বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১০৮): ক্ষমতা ও দায়িত্ব

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

পরের সপ্তায় আমি আর সেভা বেড়াতে গেলাম লুঝনিকির দিকে। এখন অনেক বদলে গেছে এই এলাকা। ভালোর দিকে। সোভিয়েত আমলে বিভিন্ন খেলার মাঠ আর ঘোরাফেরার জায়গা ছিল। আমরা বন্ধুরা মিলে অনেক আসতাম। ১৯৮৬ সালের হেমন্তে এখানে একটা ছবি তুলেছিলাম। তুলেছিলাম অনেক কিন্তু কিছু কিছু ছবি মনে গেঁথে থাকে। শরতের নীলাকাশে সাদা মেঘ, নীচে মস্কো নদীর নীল জলে মেঘের সাঁতারের ছবি। পরে আর কখনও ঐ জায়গা খুঁজে পাইনি। এখনও গেলে দেখি আছে কিনা, তবে সব এত বদলে গেছে যে খোঁজা বৃথা। ওখান থেকে চলে যাওয়া যায় নদীর অন্য তীরে – ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অথবা ক্যাবল কারে ১০০ রুবলের বিনিময়ে। তবে আমরা সেদিকে না গিয়ে নদীর তীর ধরে হাঁটতে শুরু করলাম গল্প করতে করতে।

আচ্ছা তুমি যখন সমাজতন্ত্রকে ধারণার কথা বল তখন আমি সেটা বুঝি, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা ধারণা সেটা কি কথা? সেটা তো একটা দেশ, যা ছিল, এখন নেই। তাছাড়া দেশ তো আর ধারণা হতে পারে না।

কেন পারবে না? দেশ বিভিন্ন ধরণের হয়। হয় রাজ্য যেখানে রাজা বাদশা থাকে, হয় প্রজাতন্ত্র, হয় গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক দেশ। উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু – এসবও তো ভূখণ্ড, কিন্তু দেশ নয়। দেশের জন্য ভূখণ্ড দরকার, দরকার মানুষ আর দরকার শাসন ব্যবস্থা বা সংবিধান। সংবিধান দেশের চরিত্র নির্ধারণ করে, এটা শুধুই আইডিয়া, সম্পূর্ণ মানুষের হাতে তৈরি। তাই দেশ হচ্ছে কোন ধারণা বা আইডিয়ার বাস্তব রূপ। আর এখানেই আমাদের সমস্যা। আমরা প্রায়ই ধারণার মত কোন বিমূর্ত কিছুকে মূর্তিমান কিছুর সাথে গুলিয়ে ফেলি। যেমন আমাদের অনেকের ধারণা আমেরিকা মানেই গণতন্ত্র বা গণতন্ত্র আমেরিকার সিনোনেম। কিন্তু বর্তমান আমেরিকার দিকে তাকালে আমরা কি সেটা বলতে পারব? অথবা ইউরোপের দেশগুলোর দিকে তাকালে? তারা গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেছে, করছে নিজেদের স্বার্থে, দেশে দেশে নিজেদের সমস্ত অন্যায়কে জায়েজ করার জন্য। তাদের যে উন্নতি সেটা মূলত এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এমনকি অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের রক্তের বিনিময়ে। তারা শুধু এসব দেশ শোষণই করে নাই, তারা এসব দেশের প্রাচীন সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। এটা ঠিক যে তাদের হাত ধরে বিজ্ঞান এসেছে। আজ যে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি সেটা তাদের হাত ধরেই। কিন্তু সেসব দেশের শাসক সমাজ আসলে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছে নিজেদের শাসন ও শোষণ চিরস্থায়ী করতে। বিজ্ঞান – এটা অবজেক্টিভ রিয়ালিটি। সেটাকে কেউ আটকে রাখতে পারত না, হয়তো একটু বেশি সময় নিত। তাই শুধু বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে তাদের অন্যায়কে, শত সহস্র মৃত্যুকে কিছুতেই ন্যায্যতা দেয়া যায় না।

তাই যদি হয় তাহলে এর আগে বিজ্ঞান তেমন অগ্রসর হয়নি কেন?

হয়নি সেটা ঠিক নয়। আসলে বিজ্ঞান এসেছে মানুষের প্রয়োজনে। একটা বাচ্চা কিন্তু জন্ম থেকেই হাঁটতে শুরু করে না, সেটার দরকারও নেই। একই ভাবে আমরা প্রথম শ্রেণি থেকেই কাউকে জটিল অংক শিখতে বলি না। জ্ঞানের সাথে সাথে মানুষের মনে নতুন নতুন প্রশ্ন জাগে আর সেটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে নতুন নতুন আবিস্কার করে। এই প্রক্রিয়া সেই আদি কাল থেকেই বিদ্যমান ছিল। এমনকি প্রস্তর যুগ থেকে ব্রোঞ্জ বা লৌহ যুগে উত্তরণ ছিল বিশাল পদক্ষেপ। আজকাল আমাদের কাছে খুব হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু চাকার আবিস্কার ছিল যুগান্তকারী। মাত্র পঁচিশ কি ত্রিশ বছর আগেও প্রযুক্তি এত দ্রুত বদলায়নি। সে সময় কাউকে রাস্তায় একা একা কথা বলতে দেখলে অধিকাংশ মানুষ তাকে পাগল ভাবত। কারণ মোবাইল ফোন বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এর আগে হাজার হাজার বছর মানুষ একটু একটু করে প্রকৃতির রহস্য উদ্ধার করেছে। আমি এক সময় রিলে ছবি তুলতাম। ছবি তোলা শেষ হলে অন্ধকারে সেই ফিল্ম থেকে নেগেটিভ বানাতাম আর পরে রাতে অন্ধকার ঘরে ছবি প্রিন্ট করতাম। শুধু তারপরেই ছবি কেমন হল সেটা কমবেশি বোঝা যেত। এখন ছবি তুলেই দেখতে পারি ভালো না মন্দ। এর পেছনে দুটো জিনিস কাজ করেছে – বিজ্ঞানের অগ্রগতি আর ইনভেস্টমেন্ট। পুঁজিবাদীরা এতে মুনাফার গন্ধ না পেলে ইনভেস্ট করত না, তবে তার মানে এই নয় যে এসব আবিস্কার হত না। অনেক ধারণা অনেক আগে থেকেই জন্ম নিয়েছিল, শুধু তার পেছনে ইনভেস্ট ছিল না। রকেট আবিস্কারের অনেক আগেই এর উপর অনেক তাত্ত্বিক কাজ ছিল। যদি  সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা না থাকত, তাহলে হয়তো আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হত। সেক্ষেত্রে লাভ নয় দুই সিস্টেমের প্রতিযোগিতা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। এই যে এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে – সেটা ভবিষ্যৎ যুদ্ধকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। ড্রোনের এমন ব্যবহারের কথা আগে কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। তাই একেক সময় একেকটা জিনিস উন্নয়নের ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে। আজ তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোর অনেক মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় ভালো সুযোগ পায়, সেখানে তারা সেসব দেশ গড়ে, একই সাথে নিজেদের জীবন গড়ে তোলে। কিন্তু এসব করে বা করতে দেয় শুধু একটা কারণে – এতে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো লাভবান হয়। এরা তৃতীয় বিশ্বের দেশের বা সেসব দেশের মানুষের কথা ভেবে মানবিকতা থেকে এসব করে না। যখনই কোন কিছু তাদের স্বার্থ বিরোধী হয়, ওরা তখন বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন ধরণের স্যাঙ্কশন আরোপ করে অন্য দেশের উন্নয়নকে দাবিয়ে রাখে, রাখতে চায়। তাই যাই করি না কেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে যে পুঁজিবাদ নিজের লাভ ছাড়া কখনই কিছু করে না, ফলে তাদের কাছ থেকে সাহায্য নেবার আগে ভেবে দেখতে হবে এই সাহায্য দিনের শেষে আমাদের কতটুকু ক্ষতি করবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা(১০৭): সমাজতন্ত্রের গল্প -বিজন সাহা

কেন?

আসলে সব আইডিয়ায়ই শেষ পর্যন্ত ধর্মের রূপ ধারণ করে। এই দেখ ফুটবল – একান্তই খেলা। কিন্তু কোন দলের ফ্যানেরা প্রতিপক্ষের ফ্যানদের খুন করতে দ্বিধা পর্যন্ত করে না। কেন? অন্ধবিশ্বাস। আসলে সারা বিশ্ব এভাবেই চলে বা চালানো হয়। দেখিস না মানুষ আইফোন কেনার জন্য কীভাবে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে। অনেকের জন্য আইফোন ধর্মীয় কোন উপাদানের মত। এটা শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয় ঘটে না। বছর কুড়ি আগে শত শত পদার্থবিদ যারা স্ট্রিং থিওরির উপর কাজ করত তারা প্রফেসর উইট্টেনের পেপারের জন্য বসে থাকত যেন কোন স্বর্গীয় বাণী আসবে। না, আমি উইট্টেনের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, আমি বলছে এমনকি স্ট্রিং থিওরির উপর কাজ করছে এরকম প্রচণ্ড মেধাবী গবেষকরাও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতেন যেন অহি নাজিল হবে এ ধরণের মানসিকতা নিয়ে। আর এর কারণ বর্তমানে সবাই বুঝে গেছে প্রচার মাধ্যমের শক্তি। প্রচার করার মূল উদ্দেশ্য বিক্রি করা। তা সে কোন পণ্য হোক আর যাই হোক। বাজার অর্থনীতিতে সবই পণ্য – হোক সে পোশাক আশাক, হোক খাদ্য বা ভোগ্য পণ্য অথবা কোন আইডিয়া বা আইডোলজি। বিক্রি বা কেনাবেচা – এটাই বর্তমান দুনিয়ার চালিকা শক্তি। আর বিক্রি করার জন্য দরকার মানুষকে কনভিন্স করার। সেটা করতে গিয়ে মিথ্যে না বললেও পণ্যের গুনাবলী এমন ভাবে বর্ণনা করতে হবে যেন এমনকি মানুষ অপ্রয়জনীয় পণ্য কিনতেও প্রলোভিত হয়। প্রলোভন – এটাই তো সব কিছুর চালিকা শক্তি। এই প্রলোভন ছিল বলেই আদম আর হাওয়া আপেল খেয়েছিলেন। লোভ মানব জাতির জন্মের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

তাহলে?

তাহলে আর কি? ভালমন্দ মিলিয়েই মানুষ এটা আমাদের গ্রহণ করতে হবে আর এর অনুপাতটা এমন এক পর্যায়ে রাখতে হবে যাতে তা সমাজের জন্য ধ্বংস ডেকে না আনে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেছিল শ্রমিকদের পক্ষে, পুঁজিবাদী বিশ্বে সেটা নষ্ট হয় পুঁজিপতিদের পক্ষে। অথচ শ্রম আর পুঁজি দুটো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একে অন্যকে ছাড়া চলতে পারে না। তাই দুটোকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রাষ্ট্র যদি এই দুই পক্ষের মধ্যে ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারে যাতে পুঁজিপতি আগ্রহী হয় পুঁজি ইনভেস্ট করতে আর শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে, অন্যদিকে শ্রমিকরা আগ্রহী হয় সততার সাথে নিজ নিজ কাজ করতে তাহলে সমাজের উন্নতি না হয়ে পারে না। সেটা কি তন্ত্র হবে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা সবার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা বোঝা আর সেটা বুঝে পরস্পরের ভালোর জন্য কাজ করা।  যেমন ধর ছাত্র শিক্ষক – পরীক্ষার হলে তারা পরস্পরের বিরোধী পক্ষ, কিন্তু একে অন্যকে ছাড়া পারে কি? অথবা দুই ফুটবল দল – খেলার মাঠে পরস্পর বিরোধী, কিন্তু যদি প্রতিপক্ষ না থাকে খেলা হবে কি করে? প্রতিটি মানুষের নিজের স্বার্থ আছে আবার যেহেতু সে একা থাকতে পারে না, তাই অন্যদের স্বার্থের কথাও তাকে মাথায় রাখতে হবে। আমরা যদি এসব মাথায় রেখে কাজ করি, শুধুমাত্র তখনই উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব – কি নামে বা কোন দলের হাত ধরে সেটা আসবে তা বড় কথা নয়। সবাই ক্ষমতায় যেতে চায় কিন্তু কেউই দায়িত্ব নিতে চায় না। কারণ ক্ষমতা দেখানো যায় আর দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমার বিশ্বাস এই যে আমেরিকা যে পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য ঘাঁটি তৈরি করে সেসব দেশে নিজের অনুগত সরকার বসাচ্ছে, এসব দেশ বা দেশের জনগণ চাইলেও আমেরিকা তাদের কোনদিনই নিজের অঙ্গরাজ্য করবে না, কারণ এখন আমেরিকা তাদের ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে, তখন আমেরিকার এসব দেশের সব দায়িত্ব নিতে হবে। হয়তো এখানেই পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের আরও একটা পার্থক্য। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে শুধু সমর্থন করেনি, সেসব দেশের সাধারণ মানুষের দায়িত্ব নিয়েছে অনেকাংশে। সেসব দেশে ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়েছে, সেসব দেশের জন্য শিক্ষিত, দক্ষ কারিগর তৈরি করেছে। আমেরিকা যদি সত্যি সত্যি অন্য সব দেশের জন্য এভাবে কাজ করত, পৃথিবীতে বৈষম্য অনেক কমে যেত। এসব অসম্ভব কিছু নয়, দরকার সদিচ্ছার। আমার বিশ্বাস নতুন নামে নতুন স্থানে তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন জন্ম নিতেই পারে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো