বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা(১০৭): সমাজতন্ত্রের গল্প

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই সেভা জিজ্ঞেস করল
কখন বেরুবে?
১১ টার দিকে।
আমি যাব তোমার সাথে।
চল।
পায়ের ব্যথার কারণে গতবার বেশিক্ষণ ঘুরতে পারিনি ওর সাথে। তাই ভাবলাম আজ সেটা পুষিয়ে নেব।
আমি যখন বেরুবো ভাবছি, সেভা তখনও রেডি হয়নি।

তুমি একটু অপেক্ষা করবে?
কতক্ষণ।
মিনিট পনেরো।
আচ্ছা।

আসলে আজ আমার তেমন তাড়া নেই। এসেছি একটা সেমিনারে। এক সময় সোমবার আমাদের ডিপার্টমেন্টে সেমিনার হত। আমাদের শিক্ষকগণ আর পিএইচডি স্টুডেন্টরা তাদের কাজের রিপোর্ট করতেন। এছাড়া শুক্রবার ছিল মস্কোর সেমিনার। বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে বিজ্ঞানীরা আসতেন। এখন আর সেসব হয় না। মূলত লোকের অভাবে। সেই সময় ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক ছিলেন দশ জনের বেশি, এখন আমরা তিন জন আর দুই সহকারী, যারা এখনও পিএইচডি স্টুডেন্ট। তবুও আগে অনেকেরই ক্লাস থাকত সোমবার, দেখা হত। এখন ঐদিন আমি ছাড়া আর কারও ক্লাস নেই, তাই আমি একাই আসি। অথচ ডিপার্টমেন্ট আমার জন্য বাড়ির চেয়েও বেশি – মস্কোয় সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তাই সেমিনারের আয়োজন করার কথা ভাবলাম। দেখলাম সবাই আগ্রহী। আসলে সবাই নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে কথা বলতে চান, অন্যদের কাজকর্মের কথা শুনতে চান। সেখান থেকেই এই সেমিনারের আয়োজন। আজ রিপোর্ট করবেন প্রফেসর বেলিনসন। তিনি অসুস্থতার কারণে এখন আর আসেন না, তারপরেও নিজে থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অংশ নিতে। তাই দুবনা থেকে আসা। যেহেতু এসেছি তাই আমার পিএইচডি ছাত্রের সঙ্গে একটু কাজ করব বলে ওকে ডেকেছি। তবে ভাবলাম একটু দেরি হলেও সমস্যা নেই। দরকারে সেমিনারের পরে ওর সাথে কথা বলব।

আমি আর সেভা বেরুলাম। ও যাবে নিস্কুচনি সাদে, আমি ভার্সিটি। নিস্কুচনি সাদ বিখ্যাত গোরকি পার্কের পাশে, বলা যেতে পারে এর অংশ। মিনিট ৪৫ লাগবে স্পোরটিভনায়া থেকে। গল্প করতে করতে যাচ্ছি। ও এদিকে প্রায়ই হাঁটতে আসে। এক সময় এলাম মস্কো নদীর উপর যে পায়ে চলা ব্রীজ আছে সেখানে। গতকাল যখন মনিকার সাথে এখানে এসেছিলাম নদীর অন্য তীর ছিল লোকে লোকারণ্য। গ্রীষ্মে ছুটির দিনে সেখানে বিভিন্ন রকম কনসার্ট, নাচগানের ব্যবস্থা থাকে। আমাদের ছাত্র জীবনে এই ব্রীজটা ছিল না। গল্পে গল্পে ওঁকে জানালাম এখানে, একটু দূরে ১৯৮৫ সালে আমরা গান গেয়েছিলাম যুব উৎসবে আর সেটা সোভিয়েত টিভিতে সম্প্রচার করেছিল। কেভিএন-এর পরিচালক মাস্লিউকভ সেটা পরিচালনা করেছিলেন।

তাই? তুমি কত সালে মস্কো এসেছ?
১৯৮৩ সালে। আমি তকে বলিনি?
আমি তো ভাবলাম তুমি ১৯৯০ বা ৯১ সালে এসেছ।
না। ১৯৯১ সালে মার সাথে আমার পরিচয়।
ও।

ও মনে হয় ভেবেছিল মায়ের সাথে আলাপ হবার আগে এদেশে আমার অস্তিত্ব ছিল না। মনে পড়ল আমার নিজের কথা। একদিন কল্যাণ দা কথায় কথায় বলল দাদুর কোলে বসে ও খেতে পছন্দ করত। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমি বাড়ির ছোট। দাদু, দিদিমা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা কাউকে দেখিনি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ওরা কেউ তাঁদের দেখেনি। সেভা কি সেভাবেই ভেবেছিল?

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙা তাহলে তুমি দেখেছ। তোমার মনের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল? এখন কি মনে কর সেই সময়, সেই ভাঙ্গন সম্পর্কে?
দেখ সব কিছুর ভালো ও মন্দ অনেক দিক থাকে। আমরা সব সময় ভালো আশা করি আর মন্দ কিছু দেখলে সেটার প্রতিবাদ করি, বদলাতে চাই। কিন্তু বদলাতে গেলে যে সবই বদলে যাবে, মন্দের পাশাপাশি ভালো সবকিছুও চলে যাবে সেটা প্রায়ই বুঝি না। তখন অনেক কিছু আমার ভালো লাগত না, তবে প্রচুর ভালো জিনিস ছিল। মানুষ অন্য রকম ছিল। এখন সেই ভালো দিকগুলোর অভাব খুব করে বুঝি।

আমার কিন্তু মনে হয় পুঁজিবাদ ভালো।
এটা তুই সমাজতন্ত্র দেখিসনি বলে ভাবছিস। তাছাড়া পুঁজিবাদেও অনেক কিছু ভালো আছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা অনেক বেশি। কিন্তু বৈষম্য অনেক। সোভিয়েত আমলে ধনী গরীব থাকলেও সেটা ছিল ভিন্ন ধরণের। প্রায় সব মানুষই চাইলে তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারত। আসলে তখন শিক্ষা ছিল সবার জন্য বাধ্যতামুলক। প্রায় প্রত্যেকের, তা সে যে পরিবার থেকেই আসুক না কেন, সুযোগ ছিল নিজের প্রতিভা বিকাশ করার। সমস্যা ছিল পরে। যখন মানুষ কাজে ঢুকত তখন যে ভালো কাজ করে আর যে খারাপ কাজ করে সবাই প্রায় একই বেতন পেত। আর এটা ছিল বৈষম্য।
মানে?
দেখ, মানুষকে যদি কাজ কাজের উপযুক্ত বেতন দেয়া না হয় সেটাও বৈষম্য, কারণ বেতনের সমতা আনতে গিয়ে মেধার প্রতি অন্যায় করা হয়। আমরা চাই বা না চাই লোভ, লালসা, ঈর্ষা এসব আমাদের মজ্জাগত। আমরা সবাই চাই অন্যের চেয়ে ভালো করতে। এই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবই সভ্যতাকে সামনে নিয়ে যায়। স্কুলে বা ছাত্রজীবনে ভালো পড়াশুনা করলে ভালো নম্বর পাওয়া যায়। এটা আমাদের পড়াশুনা করতে আগ্রহী করে তোলে। আমি দেশে স্কুলে সব সময় ফার্স্ট বয় ছিলাম। এখানে যখন দেখলাম যারা ভালো পড়াশুনা করে তারা সবাই পাঁচ পাচ্ছে, প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগত। কেননা বুঝতাম যারা পাঁচ পাচ্ছে তাদের মধ্যেও উনিশ বিশ আছে, কিন্তু রেজাল্ট সেটা দেখাচ্ছে না। তাই আমার ধারণা ক্লাসের ভালো ছেলেরা যখন চাকরি জীবনে অপেক্ষাকৃত খারাপ ছাত্রদের মত একই বেতন পেত বা কখনও কখনও ছাত্রজীবনে এত কষ্ট করে পড়ার জন্য পরিহাসের শিকার হত, এটা তাদের ভালো লাগত না। এমন কি কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হত।

সেটা ঠিক বলেছ।
শোন, আমরা প্রায় চলে এসেছি। তোর যদি জানতে ইচ্ছে করে পরে আমরা আরও কথা বলব। তুই বাসায় থাকবি নাকি কোথাও যাবি?
এখনও জানি না। তাই বরং এখনই বিদায় নেই। দেখা হলে আবার না হয় হ্যান্ডসেক করব।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১০৮): ক্ষমতা ও দায়িত্ব-বিজন সাহা

আমরা সাধারণত প্রথম যখন দেখা হয় আর যখন দুবনা চলে যাই তখন হ্যান্ডশেক করি। যদি আবার দেখা হবার সম্ভাবনা থাকে তবে “পাকা” বা দেখা হবে বলে সাময়িক বিদায় নেই।

এর আগে সেভা কখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে জানতে চায়নি। কয়েকদিন পরে সেভা আবার সমাজতন্ত্রের বা বলা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কথায় চলে এলো। আমার কেন যেন মনে হয় অধিকাংশ মানুষের ধারণা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সাথেই সমাজতন্ত্র মরে গেছে। যদিও কিউবা, চীন এরকম বেশ কিছু দেশ এখনও সমাজতন্ত্রের মন্ত্র মেনেই চলছে তবুও সোভিয়েত ইউনিয়ন এখানে ছিল একেবারেই অনন্য।

তোমার কি মনে হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতন্ত্র কি আর কখনই আসবে না?
দেখ, আমার মনে হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন কোন দেশ নয়, এটা একটা ধারণা। আগে জানতাম না, তবে ইদানীং বিভিন্ন কথা শুনে সেটাই মনে হয়। যেমন আগে জানতাম না যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটা পাবলিক কর্পোরেশনের মত। যে কেউ এর সদস্য হতে পারত বা এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে পারত। লেনিন সেভাবেই ভেবেছিলেন। তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন, তাই পরবর্তীতে এটা অন্য যেকোনো দশটা দেশের মত হয়ে যায়। কিন্তু লেনিনের সেই ধারণা ফর্মালি থেকেই যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ছিল লেনিনের অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম সফল করার জন্য। ফলে তিনি সেদিকেই বেশি জোর দেন। নতুন অর্থনৈতিক পলিসি সেটার কথাই বলে। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনীতি সামনে চলে আসে। মুখ্য হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা। আর একারণেই মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেশ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এটা অনেকটা আমাদের জীবনের মত। মানুষ জন্ম নেয় বিভিন্ন ধারণাকে বাস্তবায়ন করার জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাড়ি বাড়ি, পোশাক আশাক এসবের মধ্যেই সে সাফল্য খোঁজে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি দেশ না হয়, যদি শুধুই ধারণা হয় তবে কি এর আর ফিরে আসার কোন পথ নেই?

যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু দেশ হত তাহলে তার আর ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু ধারণা বলেই সে ফিরে আসতে পারে। ধারণা বলেই কখনও কোথাও আবার বাস্তবায়িত হতে পারে। তবে সেটা যে এই রাশিয়াতেই হতে হবে তার কিন্তু কোন মানে নেই। এই দেখ টলেমির আগেও অনেকেই সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কথা বলেছে, কিন্তু টমেলির ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের তত্ত্বই জিতে গেছে। আবার দেড় হাজার বছর পরে গ্যালিলিও সহ অনেকেই প্রমাণ করেছেন উল্টোটা। ধারণা মরে না। সঠিক সময়ে, সঠিক পরিবেশে ঠিক প্রকাশ পায়।

কিন্তু পুঁজিবাদ যেভাবে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সমাজতন্ত্রের ফেরার কোন সম্ভাবনা আছে বলেই মনে হয় না।

মার্ক্স কিন্তু কখনও পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের কথা কল্পনাই করেননি। আর এই মার্ক্সই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। লেনিন পুঁজিবাদকে বাইপাস করে এদেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেন। তাই এমনকি মার্ক্সের মতে পুঁজিবাদ থেকেই সমাজতন্ত্র আসবে। আজ যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাস দেখবি অর্থনীতি বাদে আর সব কিছুতেই তারা সঙ্কটাপন্ন। আজকাল তো এমনকি অর্থনীতিতেও তারা সঙ্কটাপন্ন। বরাবরই তাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি ছিল অন্য সব দেশকে শোষণ। এখন বিভিন্ন কারণে সেই শোষণে ঘাটতি দেখা দেয়ায় তারা বিপদাপন্ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তারা নিঃসন্দেহে এগিয়ে আছে, কিন্তু পুঁজিবাদের হাতে এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে ভোগবাদের আফিমে ঘোরের মধ্যে রাখছে। মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলেছিলেন, এখন হয়তো ভোগবাদকে আফিম বলতেন। আর কি জানিস, প্রচুর মানুষ যারা নিজেদের বামপন্থী বা প্রগতিশীল বলে মনে করে মার্ক্সের এই বাক্যটাকে পুঁজি করে অনবরত ধর্মের বিরোধিতা করে।

তুমি নিজেও তো ধর্মও মান না।

হ্যাঁ। তবে আমি ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি না। কারণ আমার মনে হয় এটা করলে প্রচুর মানুষ, যাদের বেশির ভাগ লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, শোষিত এবং যাদের জন্য বামপন্থীরা লড়াই করে, তাদেরকেই নিজেদের বিরুদ্ধে দাড় করানো হয়। আমার মনে হয় ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এরা আসলে আসল যুদ্ধ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে – তা সে বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে আর যারা ধর্মের বিরোধিতা করে রাজনীতি করে দিনের শেষ দু দলই ধর্মের এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আসে।
কিন্তু এর সাথে সমাজতন্ত্র আসা না আসার সম্পর্ক কী?
দেখ, সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার অনেক কিছুই পছন্দ হলেও কিছু কিছু জিনিস একেবারেই অপছন্দ ছিল। এটা ছিল মানুষের স্বাধীনতার অভাব, ছিল ভয়। যদিও সে সমাজ এদেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছে, পশ্চাৎপদ একটা দেশকে আধুনিক দেশে পরিণত করেছে, সমাজের অবহেলিত স্তর থেকে লাখ লাখ শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেছে, কিন্তু এই যে মানুষের মধ্যে এত ইনভেস্টমেন্ট করল সেটাকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে দেয়নি। মানুষ সৃজনশীল। আর সৃজনশীল মানুষ স্বাধীন না হলে সেটা হয় প্রতিভার অপচয়। এটাও অসাম্য তৈরি করে। তবে স্বাধীনতা মানুষকে তখনই দেয়া যায় যখন সমাজ পরমতসহিষ্ণু হয়। পরমতসহিষ্ণুতা – এটা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান শর্ত। যাকগে এখন আমাকে উঠতে হবে। পরের সপ্তাহে আমরা আবার এ নিয়ে কথা বলব, ঠিক আছে?
আচ্ছা।

ঘন্টা খানেক পরে আমার বাস। এক্ষুনি বেরুতে হবে। সেভার সাথে হাত মিলিয়ে রওনা হলাম দুবনার পথে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো