চলমান সংবাদ

১৩ নেতাকে হত্যার অভিযোগ বিএনপির, কারা কর্তৃপক্ষের অস্বীকার

দেশের বিভিন্ন কারগারে আটক বিএনপি নেতাকর্মীদের কয়েকজন নির্যাতনে মারা গেছেন বলে অভিযোগ দলটির

গত তিন মাসে কারাগারে নির্যাতনে বিএনপির ১৩ নেতার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন রুহুল কবির রিজভী৷ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মনে করেন, প্রত্যেকটি মৃত্যুই ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’৷

তবে কারা উপ মহাপরির্দক মো. মইন উদ্দিন ভুঁইয়া বলেছেন, ‘‘এ ধরনের কোনো অভিযোগ তারা পাননি এবং এই অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। রিজভী সাহেবরা রাজনৈতিক কারণে এসব কথা বলছেন।”

শুক্রবার রাজধানীর নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রিজভী রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি মহিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম কারাগারে নির্যাতনে মারা গেছেন বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘‘কারা হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের শিকার বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের কারো না কারোর মৃত্যুর সংবাদ আসছে প্রায়শ। কারা সেলগুলো একেকটি শ্বাসরুদ্ধকর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে। প্রতিটি কারাগারের ভেতরে কারাবিধির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে বন্দি নেতা-কর্মীদের ওপর চালানো হচ্ছে বিভৎস নিপীড়ন।’’’

বিকেলে এ প্রসঙ্গে রুহুল কবির রিজভী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই ১৩ জন তো মাত্র গত তিন মাসে কারাগারে নির্যাতনে মারা গেছে। এর আগেও আরো মৃত্যূর ঘটনা আছে। তার মধ্যে রাজশাহী ও ঢাকাসহ আরো কয়েক জায়গায় কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা আছে। সবার তালিকা আমাদের কাছে আছে।”

এরপর তিনি তার দপ্তরের মাধ্যমে ডয়চে ভেলেকে একটি তালিকা পাঠান। তাতে মোট ৩০ জনের নাম রয়েছে। তবে সেই তালিকায় গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত কারাগারে নির্যাতনে নিহতের বাইরে হামলা, কারাগারে বিনা চিকিৎসা এবং কারা চিকিৎসকের অবহেলা, পালাতে গিয়ে, ভয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি আরো কয়েকটি কারণে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।

বিএনপির সেই তালিকায় মৃত্যুর কারণ এবং সময়  উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে দাবি করা হয়, তাদের বেশ কয়েকজন আটকের পর এবং কারাগারে মারা গেছেন। তারা হলেন: সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কয়লা ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি আব্দুস সাত্তার, ঢাকার দোহার উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি মো. হারুন মেম্বার, খুলনা মহানগর শাখা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও যুবদল নেতা মো. কামাল হোসেন, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. জাকির হোসেন, মুগদা থানা শ্রমিকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান, গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দূর্গাপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মো. শফিউদ্দিন মাষ্টার, নওগাঁ জেলার পত্মীতলা উপজেলার নজিরপুর পৌরসভার ২ নাম্বার ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিবুল মন্ডল, বিএনপি মিডিয়া সেলের ডিজিটাল বিভাগের প্রধান মাহবুব মানিক, রাশজাহী জেলার ৬ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ওয়ারী থানার ৩৯ নাম্বার ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল, চট্টগ্রাম মহানগরের চাঁদগাও থানার ৫ নাম্বার মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি গোলাপুর রহমান (গোলাপ কন্টাক্টর), ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. স্বপন। তবে এই তালিকা ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

কারা উপ মহাপরির্দক মো. মইন উদ্দিন ভুঁইয়ার কাছে এই তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে কে বিএনপি কে আওয়ামী লীগ সেটা বিবেচনার বিষয় নয়। আমরা বন্দিকে বন্দি হিসেবে দেখি। কারাগারে যে আজরাইল আসবে না এমনতো কোনো কথা নেই। মাটির নিচেও আজরাইল যাবে। আমাদের কারাগারগুলোতে ৮০-৯০ হাজার বন্দি থাকে। প্রতিদিন ২০-২৫ জন মারা যান। তাদের স্বাভাবিক বা কোনো রোগে মৃত্যু হয়। আমরা আলাদাভাবে কারুর খোঁজ রাখি না।”

তার কথা, ‘‘বিএনপি যে অভিযোগ করছে তার কোনো লিখিত অভিযোগ আমাদের কাছে দেয় নাই। তাদের অভিযোগ সঠিক নয়। তারা রাজনৈতিক কারণে এসব বলছে। তারা সেটা বলতেই পারে।”

গঙ্গাচড়ায় ইউনিয়ন বিএনপি নেতার মৃত্যু
রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, বৃহস্পতিবার রংপুর কারাগারে বন্দি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি মহিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলামকে নির্যাতন করে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছে কারা হেফাজতে। সুস্থ সবল মনোয়ারকে পুলিশ দিনের বেলায় বাসা থেকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। এরপর সেইদিন আদালতে চালান না দিয়ে পরের দিন রাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তার সমস্ত শরীরে, পায়ে, পিঠে ও মাথায় আঘাতের গভীর চিহ্ন দেখা গেছে।”

মনোয়ারুলের ভাই হারুন অর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তাকে গত মাসের ১২ তারিখে পুলিশ আটক করে। ১৩ তারিখে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ১৪ তারিখে সে জেলখানায় অসুস্থ বলে খবর পাই। তাকে কারাগার থেকে তখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চার-পঁচদিন রাখার পর আবার কারাগারে নেয়া হয়। এরপর বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৫টার সময় আমাদের জানানো হয়, সে অসুস্থ। সকাল সাতটার দিকে তাকে রংপুর হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে সে মারা যায়। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তার পিঠে , কোমরে কালো দাগ ছিল। পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল।”

তিনি মনে করেন, “বিএনপি করার কারণেই তাকে আটক করে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনে তিনি মারা গেছেন।’’ নিহতের ভাই আরো বলেন, ‘‘একটি নারী নির্যাতনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ওই নারীকে আমরা কেউ চিনি না। অভিযোগ করা হচ্ছে আমার ভাই নাকি ওই নারীর ওড়না ধরে টান দিয়েছিলেন।”
মনোয়ারুল অবিবাহিত ছিলেন।তারা তিন ভাই এক বোন।

রংপুর কারাগারে জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক তাকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘তাকে কারাগারে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। তাকে রেসপিরেটরি ডিসট্রেসের কারণে ২১ থেকে ২৪ জানুয়ারি আমরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছি। এরপরর তাকে কারাগারে নিয়ে আসি। বৃহস্পতিবার ভোরে আবার সে অসুস্থ হয়ে পড়লে রংপুর হাসপাতালে নিলে সেখানে সে মারা যায়। ”

তিনি এক প্রশ্নের জবাবে দাবি করেন, ‘‘তার সুরতহাল রিাপোর্ট একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে বাকিটা জানা যাবে।”

আর গঙ্গাচড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দুলাল হোসেন বলেন, ‘‘আমরা তাকে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলায় একমাস আগে গ্রেপ্তার করি। তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়নি। কোনো নির্যাতনও করা হয়নি। গ্রেপ্তারের পর দিন তাকে আমরা নিয়ম মতো আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেই।”

রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘‘এই সরকার পরিকল্পিতভাবে কারাগারে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছে। আমরা চেষ্টা করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। মামলা করতে পারছি না। আমরা মানবাধিকার কর্মীদের মাধ্যমে এটা বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছি। আমাদের আন্তর্জাতিক কমিটি এটা নিয়ে কাজ করছে। প্রয়োজনে আমরা জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরবো।”

তার কথা, “আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবো। এর মাধ্যমেই এক সময় এই পরিস্থিতির অবসান ঘটবে।”

এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, “তিন মাসে বিএনপির ১৩ জন নেতা যে কারা হেফাজতে মারা গেছে এটা কোনো পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমে এসেছে? রিজভী এটা কোথায় পেয়েছেন? তার কথা ভিত্তিহীন। তার কাজই হলো মিথ্যা বলা। অপপ্রচার করা।

# হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে, ঢাকা