বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৯): রাশিয়ার কথা

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ভ্লাদিমির পুতিন পার্লামেন্টের দুই হাউজ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সামনে বার্ষিক বক্তব্য পেশ করলেন। কিছুদিন আগে মার্কিন সাংবাদিক কারলসনের সাথে ইন্টার্ভিউয়ের সময়ে তিনি রাশিয়ার ইতিহাস, পররাষ্ট্রনীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ এসব নিয়ে বিস্তারিত বলেন। তিনি নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেন। তারপরেও ২৯ তারিখের বক্তব্যের গুরুত্বও অপরিসীম। এটা ছিল তাঁর নির্বাচনী ইস্তেহার, আগামী ছয় বছর রাশিয়া কোন পথে যাবে সেই পরিকল্পনা। সোভিয়েত আমলে ছিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, এটা ছয় বছরের পরিকল্পনা। সেটা তিনি করেছেন বা করতে পেরেছেন আসন্ন নির্বাচনে বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই। কারণ এই মুহূর্তে এ দেশের জনগণের কাছে তাঁর কোন বিকল্প নেই। সেটা শুধু তাঁকে সমর্থনকারী রাজনৈতিক দলগুলো নয়, বিরোধী দলগুলোও বোঝে, বোঝে বহির্বিশ্বের লোকজনও।

স্বাভাবিক ভাবেই অনেকেই আশা করছিল যে তিনি এই বক্তব্যে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু বলবেন। বিশেষ করে কয়েক দিন আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ন্যাটোর সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কথা ঘোষণা করলে, আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ন্যাটোকে যুদ্ধ করতে হতে পারে বলে মতামত ব্যক্ত করলে আর জার্মানির সেনাপতিরা কীভাবে ক্রিমিয়ার সেতু ও রাশিয়ায় অন্যান্য এলাকা আক্রমণ করেও নিজেরা যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়তে পারে সেসব আলোচনা প্রকাশ পাওয়ার পরে অনেকেই আশা করছিল কড়া হুঁশিয়ারি। হুঁশিয়ারি ছিল, তবে তত কড়া নয় যতটা আশা করছিল মানুষ। তিনি বলেছেন রাশিয়ায় সেই সামরিক শক্তি আছে বিশ্বের যেকোনো দেশে আঘাত হানার ও সমুচিত শিক্ষা দেবার। এটা হুমকি নয়, সতর্কবাণী।

তাঁর বক্তব্যের বেশিরভাগ জুড়ে ছিল আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সাধারণ মানুষের কথা। কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায় সেই কথা। মনে হতে পারে যে এটা কোন পপুলিস্টিক বক্তব্য। কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ যে ততটা ভালো অবস্থায় নেই যতটা থাকা দরকার সেটা স্বীকার করার জন্য সাহসের দরকার। অধিকাংশ দেশের নেতারা যখন সাধারণ মানুষ ভালো আছে বলে মুখে ফেনা তুলে সেখানে এই সত্যতা স্বীকার করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে দেশ যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে সেটাও দেখার মত। অনেকেই বলতে পারে যুদ্ধ শুরু না করলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হত না আর সেক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি আরও সহজ হত। কিন্তু নিয়তির পরিহাস এই যে যখন রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দোস্তি ছিল বা অন্য কথায় বললে যখন রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের অনুগত ছিল তখন এরা দিন দিন শুধু ধ্বংসের পথেই এগিয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। আসলে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকেও ইউক্রেন করতে চেয়েছিল। তাই রাশিয়া যখনই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইত নিষেধাজ্ঞা আসতই। যুদ্ধ উপলক্ষ্য মাত্র। বরং যুদ্ধ দেশের উন্নয়নকে গতি দিয়েছে। যুদ্ধের জন্য নতুন উদ্যমে কাজ করছে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি। আর সেই ইন্ডাস্ট্রিকে সহযোগিতার জন্য গড়ে উঠছে অন্যান্য শিল্প। নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তৎকালীন রিফর্মারদের মূল লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিল্প ধ্বংস করা। এ কথা চুবাইস একাধিক বার বলেছে। সরকারি কলকারখানা জলের দামে বিক্রি করা হয়েছে আর সেসব কলকারখানার অধিকাংশই ভেঙে প্রায় সের দরে বিক্রি করা হয়েছে। এখন চলছে উল্টো প্রক্রিয়া। নব্বুইয়ের দশকে যদি সব কিছু ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেবার ট্রেন্ড ছিল, এখন উল্টো হচ্ছে। সরকারি মালিকানা বা অংশগ্রহণে গড়ে উঠছে বিভিন্ন শিল্প। সেদিক থেকে সমাজতান্ত্রিক না হলেও সমাজমুখী অর্থনীতি গড়ে ওঠার এক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মনে পড়ে আশির দশকের কথা। গরবাচভ যখন পেরেস্ত্রইকা ও গ্লাসনস্তের নীতি গ্রহণ করেন তখন অধিকাংশ মানুষের তর সইছিল না কবে আসবে সেই অর্থনৈতিক সাফল্য। ফলাফল আমরা জানি। একই ঘটনা ঘটেছে কয়েক বছর আগেও। অনেকেই চাইত দ্রুত সমাজতান্ত্রিক না হলেও অনেক বেশি সামাজিক নিরাপত্তা। এখন বোঝা যাচ্ছে সেটাও হচ্ছে। শুধু ধীরে ধীরে। কারণ শুধু ইচ্ছাটাই যথেষ্ট নয়, দরকার উপযুক্ত কর্মী বাহিনী। দ্রুত কিছু করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে।

ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা রাশিয়া মহাকাশে অস্ত্র মোতায়েন করছে বলে গুজব রটাচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিন সেটাকে গাঁজাখুরি গল্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এটা আসলে মহাকাশকে অস্ত্র প্রতিযোগিতার আঙিনা হিসেবে গড়ে তুলতে আমেরিকার চাল। আশির দশকে তারা সেই চাল চেলে সফল হয়েছিল। রাশিয়াকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামিয়ে সোভিয়েত অর্থনীতি ধ্বংস করতে সমর্থ হয়েছিল। এখন আর রাশিয়া সেই পথে যাবে না। তারা অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামবে না। তার মানে  এই নয় তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা, তাদের সার্বভৌমত্ব কম্প্রোমাইজ করবে। তারা ভিন্ন পথে এগুবে। আর এ জন্যেই তিনি স্মরণকালের ইতিহাসে অন্যতম ব্যায়বহুল সামাজিক পরিকল্পনার কথা বলেছেন। অনেক আগে থেকেই এখানে বাচ্চা জন্মদান করার জন্য মায়েদের আর্থিক সাহায্য দেয়া শুরু হয়েছে। সেটাকে বর্ধিত করা হচ্ছে। স্কুলে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ অনুদানের ঘোষণা এসেছে। বিশেষ করে যে সমস্ত শিক্ষক ছেলেমেয়েদের অভিভাবক হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে। এছাড়া গড়ে তোলা হবে নতুন এলিট শ্রেণি। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে এদেশে যে এলিট শ্রেণি গড়ে উঠেছিল তারা মূলত ছিল পশ্চিমা পন্থী। তারা নিজেদের সন্তানদের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলত। নিজেদের ভবিষ্যৎ পশ্চিমা বিশ্বের সাথেই জড়াত। আসলে রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষ নিজেদের ইউরোপিয়ান বলেই মনে করে এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সব ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মত হতে চায়। কিন্তু লিবারেলরা সেটা হতে চায় নিজেদের আইডেন্টিটি বিসর্জন দিয়ে। এটা অনেকটা শিক্ষা নয়, সার্টিফিকেট পাওয়ার মত। পক্ষান্তরে, দেশের বিরাট অংশ চায় নিজেদের আইডেন্টিটি বজায় রাখতে। ফলে বর্তমান এলিট শ্রেণির প্রতি বেশির ভাগ মানুষ নাখোশ। তাই সময় এসেছে যারা জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে, যারা দেশপ্রেমের পরীক্ষায় নিজেদের শক্তি, সাহস, মেধা দিয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে তাদের নিয়ে নতুন এলিট শ্রেণি গড়ে তোলার। এটা শুধু যোদ্ধাদের ক্ষেত্রেই সত্য নয়। কারণ রণক্ষেত্রে লড়াই যাতে চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য লাখ লাখ মানুষ দিন রাত পরিশ্রম করছে কলে কারখানায়, পরিশ্রম করছে মাঠে ঘাঁটে। এরাই দেশকে শস্য উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারিতে নিয়ে গেছে, এরাই বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করছে, এরাই নির্মাণ করছে নতুন বিমান। এক কথায় এরাই দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজাচ্ছে। তাই এসব লোকজন যাতে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করে দেশ চালনা করতে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে সেজন্যে বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আবার চাইলে এরা যাতে নিজেদের অভিজ্ঞতা তরুণ সমাজকে দিতে পারে সে ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৮):ভাষা-বিজন সাহা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ দেশ দ্রুত গতিতে শিল্প ও শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজায়। রনাঙ্গনের ভয়াবহতা থেকে যারা প্রাণ নিয়ে ফিরে আসে তারা অসামান্য পরিশ্রম করে দেশকে নতুন ভাবে গড়ে তোলে। ইউক্রেন যুদ্ধ দিকনির্দেশনা হীন রুশ (এথনিক্যাল নয়, রাশিয়ার সমস্ত জাতির মানুষ) জাতিকে আবার একত্রিত করেছে। এই ঐক্যকে ধরে রাখা, সেটার উপর ভিত্তি করে নতুন দেশ গড়ে তোলাই এখন মূল লক্ষ্য। মনে পড়ে একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের কথা। তখনও সারা দেশের মানুষ নতুন উদ্যমে জীবন গড়তে শুরু করেছিল। নতুন বিশ্বাসে নতুন দেশ গড়তে শুরু করেছিল। যুদ্ধের আগুনে মানুষ শুধু প্রাণ হারায় না, যারা বেঁচে থাকে তারা সেই আগুনে শুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে নেতাদের উপরে নির্ভর করে সেই শক্তিকে তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন। কারণ যুদ্ধ মানেই শক্তির খেলা। সে আঘাত হানবেই। আসল কথা হল সেই শক্তিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো।

একটা সময় ছিল যখন এদেশের মানুষ হীনমন্যতায় ভুগত। বিশেষ করে আশির দশকের শেষে ও সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ায়। দেশের বাইরে যেতে পারে না, ফ্যাশনেবল জামাকাপড় তৈরি করতে পারে না, ইংরেজি বলতে পারে না – এসবই তাদের জন্য এক ধরণের মানসিক পীড়া ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কাটছে। এখন তারা গর্বের সাথে বলছে আমি রুশ, আমি রাশিয়ান। সবে মাত্র শেষ হওয়া বিশ্ব ছাত্র ও যুব সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, আমাদের কাউকে কিছু দেখাতে চাই না, কারো কাছে কিছু প্রমাণ করতে চাই না। আমাদের সব আছে। আমরা চাই নিজেদের স্বার্থে, নিজের দেশের মানুষের স্বার্থে সেটা ব্যবহার করতে। আমার বিশ্বাস সেটা করার মত সাহসী, কর্মঠ ও প্রতিভাবান মানুষের অভাব এ দেশে নেই। আমরা আগেও সব বাঁধা বিপত্তি জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছি, এখনও পারব।

যদি পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান নেতাদের বক্তব্যের সাথে ভ্লাদিমির পুতিনের বক্ত্যব্যের তুলনা করা যায়, তাহলে এটাই দেখব – সেখানে পরাজিত নেতারা নিজেদের কুকর্মকে ন্যায্যতা দেবার জন্য হয় রাশিয়াকে দোষারোপ করছে না হয় হুমকি দিচ্ছে, পক্ষান্তরে পুতিন কাউকে দোষারোপ না করে নিজেদের দেশকে অন্তত আগামী ছয় বছর কীভাবে গড়ে তোলা যায় সেই কথা শোনাচ্ছেন। এটা সত্যকার অর্থেই বিজয়ীর ভাষণ। এখনও পর্যন্ত এরা বিজয়ের পথেই যাচ্ছে। বাকিটা শুধু ভবিষ্যৎ বলতে পারবে।

সবাইকে, বিশেষ করে আমার পাঠিকাদের জানাই আন্তর্জাতিক নারী দিসবের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন!

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো