদ দারোগোই? খুব ভালো। যাবার আগে একটু বসলে কেমন হয়? (রাশিয়ায় কোথাও যাওয়ার আগে একটু বসে বেরুনোর রীতি আছে। তবে বসার আরেক অর্থ জেলে থাকা। এখানে পুতিন বেরেজভস্কিকে জেলে ঢোকার প্রস্তাব দেন)

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৪০):রাশিয়ার নির্বাচন –বিজন সাহা

এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই ২০০৪ সালে তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে ধীরে ধীরে কী পুতিন, কী রুশ জনগণ সবার মধ্যেই প্রশ্ন জাগবে পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধুত্বের চরিত্র নিয়ে। ২০০৭ সালে মিউনিখ কনফারেন্সে উচ্চারিত হবে অধিকারের কথা। অনেক দিন পরে আমেরিকা বিশ্বের কোন নেতার কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। তবে রাশিয়া তখনও দুর্বল। তাকে পাত্তা দেবার কোন প্রয়োজন আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব মনে করেনি। তাদের কাছে রাশিয়া এক ক্ষয়িষ্ণু দেশ যা অচিরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের মত ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। সেটা শুধুই সময়ের ব্যাপার। সে জন্যেই তারা চেচনিয়ায় জুগিয়েছে যুদ্ধের রসদ। সেই চেষ্টা করেছে বিভিন্ন প্রদেশেই। তবে পুতিন নিজেও বসে ছিলেন না। তিনিও ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ করেছেন দেশের প্রতিটি অঞ্চল।

তখন রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী কেউ পর পর দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারতেন না। তাই ২০০৮ সালে পুতিনের জনপ্রিয়তায় ভর করে দ্মিত্রি মেদ্ভেদেভ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। পুতিন দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রীর। এ নিয়ে অনেক কথা আছে। কেউ ভাবেন এটা ক্ষমতার লোভ। আমার কেন যেন মনে হয় সেটাই একমাত্র কারণ নয়। রাশিয়ার সংবিধান লেখে আমেরিকানরা তাদের নিজেদের স্বার্থে। এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস বলে অন্য কথা। সব সময়ই রাশিয়ার উন্নয়ন ঘটেছে শক্তিশালী শাসকের হাত ধরে। এ সেই শাসক যে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায় না, দায়িত্ব নিতে ভয় পায় না। গরবাচেভের মত যারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তাদের হাতে রাশিয়া সব সময় ধ্বংসের পথে গেছে। ইয়েলৎসিন সিদ্ধান্তহীনতায় তেমন না ভুগলেও তাঁর কাছে দেশের চেয়ে ব্যক্তিগত ক্ষমতার মোহ বেশি ছিল আর জনসমর্থন ছিল কম। পুতিন এক দিকে সিদ্ধান্ত নিতে ও দায়িত্ব নিতে যেমন পারেন, তেমনি পারেন তার সাথে মানুষের স্বার্থের সমান্বয় ঘটাতে। ফলে প্রায় ২৫ বছর ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থা করলেও তিনি নিজেকে জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক করে রাখতে পেরেছেন। আমার ধারণা পশ্চিমা বিশ্ব সব সময় অপেক্ষা করেছে কবে পুতিন ক্ষমতা থেকে অবসর নেবে। ২০০৮ সালে মেদ্ভেবেভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার কিছুদিন পরে পুতিন পিকিং জান অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেই সুযোগে ২০০৮ সালের ০৮ আগস্ট জর্জিয়া দক্ষিণ অসেতিয়া আক্রমণ করে। সেখানে রুশ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা ছিল। এটাও মনে হয় এক ধরণের সিগন্যাল ছিল – কেন এ দেশে পুতিনের থাকা দরকার। আমার ধারণা ইয়েলৎসিন কোন মতেই প্রধানমন্ত্রী হতে রাজী হতেন না। এটা তাঁর ইগোতে লাগত। পুতিন সেক্ষেত্রে নিজের ক্ষমতার পাশাপাশি দেশের কথাও ভেবেছেন। যদিও ধীরে ধীরে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু হয়েছিল, সেটা এখনও শেষ হয়নি। তাই তাঁর মত নেতা যার পেছনে দেশের বিভিন্ন স্রোতের মানুষ এক হবে সেটা শুধু তাঁর জন্য নয়, দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সেদিক থেকে অনেকটা বঙ্গবন্ধু বা গান্ধীর মত। শোনা যায় ২০১১ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়া সফরে এসে পুতিনকে ২০১২ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার জন্য বলেন। করলে রাশিয়ায় আরব বসন্ত টাইপ বিপ্লব করা হবে বলেও হুমকি দেন। তবে পুতিন সেসব কথায় পাত্তা দেননি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০১১ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরে নাভালনি ও অন্যান্যদের মাধ্যমে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্য দিয়েই ২০১২ সালের মার্চে পুতিন আবার বিপুল ভোটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এবার ৬ বছরের জন্য।

চলবে . . .

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো