বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৮):ভাষা

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশে বা সঠিক ভাবে বললে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ফেব্রুয়ারি মানেই ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি এলেই রক্তে এক ধরণের রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, মানুষ ভাষার কথা বলে, বাংলা ভাষার কথা বলে। অনেক আগে একবার লিখেছিলাম ভাষা মানুষকে মানুষ করছে। কারণ ভাষা মানুষকে নিজেদের ভাবনা স্থান কালের গণ্ডী পার করে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেবার সুযোগ করে দিয়েছে। আর কে না জানে বর্তমান যুগে তথ্য হল অমূল্য সম্পদ। তাহলে কি অন্য কোন প্রাণীর ভাষা নেই? আছে। তবে সেটা অন্য ভাষা। সেটা প্রকৃতিদত্ত। প্রকৃতিদত্ত একারণেই যে সেটা স্থান কাল নির্বিশেষে সব জায়গায় সত্য। একটা পশুর ডাক কী এশিয়া, কী আফ্রিকা, কী আমেরিকা সব জায়গায় একই রকম। আমেরিকার কুকুরকে নতুন করে বাংলা শিখতে হয় না, তারা অনায়াসে নিজেদের মধ্যে ভাব আদান প্রদান করতে পারে, ঠিক যেমন পারে শিশু যে এখনও কোন ভাষা রপ্ত করেনি। তার চিৎকার, তার আকার ইঙ্গিত বিশ্বের যেকোনো শিশুর মতই। কিন্তু ভাষা, অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, রুশ, হিন্দি, আরবি, জার্মান, স্প্যানিশ – এ সব মানুষের নিজের আবিষ্কার, নিজের প্রয়োজনে। এটা প্রকৃতিদত্ত নয়। আর সে কারণেই একেক দেশে একেক রকম। এ জন্যেই এক দেশের বুলি অন্য দেশে গালি। এই ভাষা গড়ে উঠেছে সে সব স্থানের ভৌগলিক বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদির সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধ্বনি যা ভাষার পরমাণু। আর এ কারণেই সেটা পদার্থবিদ্যা বা বাইওলজি বা রসায়নের তত্ত্বের মত সব জায়গায় এক নয়। তাই বলা যায় ভাষা মানুষের নিজের তৈরি। এবং যাকিছু ভাষার সাথে সম্পৃক্ত সেটাও মানুষের তরি। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এসব? সাবজেক্ট বা ডিসিপ্লিন হিসেবে এরা নিঃসন্দেহে মানুষের তৈরি কিন্তু প্রকৃতির বিবর্তনের নিয়ম মানুষের তৈরি নয়। এসব বিষয় বিজ্ঞান এজন্যেই যে এখানে মানুষ প্রকৃতির গঠন, প্রকৃতির বিবর্তন এসব বোঝার চেষ্টা করে, সে এখানে কিছু চাপিয়ে দেয় না, যাকিছু প্রকৃতিতে ঘটছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে, বুঝে ব্যাখ্যা করে। অনেক সময় সফল, অনেক সময় ব্যর্থ সে চেষ্টা। কিন্তু বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী সে কখনও কোথাও ফুল স্টপ বসায় না, কেননা জানে নতুন নতুন তথ্য তাকে তার ব্যাখ্যা নতুন করে দিতে বাধ্য করতে পারে। এঙ্গেলস বলেছেন শ্রম মানুষকে মানুষ করেছে। সেই সূত্র ধরে বলা যায় ভাষা মানুষকে আধুনিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। তবে সব কিছুর মতই ভাষারও ভালো ও মন্দ দুটো দিকই আছে। একদিকে ভাষার বদৌলতে মানুষ যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিজদের অভিজ্ঞতা পৌঁছে দিতে  পেরেছে, সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে জীবনকে সহজ করে তুলতে পেরেছে, অন্য দিকে সেই ভাষাই মানুষকে শিখিয়েছে অন্যদের ঠকাতে, অন্যদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে। ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, মানবতার নামে যেসব অমানবিক কাজকর্ম করা হচ্ছে, মানুষে মানুষে বিভেদ করা হচ্ছে সেটাও করা হচ্ছে এই ভাষা ব্যবহার করেই। তবে কি ভাষা নিষিদ্ধ করতে হবে? মোটেই না। পৃথিবীতে ভালো মন্দ সব ধরণের কাজ হয়। হয়, কারণ এসব করা মানুষের প্রবৃত্তি। তবে খারাপ কাজ যাতে ভালো কাজকে ছাড়িয়ে না যায় সে জন্য আছে সমাজ, সামাজিক নিয়ম, রাষ্ট্রীয় আইন কানুন। সমাজের কাজ, সরকারের কাজ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা। সমাজ বা রাষ্ট্র যখন সেটা করতে ব্যর্থ হয় তখনই শুরু হয় সমস্যা। তাই ভাষার মাস এলেই আমরা যেন অন্ধভাবে ভাষার পেছনে না ছুটি, সেখানেও যে ভালো মন্দ আছে সেটা মাথায় রেখে ভাষা ব্যবহার করি। ভাষা যেন ঐক্যের মাধ্যম হয়, বিবাদের নয়। মনে রাখতে হবে ভাষার ঐক্যই আমাদের বাহান্ন উপহার দিয়েছিল, ভাষা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল, দিয়েছিল নতুন মানচিত্র, নতুন দেশ – বাংলাদেশ।

পৃথিবীর সব মানুষের সুখের ভাষা হাসি, দুঃখের ভাষা কান্না – তাই যদি কেউ পৃথিবী বা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন তাহলে সবাইকে একটি মাত্র ভাষা দিলে কী সমস্যা হত? এটাও আমাদের বলে যে ভাষা – সেটা একান্তই মানুষের আবিষ্কার। ঠিক যেমন ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম এসব। আসলে এসবই তো ভাষার উপরে ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে। ভাষা আছে বলেই আমরা শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হচ্ছি না, সভ্যতাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছি। অন্যান্য জীবজন্তু যেখানে তাদের উত্তরপুরুষদের নিজেদের অভিজ্ঞতা শুধু সরাসরি দান করতে পারে আমরা সেখানে হাজার বছর আগের মানুষের অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারি ভাষার সাহায্যে। একসময় সেটা ছিল মৌখিক, পরে সেটা লিখিত আকার পায়। এই যে দেয়ালে আদম + ইভ = ভালোবাসার চিহ্ন – এটাও তথ্য, অন্য মানুষদের জানানোর জন্য। একই ভাবে “শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না” বা “রক্তের বন্যায় মুছে দেব অন্যায়” এসবও একদল মানুষের আবেগ, ভালোবাসা বা প্রতিজ্ঞা যা সে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। এখান থেকেই প্রশ্ন জাগে তাহলে ধর্মীয় অনুশাসন কেন কোন কোন বিশেষ ভাষায় লেখা হল। সেটা যে হয়নি সে প্রমাণ আমরা পাই বিশ্বের কোণায় কোণায় বিভিন্ন ধর্মের উপস্থিতি দেখে, বিভিন্ন রকমের ধর্মীয় অনুশাসন দেখে। আর এটাই প্রমাণ করে ধর্ম উপর থেকে আসা কিছু নয়, এটাও মানুষের তৈরি – মানুষ তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। আর যেহেতু বিভিন্ন এলাকার মানুষের সমস্যা, সমাজ ব্যবস্থা, আবহাওয়া ছিল বিভিন্ন রকম – তাই তাদের প্রশ্ন, তাদের চাওয়া পাওয়া ছিল বিভিন্ন। এখান থেকে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন দেবদেবতা, বিভিন্ন ধর্মের স্বর্গের বা নরকের বিভিন্ন রূপ। এটা ভালো বা মন্দ নয়, এটা বাস্তবতা। মানুষ করলেই বা মানুষের সৃষ্টি হলেই যে কোন কিছু খারাপ হবে তার যেমন কোন মানে নেই, তেমনি সেটার ভালো হবার কোন গ্যারান্টি নেই। বিজ্ঞানও মানুষের তৈরি। বাইবেলে শুরুটা এমন – সবার আগে ছিল শব্দ (সাউন্ড নয় ওয়ার্ড)। আর ভাষা তো এই শব্দের সমাহার। শব্দগুলো এক এক করে সাজিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করাই ভাষা। ধর্মগ্রন্থে অনেক কিছুই প্রতীকী। সবার আগে ছিল শব্দ এটাও কি প্রতীকী নয়? আমরা তো আগেই দেখেছি ভাষাই মানুষকে মানুষ করেছে। আজ আমাদের ভালো মন্দ যা কিছু আছে সবই এই ভাষার কারণে, ভাষার উপরে ভিত্তি করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৯): রাশিয়ার কথা - বিজন সাহা

আমাদের ছোটবেলায় আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে বলতাম শোক দিবস, কালো ব্যাজ পড়তাম সেদিন। ১৯৮৩ সালে দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে আসার আগে পর্যন্ত একুশ পালন করা হত ভাবগম্ভীর পরিবেশে, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। তবে বর্তমানে মনে হয় বিজয় দিবস, ঈদ, পূজা ইত্যাদির মত একুশও একটি বাণিজ্যিক ইভেন্ট। অন্তত ফেসবুকে দেখে সেটাই মনে হয়। এখন আমরা ভাষার চর্চায় ততটা যত্নবান নই যতটা বই লিখে সমাজে নিজেদের মান সম্মান বাড়াতে, সূর্যের নীচে নিজের জায়গাটা স্থায়ী করতে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে সমস্ত জাতি এক হয়েছিল, যার ফসল আজকের বাংলাদেশ। কয়েকদিন আগে জাহীদ রেজা নূর আর চন্দনা সুলতানার একটা ইন্টারভিউ দেখলাম চন্দনার বাবা ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের উপরে। মোহাম্মদ সুলতান, যিনি ভাষা আন্দোলনের প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন, ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে উনি বাংলা ভাষার প্রতি আনুগত্য থেকে নিজের চার সন্তানের নাম রাখেন বাংলায়। কিন্তু স্কুলে ছেলেমেয়েরা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে চন্দনা শুক্তির নাম বদলিয়ে রাখতে হয় চন্দনা সুলতানা। একই ঘটনা ঘটে অন্য তিন সন্তানের সাথেও। অর্থাৎ বাঙালি আর মুসলমানের দ্বন্দ্বে তিনি বাধ্য হন এমনকি বাংলা নামকেও মুসলমানি করাতে। ফেব্রুয়ারি মাসে অনেকেই লিখেন বাংলা আমার গর্ব, আবার এদের অনেকেই বাংলায় নাম রাখতে লজ্জিত বোধ করেন। আপাত দৃষ্টিতে বাঙালি আর মুসলমানের দ্বন্দ্বকে জাতীয়তা আর ধর্মের দন্দ্ব মনে হলেও এটা মূলত জাতীয়তা ও বিশ্বায়নের দ্বন্দ্ব। আমরা বাংলা ভাষায় বই লিখে নাম যশ অর্জন করতে চাই আবার একই সময়ে নিজেদের ছেলেমেয়েদের বাংলা নাম রাখার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন না করে চুপ করে বসে থাকি। মনে রাখতে হবে মোহাম্মদ সুলতান বাধ্য হয়ে ছেলেমেয়েদের নাম বদলিয়েছিলেন। কারণ স্কুলের অন্যান্য ছেলেমেয়রা, শিক্ষকেরা, অভিভাবকেরা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তবে এটাও ঠিক, বাংলা ভাষাকে যারা অবজ্ঞা করে তারা কিন্তু এই ভাষা ব্যবহার করেই বিভিন্ন ওয়াজ থেকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ফতওয়া দেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুফল ব্যবহার করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে অনর্গল বলে যাওয়া এসব মানুষের কাছ থেকে কীই বা আশা করা যায়?

আজকাল মনে হয় ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় বই প্রকাশ করা জিপিএ ফাইভ পাওয়ার মত। জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্য অনেকেই যেমন জ্ঞান অর্জন করার দিকে মনযোগী হয় না, ঠিক একই ভাবে অনেক লেখকই বই প্রকাশ করেই আত্মতুষ্টিতে ভোগেন, ভাষার উন্নতির জন্য কিছুই করেন না। ভাষা বলতে আমি শুধু ব্যাকরণের কথা বলছি না, ভাষা বলতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, এই অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্য সব কিছুই বলছি। এটাই মনে হয় বাংলা ভাষার জন্য সবচেয়ে বিপদজনক বিষয়, আমাদের বর্তমান উন্নয়নের মত। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঠিকই এগুচ্ছি, কিন্তু শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতি – ইত্যাদি যে কারণে অর্থটা দরকার সেই সব দিকে আমরা সমানুপাতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছি। শুধু মাত্র ভাষার সার্বিক বিকাশ এই পতন রোধ করতে পারে।

ভাষা হোক শঙ্কামুক্ত, ভাষা হোক শান্তির

কুসংস্কার মুক্ত, ভাষা হোক প্রগতির

ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ভাষা হোক একতার

মিথ্যার মুখপাত্র নয়, ভাষা হোক সততার

ভাষা থেকে দূর হোক যা কিছু পাশবিক

ভাষা হোক মানুষের, ভাষা হোক মানবিক।

সবাইকে মহান একুশের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো