বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৪০):রাশিয়ার নির্বাচন

–বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

১৫, ১৬ ও ১৭ মার্চ, ২০২৪ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ নিয়ে আজ দু’টো কথা। এবার নির্বাচনে মোট ৪ জন প্রার্থী, তিন জন বিভিন্ন পার্টি থেকে আর একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন, যদিও রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় দল এদিনায়া বা ইউনাইটেড রাশিয়া ও অন্য আরেক দল স্প্রাভেদলিভায়া বা ন্যায্য রাশিয়া তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। তিনি যদি কোন পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে দাঁড়াতেন তবে তাঁকে কম করে হলেও তিন লাখ ভোটারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হত না। সেটাই করেছেন অন্য তিন প্রার্থী – নভিয়ে লিউদি বা নতুন মানুষদের ভ্লাদিস্লাভ আন্দ্রেইয়েভিচ দাভানকভ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির লিওনিদ এদুয়ারদোভিচ স্লুৎস্কি ও রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নিকোলাই মিখাইলোভিচ খারিতনভ। বুলেটিনে এদের নম্বর থাকবে সারনেম বা পদবির আলফাবেটিক ক্রমানুসারে – ১) দাভানকভ, ২) পুতিন, ৩) স্লুৎস্কি, ৪) খারিতনভ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে তিন লাখ ভোটারের স্বাক্ষর শুধু এক এলাকা থেকে সংগ্রহ করলে হবে না, সেটা করতে হবে দেশের ৮৯ টি এলাকা থেকেই আর প্রত্যেক এলাকা থেকে কম করে হলেও তিন হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। এমনকি যদি কেউ ফর্মালি এক এলাকার ভোটার হয়ে কর্ম ক্ষেত্রে অন্য এলাকায় থাকে তবে সে নিজ এলাকার প্রতিনিধি হয়ে স্বাক্ষর করতে পারবে না, নির্বাচন কমিশন সেটা গ্রহণ করবে না। সেটা করলে অধিকাংশ প্রার্থীরা মস্কো, পিতেরবুরগ এরকম কয়েকটি বড় শহর থেকেই প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর সংগ্রহ করত। যেহেতু প্রেসিডেন্ট সমস্ত দেশের প্রতিনিধি, তাই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে প্রমাণ করতে হবে যে দেশের প্রতিটি প্রদেশেই তাঁর কম করে হলেও তিন হাজার সমর্থক আছে। এবারও এই ক্রাইটেরিয়ায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে বেশ কয়েকজন প্রার্থী বুলেটিনে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারেনি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরিস নাদেঝদিন। তবে সব দেখে মনে হয় যারা তাঁকে সাহায্য করেছিল তারা ইচ্ছে করেই শুধু মস্কো থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে। এরা নন-সিস্টেম অপজিশন যাদের মূল উদ্দেশ্য রাশিয়ার বর্তমান প্রশাসনকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে হেয় করা। এরা এমনিতেই জানত নাদেঝদিন ১% এর বেশি ভোট পাবে না। তাই ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন কিছু করা যাতে তাঁকে প্রার্থী করা না হয় আর এটা নিয়ে পরে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গালভরা অভিযোগ আনা যায়।
এখন পার্লামেন্ট পার্টি সম্পর্কে দুটো কথা। এদেশের পার্লামেন্টের লোয়ার হাউজ ৪৫০ সীট বিশিষ্ট। এরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। আগে ২২৫ জন পার্টি লিস্টে আর ২২৫ জন সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন। ১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৯, ২০০৩ ও ২০১৬ সালে সেভাবেই নির্বাচন হয়েছে। তবে ২০০৭, ২০১১ ও ২০২১ সালে ৪৫০ টি আসনের সবগুলোতেই নির্বাচন হয়েছে পার্টি লিস্টে। মানে আনুপাতিক হারে যে পার্টি যত পারসেন্ট ভোট পায় সেই পার্টি সেই অনুযায়ী আসন পায়। তবে পার্লামেন্টে বসার জন্য পার্টি বা জোটকে অবশ্যই কমপক্ষে ৫% ভোট পেতে হবে। আর সেই ধরণের পার্টির সংখ্যা কম করে হলেও দুটো হতে হবে এবং এই দুই পার্টির সম্মিলিত ভোট প্রদত্ত ভোটের ৫০% এর বেশি হতে হবে। কোন কারণে ৫% ভোটের ব্যারিয়ার অতিক্রমকারী দলগুলোর সম্মিলিত ভোট  প্রদত্ত ভোটের ৫০% এর কম হলে যারা ৫% ব্যারিয়ার পার হতে পারেনি তাদেরও পার্লামেন্টের আসন দেয়া হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমাদের দেশে যে কেউ জামানত জমা দিয়ে প্রার্থী হতে পারে। এখানে জামানত মানে ভোটারদের স্বাক্ষর। যেহেতু যে সমস্ত দল পার্লামেন্টে জায়গা করে নেয় তাদের পেছনে জনসমর্থন আছে তাই তাদের প্রার্থীকে নতুন করে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয় না। এদিক থেকে আমার মনে হয়  পার্টির প্রার্থীর স্বতন্ত্র ভাবে দাঁড়ানো ভালো। কেননা তাহলে তাঁকে বা তাঁকে সমর্থন দানকারী পার্টিকে আগে থেকেই স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নামতে হয়। মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়। ফলে সেই প্রার্থী বা দল আগে থেকেই নির্বাচনে পরোক্ষ ভাবে হলেও নামতে পারে। যারা পার্টির প্রার্থী তারা নির্বাচনে নামতে পারে সব প্রার্থীর নাম ঘোষণা হয়ে গেলে।

অনেক আগে নির্বাচন সফল হয়েছে বলে মেনে নেওয়া হত যদি তাতে মোট ভোটার সংখ্যার ৫০% + ১ জন অংশ গ্রহণ করত। নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করত বিধায় এই ব্যারিয়ার সঠিক মনে করা হত। কিন্তু এমনকি ইয়েলৎসিনের শাসনামলেই মানুষের মধ্যে নির্বাচনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। তাই ব্যারিয়ার ২৫% এ নামিয়ে আনা হয়। তবে আমাদের দেশের মোট প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচন হয় না। তাই কম করে হলেও দুজন প্রার্থী থাকতেই হয়। নির্বাচনে সরাসরি জেতার জন্য কোন প্রার্থীকে কম করে হলেও প্রদত্ত ভোটের ৫০% + ১ ভোট পেতে হয়। না হলে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রার্থীর মধ্যে আবার নির্বাচন হয়। এক্ষেত্রে আর উপস্থিতির ব্যারিয়ার থাকে না এবং বিজয়ী হন সেই প্রার্থী যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন।

আমাদের দেশে যেখানে ভোটারদের ভোট দিতে অনুৎসাহিত করা হয়, এখানে তার উল্টোটা। সব সময় চেষ্টা করা হয় প্রতিটি নাগরিককে ভোট কেন্দ্রে আনার জন্য। তবে ভোট না দিলে কোন রকম জরিমানা করা হয় না, যদিও সে রকম উদ্যোগ একাধিক বিরোধী দল নিয়েছিল। ইউরোপের কোন কোন দেশে সেরকম ব্যবস্থা আছে। তবে চেষ্টা করা হয় মানুষকে বুঝিয়ে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসার। সেজন্য সব সময়ই বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেমন অন্ধদের জন্য স্পেশাল ব্যালট পেপার তৈরি করা হয়েছে। যাতে অসুস্থ মানুষ বাড়িতে বসে ভোট দিতে পারে সে জন্য সে আগে থেকে নির্বাচিত কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে কয়েক জনের একটি দল পোর্টেবল ভোট বাক্স সহ তার বাসায় এসে ভোট সংগ্রহ করে। ফর্মালি ১৫ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত ভোটের দিন নির্ধারিত হলেও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। ঐ সময় যারা কার্যসূত্রে দেশের বাইরে থাকবে, বিশেষ করে নাবিকরা আগে থেকে ভোট দেয়। এছাড়া উত্তর রাশিয়া ও তাইগায় যারা কাজ করে, বিশেষ করে যারা হরিণ পালক ও অনবরত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, এমন কিছু সংখ্যক লোকের কাছেও বিমান বা হেলিকপ্টারে করে ব্যালট আর একই সাথে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য, আত্মীয় স্বজনদের চিঠিপত্র নিয়ে যায়। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা কাজ করে। এখানে সবারই একটা স্থায়ী ঠিকানা থাকে। সেখানেই তার ভোট কেন্দ্র। সেখানেই সে ভোট দিতে পারে। কিন্তু যদি তার কর্মক্ষেত্র অন্যত্র হয় তবে সে আগে থেকেই দরখাস্ত করে তার সুবিধা মত যেকোনো কেন্দ্রে ভোট দেবার সুযোগ নিতে পারে। আগে সেটা করার জন্য পার্সোনালি অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হত। এখন এসব অনলাইনে করা যায়। এছাড়াও অনলাইনে ভোট দেবার সুজোগ আছে অন্তত মস্কো সহ বেশ কিছু প্রদেশের মানুষের, যেখানে ইন্টারনেট ফ্যাসিলিটি যথেষ্ট সেখানে। উল্লেখ করা দরকার যে হ্যাকার বা নির্বাচন বানচালে আগ্রহী কেউ দুর্বল সিগন্যালের সুযোগ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বিধায় এখনও দেশের সব প্রদেশে অনলাইন ভোট চালু হয়নি। আমি নিজে এ সব ধরণের ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেছি। মূল কথা হল যদি কেউ ভোট দিতে চায় তার জন্য বিভিন্ন সুযোগ আছে সেটা করার। আর কারো পক্ষেই একটার বেশি ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। যারা সময়ের আগে ভোট দিতে চান আজকেই তাদের শেষ সুযোগ। এখনও পর্যন্ত ২০ লাখ মানুষ সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে বলে খবরে প্রকাশ। এখানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ভোটে অংশগ্রহণ করে। যারা এ সময় যুদ্ধরত তারা সাধারণত আগেই ভোট দান সম্পন্ন করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৪১): রাশিয়ার নির্বাচন ও তার পর – বিজন সাহা

গতকাল আমাদের ইনস্টিটিউটে দুবনার মেয়র এসেছিলেন। বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছেন। এমনিতেই মত বিনিময় সভা। বিভিন্ন ধরণের কাজকর্ম হচ্ছে দুবনায়, নতুন হাসপাতাল, স্পোর্টস কমপ্লেক্স ইত্যাদি গড়ে উঠছে। আমাদের মতামত এ নিয়ে জানতে চাইলেন। আমি ফটো ক্লাবের জন্য কোন জায়গা দেয়া যায় কিনা সেটা জানতে চাইলাম। এসবের পরে শেষ বললেন, জানেন তো আগামী ১৫, ১৬, ১৭ তারিখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আমি কোন প্রার্থীর জন্য ভোট চাইব না। তবে একটাই অনুরোধ, ভোট দিন। যাকে খুশি তাকে দিন, কিন্তু ভোট দিন।

এর আগে আমি অনেককেই বলতে শুনেছি তাদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য, কোন বিশেষ প্রার্থীকে ভোট দেবার জন্য বলা হয়েছিল। তবে নিজে কখনও এর সম্মুখীন হইনি। বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে মনে হয় এটা একেবারে খারাপ নয়। কারণ এবার ভোটে কে জিতবে সে নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। না, এটা কারচুপি বা সে রকম কিছু নয়। রুশরা বলে নদী পার হবার সময় গাড়ির ঘোড়া বদলায় না। এখন যুদ্ধকালীন সময়, সবাই বোঝে যুদ্ধটা পঞ্চাশটারও বেশি দেশের সাথে। আর ওরা যুদ্ধে নামিয়েছে পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যই। তাই পুতিনের পরাজয় যুদ্ধে পরাজয়ের সমান। সেদিক থেকে এই নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে বেশ কিছু দল স্বতন্ত্র প্রার্থী ভ্লাদিমির পুতিনকে সমর্থন দিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি জুগানভকে নির্বাচনে না নামিয়ে খারিতনভকে নমিনেশন দিয়েছে। এ রকম আগেও হয়েছে। তবে যেহেতু এখানে বিনা নির্বাচনে জেতার অপশন নেই, তাই সবাই চাইলেও পুতিনকে সমর্থন দিয়ে প্রার্থী তুলে নিতে পারবে না, সেক্ষেত্রে নতুন নির্বাচন হবে, নতুন প্রার্থীদের নিয়ে। তাই পশ্চিমারা উঠেপড়ে লেগেছে হারাতে না পারলেও নির্বাচন যাতে বানচাল করা যায়, কম উপস্থিতির ফলে যাতে ভোটের বৈধতা নয়, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় সেটা করতে ঠিক যেমনটা কিছুদিন আগে আমাদের দেশে হয়েছে। তাই এদের থেকে সমস্ত চেষ্টাই করা হচ্ছে যাতে যতদূর সম্ভব বেশি মানুষ ভোট দিতে আসে সেটা নিশ্চিত করার। আরও একটা কথা। এখানে আর যাই হোক কোন প্রার্থীর উপর ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করা হয় না, সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এরা নির্বাচনী প্রচার করেন। ফলে নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের দেশের মত উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করে না। সবাই একটা কথা বিশ্বাস করেন, নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সবাই লড়াই করছে রাশিয়ার জন্য, এদেশের আর দেশের মানুষের উন্নতির জন্য। শুধু নির্বাচন নয়, দেশের জন্য যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার আগে সমস্ত দলের নেতাদের সাথে পরামর্শক্রমেই তা করা হয়। আমাদের এখান থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে। তাছাড়া এদের নির্বাচন অনেক খোলামেলা। প্রতিটি নির্বাচনে প্রচুর বিদেশী পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরাও নির্বাচনের উপর অনেক প্রতিবেদন তৈরি করেন বিভিন্ন কেন্দ্রে উপস্থিত থেকে। কোন কিছুই নিখুঁত নয়, তবে এখান থেকেও অনেক কিছুর শেখার আছে বলেই আমার মনে হয়। নির্বাচন উপলক্ষ্যে ভ্লাদিমির পুতিন আজ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন, ভোট কেন্দ্রে আসুন, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন, কিন্তু ভোট কেন্দ্রে আসুন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো