বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৯৪): লেনিন

-বিজন সাহা  

গত ২২ এপ্রিল ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের জন্মদিন। ১৫৩ বছর আগে ১৮৭০ সালের এই দিনে জার শাসিত  রাশিয়ার ভোলগা তীরের সিমবির্স্ক শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় উলিয়ানভস্ক লেনিনের জন্মগত উপাধি উলিয়ানভ থেকে। এখনও সেই শহরে লেনিনের হাউজ মিউজিয়াম কাজ করে। বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আসে সেই মিউজিয়াম দেখার জন্য। শুধু লেনিনের পৈতৃক বাড়িই নয় সেখানে এখনও প্রায় আগের মতই রয়েছে লেনিনের পারিবারিক ডাক্তার সহ অন্যান্যদের বাড়ি। সেদিক থেকে বলা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও লেনিনের স্মৃতি এখনও যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তবে আগে যদি লেনিন ছিলেন স্বর্গের অধিবাসী তবে এখন তিনি মর্ত্যের মানুষ। বর্তমান রাশিয়ায় তাঁর যেমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা যায় তেমনি তাঁর সমালোচনাও করা যায় নির্ভয়ে।

লেনিনের প্রতি আমার ভালবাসার শুরু খুব ছোটবেলায়, এত ছোটবেলায় যে সময়টা মনেই নেই। এরপর যখন বাড়িতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন রংবেরঙের পত্র পত্রিকা আসতে থাকে তখন ভালবাসা আরও বেড়ে যায়। মনে আছে স্কুলে পড়ার সময় একবার বড়দা বলেছিলেন, দেশি কৃষ্ণ থাকতে বিদেশি লেনিনের প্রতি এত প্রেম কেন? আমিও বলে দিলাম, তোমাদের কৃষ্ণ যেমন এখানে বিদেশি, লেনিনও তাই। এখনও মনে পড়ে “চারণিক শিল্পীগোষ্ঠী”র নিবেদনে লেনিনের পালা। লেনিনের ভুমিকায় অমলেন্দু বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয়। পরে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে লেনিনের সম্পর্কে আগ্রহ বাড়তে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে এসে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। মমতাজ ভাইয়ের ঘোরে লেনিনের ৫৪ ভলিয়াম লেখা দেখে ভাবতাম এত কিভাবে লিখলেন। তবে ধীরে ধীরে সেই ভালোলাগা ভালবাসায় ভাটা পড়ে। সেটার জন্য লেনিন যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী লেনিন ভক্তরা।

সোভিয়েত দেশে অনেক ভালোর মধ্যে কিছু কিছু খারাপ দিকও দেখার সুযোগ হয়েছে। আর সেসব ছিল যেমন হাস্যকর তেমনি দুঃখজনক। অনেক মানুষ আছে যারা জীবনে প্রচুর ভালো কাজ করে, কিন্তু ছোটোখাটো দোষের জন্য তাদের সব ভালো কাজই বৃথা যায়। এমন লোক জীবনে অনেক দেখেছি। আমার একটা প্রিয় জায়গা ছিল আরবাত। কখনও রাতের দিকে যেতাম সেখানে ঘুরতে, দেখতাম গীটার বাজিয়ে গান গাওয়া তরুণ তরুণীদের সাদা পোশাকের লোকজন ধরে নিয়ে যেত। অথবা বাজারে অতি সাধারণ জিনিসপত্রের অভাব। এসবের জন্য লেনিন হয়তো দায়ী ছিলেন না, তবে যেহেতু সব কাজই তখন লেনিনের নামেই করা হত তাই দোষটা তাঁর ঘাড়ে এসেই পড়ত। কথা প্রসঙ্গে বলা যায় গরবাচভ সব কিছুই কিন্তু লেনিনের নামেই করতেন, কথায় কথায় লেনিনের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেন।

আসলে কোন বিশাল মানুষকে আমরা চিনি তাঁর কাজে বা লেখায়। তাঁর আসল জীবন সব সময়ই থাকে বিভিন্ন মিথ দিয়ে ঘেরা। এই মিথ ভেঙ্গে সত্যিকারের মানুষের যত কাছাকাছি আমরা যাই তত বেশি আমাদের মোহভঙ্গ হয়। সেটা ভালো বা মন্দ দু’ই হতে পারে। সোভিয়েত আমলে বেশ কয়েকবার রেড স্কয়ারে চিরনিদ্রায় শায়িত লেনিনকে দেখতে গিয়েছি। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে দেখতে গিয়েছি তাঁর শেষ বাসস্থান গোর্কি লেননস্কি। তবে ঐ যে বললাম যতই দিন গেছে মনে ততই প্রশ্ন জেগেছে তাঁকে নিয়ে। সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ায় লেনিনের জীবনের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হতে থাকে। জার পরিবার হত্যায় তাঁর যে পরোক্ষ সমর্থন ছিল সেটাও জানা যায়। সব মিলিয়ে আগের সেই শ্রদ্ধার স্থানটা নড়ে যায়। লেনিন নিঃসন্দেহে গত শতাব্দীর অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি একাই বিশ্বের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমান মানবতাবাদী রূপ সেটাও এসেছে লেনিনকে হঠাতেই। বলে না “সুখ ছিল  না, দুঃখ সাহায্য করল”। তবে এটা ঠিক সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের প্রায় তিরিশ বছর পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। লেনিনের ১৫০ বছর পূর্তির সময় মানে ২০২০ সালের জরীপে দেখা যায় প্রায় ৫৬% রুশ লেনিনের প্রতি পজিটিভ ধারণা পোষণ করে, ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে সেটা ৫৭%। তাঁর প্রতি নেগেটিভ মনোভাব পোষণ করার অনুপাত যথাক্রমে ২০% ও ১৪%।

অনেকেই লেনিনকে এদেশের এক ট্র্যাজিক ফিগার বলে মনে করেন। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। জীবিত অবস্থাতেই তিনি দেখতে পান কিভাবে তাঁর হাতে গড়া পার্টিকে স্ট্যালিন ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করে। যে রাষ্ট্র ধারণার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই তাঁর অধীনেই গড়ে ওঠে বর্তমান কালের সব চেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্র। আবার তাঁর জনগণের শত্রু তত্ত্ব ব্যবহার করেই পরবর্তীতে একে একে তাঁর সমস্ত সহকর্মীকে হত্যা করা হয়। সার্বিক বিচারে লেনিন খুব বিতর্কিত এক চরিত্র এ অর্থে যে একদিকে তিনি সাধারণ মানুষের জন্যে এনেছেন মুক্তি, অন্যদিকে সমাজের এক বিশাল অংশের জন্য এনেছেন সীমাহীন দুর্ভোগ। লেনিনের আদেশেই রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশের বাইরে। অল্প সংখ্যক মানুষের একনায়কত্বের জায়গায় আসে শ্রমিকের একনায়কত্ব। শান্তির পরিবর্তে আসে সন্ত্রাস, যদিও স্ট্যালিনের হাত ধরে। সব কিছুর পরেও লেনিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর রাজনৈতিক বা বিপ্লবের তত্ত্বের জন্য। আরও শত শত বছর তাঁর হয়ে লাল ঝাণ্ডা তোলার মানুষের যেমন অভাব হবে না তেমনি অভাব হবে না তাঁকে ঘৃণা করে এমন মানুষের। আজ যে বিশ্ব আগের চেয়ে অনেক মুক্ত, দেশে দেশে সাধারণ মানুষ যে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আরও বেশি সোচ্চার তাঁর পেছনের আছে লেনিনের হাত।

শুধু তাত্ত্বিক নন, সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বাস্তবায়নের অন্যতম স্থপতি হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সোভিয়েত আমলে প্রায় সর্বত্রই দেখা যেত একটা স্লোগান “লেনিন ছিলেন, লেনিন আছেন, লেনিন থাকবেন” আর সারা দেশ জুড়ে ছিল লেনিনের মূর্তি। এদেশের রাস্তায় রাস্তায় তখন লেনিনের মূর্তি, অনেকটা ভারতে শিব লিঙ্গের মত। গত বছর এক ছেলের সাথে মস্কো যাচ্ছিলাম। তখন আমি প্রায়ই  কারও সাথে চলে যেতাম। সেটা যেমন সস্তা পড়ত তেমনি বাস বা ট্রেনের টাইম টেবিলের ধার না ধেরে নিজের সুবিধা মত সময়ে গাড়ি ধরা যেত। যাহোক ইভান নামের সেই ছেলের জন্ম চুভাসিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী চেবোকসারির উপকণ্ঠে। কথায় কথায় ও বলল ওর স্কুলের গল্প

একদিন স্কুলের প্রধান জিজ্ঞেস করলেন এই যে বিদ্যুৎ দেখছ – জান সেটা কি দিয়েছেন? এটা ১৯৯৫ – ১৯৯৬ সালের কথা। বাড়িতে মা ধর্ম পালন করেন। ঈশ্বরে ভক্তি আছে। বললাম – কেন, ঈশ্বর! উনি আমাকে এমন ধমক দিলেন। বললেন, এই বিদ্যুৎ শুধু নয়, আজ আমাদের যা কিছু আছে সব দিয়েছেন লেনিন।

এ প্রসঙ্গে নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়। সেই সময় লেনিন এতটাই ক্ষমতাশালী ছিলেন যে অনেকেই তাঁকে মুস্কিল আসান বলে মনে করত। আমরা প্রস্তুতি পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস পড়তাম বাংলায়। যতটা না জানার আগ্রহ থেকে তারচেয়ে বেশি ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেতে। এক বন্ধুর প্রশ্ন ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর। ও ঈশ্বরের নাম জপ করার মত কয়েকবার লেনিনের নাম নিল। অনুবাদক কি একটা বললেন শিক্ষককে।
কিন্তু সে সময় লেনিন তো জীবিত ছিলেন না। ওনার কথা আসছে কেন? – শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন।
আসলে ও বলছে যে যদি লেনিন বেঁচে থাকতেন তাহলে এই যুদ্ধই হত না।
শিক্ষক কোন কথা না বাড়িয়ে ওকে ছেড়ে দেয় ঠিক যেমন আজকাল আমাদের দেশে বিশেষ ধর্মের উপর সবাই বিতর্ক এড়িয়ে যায়। সত্যি বলতে কি আমার নিজেরও তখন মনে হয়েছিল, সত্যিই তো লেনিন বেঁচে থাকলে বুদ্ধি দিয়ে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতেন। পরে জেনেছি এর আগেও একবার তিনি জার্মানির সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে গিয়েছিলেন লজ্জাজনক শান্তি চুক্তিতে সই করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (৯৩): পঞ্জিকা বিতর্ক -বিজন সাহা

আসলে সোভিয়েত আমলে অনেকেই লেনিনকে ঈশ্বরের মত বিশ্বাস করত। আমার রুমমেট একদিন তো বলেই বসলো “যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতাম, লেনিন হতেন সেই ঈশ্বর।” গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে একসময় নিজেই ঈশ্বর হয়ে গেছেন। ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে লেনিন নিজেই নতুন ধর্মের জন্ম দেন। আশির দশকে অনেককেই দেখেছি লেনিনকে ঈশ্বরের মত ভক্তি করতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে তিনি ছিলেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে। নব্বুইয়ের দশকে শুরু হয় লেনিনের ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন দিক বিশেষ করে খারাপ দিক উন্মোচনের পালা। এখন সেটা তেমন আর হয় না বললেই চলে। তবে আগে তাঁর যেসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জিনিয়াস বলে মনে করা হত তার অনেক কিছুই আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। অনেকের ধারণা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের বীজ জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা সম্পর্কিত তাঁর কিছু সিদ্ধান্তের মধ্যেই নিহিত ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার টাইম বোমা সেই ১৯২২ সালেই স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন রিপাবলিককে স্বাধীন হওয়ার অধিকার দেওয়ার মাধ্যমে এ কথা এখন অনেকেই বলেন। লেনিনের তৈরি সংবিধানে বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনভাবে ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার সাংগঠনিক অধিকার দেওয়া হয়েছিল যদিও অনেক প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়েছিল অন্য কোন প্রজাতন্ত্রের ভূমি ও জনগণের সহযোগিতায়। আজকে ইউক্রেনের সমস্যার মূলেও সেই লেনিনীয় সিদ্ধান্ত। তবে যে কারণেই হোক ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব বার বার ফিরে আসবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবনায়। যতদিন সমাজে অসাম্য থাকবে ততদিন থাকবে সাম্যের চাহিদা। সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ ছিল, সাম্য প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি সফল না হলেও বৈষম্য দূর করতে যে অনেকটাই সফল হয়েছিল সেটাও সত্য। কেউ হয়তো বলবে সেটা ছিল গরীবের সাম্য, কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। আমরা এখন আর রাইট ব্রাদার্সের মত করে প্লেন তৈরি করি না। কিন্তু তাদের সাফল্য আমাদের উৎসাহিত করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাফল্য আমাদের বলে যে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লড়াই ইউটোপিয়া নয়। সেই সমাজ তৈরি সম্ভব। সেজন্য দরকার বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা। লেনিনের তত্ত্বকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে প্রশ্ন করা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিন্ন উত্তর খোঁজা। আর এই অন্বেষণের মধ্যেই লেনিন থাকবেন আমাদের মাঝে। লেনিন কোন স্থবির ধারণা নয়, ধারণা পরিবর্তনের, বিশ্বকে পরিবর্তনের উদাহরণ। আমরা উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিই সেটাকে নকল করার জন্য নয়, সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগুনোর জন্য।

সোভিয়েত আমলে এদেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল নাস্তিক। ঈশ্বরে তাদের বিশ্বাস ছিল না। তবে লেনিনের প্রতি তাদের বিশ্বাস এতটাই অন্ধ ছিল যে তাঁকে তারা ঈশ্বরের আসনে বসায়। যদিও সে সময়ে ধর্মকে নিষিদ্ধ না করলেও উৎসাহিত করা হত না, তবে অধিকাংশ লোকের ধর্ম বিশ্বাস না করার কারণ আমার মনে হয় মানুষে মানুষে তুলনামূলক কম বৈষম্য। কেননা মানুষ সাধারণত ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয় হয় অসুখ বিসুখ বা অন্যান্য বিপদে পড়ে অথবা কারও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে। এখানে যেহেতু মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো যেমন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষা কমবেশি ছিল সার্বজনীন আর চাকরি ছিল প্রায় নিশ্চিত তাই অভিযোগ করার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিল না, সেটা তারা করত পার্টি, কমসোমল এসবের কাছে। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা ও মানুষে মানুষে বৈষম্য কমানোর সাথে মানুষের ধর্ম বিশ্বাস একান্ত ভাবে জড়িত বলে মনে হয়।

আমার ধারণা যারা ভাবেন আবার সব কিছু সোভিয়েত ইউনিয়নের মত হবে তারা ভুল ভাবেন। আসলে বিপ্লবই হোক আর বিবর্তনই কোন – যখন কোন সমাজ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় উত্তরণ করে তখন শুধু সমাজের অবকাঠামোই বদলায় না, বদলায় মানুষের মনমানসিকতা যদিও আগের অনেক কিছুই থেকে যায়। সে অর্থে সমাজ বহমান নদীর মত যা সেই পাহাড় থেকে আনা জল যেমন বহন করে তেমনি বহন করে পথে পাওয়া পলিমাটি থেকে শুরু করে অন্য সব। পুরাতনের মধ্যে নতুনের জন্ম হয়, নতুন পুরাতনের অনেক কিছুই বহন করে কিন্তু কখনই পেছনে যেতে চায় না, চাইলেও পারে না। সময় কাউকে পিছু ফিরতে দেয় না। ভারতবর্ষ চাইলেই এখন আর ব্রিটিশ আমলে ফিরে যেতে পারবে না যদিও ব্রিটিশ আমলে তৈরি অনেক অবকাঠামো তো বটেই এমনকি অনেক আইন কানুন সেখানে এখনও কাজ করে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশে এখনও পাকিস্তানপন্থী মানুষের অভাব নেই, কিন্তু তাই বলে এখানে আর কখনই পাঞ্জাবী শাসন কায়েম হবে না। আসলে ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয় তখন ইসলামের ভিত্তিতে দুটো ভিন্ন দেশ হবার কথা ছিল। জিন্নাহর ধূর্ততায় এক দেশ হয় আর সেটাই হয় পাকিস্তানের পতনের কারণ। এখন যারা পাকিস্তানের কথা বলে তাদের এক বিরাট অংশই সেই পাকিস্তানের কথা বলে। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাজে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে সেটা কখনই আর বাংলাদেশকে কারও অধীন হতে দেবে না। তবে সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য একাত্তরের পক্ষের শক্তিতে একত্র কাজ করতে হবে। একই ভাবে অক্টোবর বিপ্লব এদেশে নতুন ধরণের মানুষ তৈরি করে। সেটা আমরা দেখি রুশ দেশের মানুষের মনমানসিকতায়। কিন্তু বিগত তেত্রিশ বছরে এদের মানসিকতায় যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটাই দেবে না নতুন করে পুরানো সময়ে ফিরে যেতে। ফলে এরা হয়তো একটা পর্যায় পর্যন্ত সোভিয়েত আমলের অনেক কিছুই গ্রহণ করার পক্ষে থাকবে, কিন্তু যখনই সেটা একটা মাত্রা পেরিয়ে যাবে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পেছনে যতটা না বাহ্যিক ইন্ধন ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল আভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা, পার্টির ব্যুরোক্র্যাসি ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা রাশিয়া আর কখনই সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বিপ্লব রপ্তানি করবে না, দেশে দেশে কমিউনিস্ট বা বামপন্থী দলের জন্য নিজের দ্বার অবারিত রাখবে না। আর সেটা মনে রেখেই বিভিন্ন দেশের বামপন্থীদের কাজ করতে হবে, নিজেদের গড়তে হবে।

মানব সভ্যতার ইতিহাস সাফল্যের ইতিহাস হলেও তার পেছনে আছে শতগুন বেশি ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই মানুষ সাফল্যের মুখ দেখে। একজন শিশু যেমন বার বার পড়ে একদিন হাঁটতে শেখে মানুষও কোন কাজে বার বার ব্যর্থ হয়ে একদিন সাফল্য লাভ করে। আইনস্টাইন কয়েক বছর একটার পর একটা পেপার লিখে শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। অনেক বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলকে ভুল প্রমাণিত করতে যে নীরিক্ষার আয়োজন করেন সেটাই ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব সঠিক প্রমাণ করে। আসল কথা কাজে নেমে

হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছেড়ো জোরে
তোমার আমার দেখা হবে অন্য গানের ভোরে

তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যর্থ হলেও সেটা সাময়িক বলেই আমার বিশ্বাস। যে যাই বলুক, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতন্ত্রের ধারণা অনেক বেশি মানবিক। কারণ বৈষম্য থেকেই সব অশান্তির জন্ম। হয়তো ততটা দ্রুত নয়, তবে একদিন মানুষ ঠিকই সাম্যের দ্বারস্থ হবে। পুঁজিবাদের ভিত যেখানে অসাম্য, সমাজতন্ত্রই সেখানে সাম্যবাদে উত্তরণের পথে সাঁকোর কাজ করতে পারে। সেদিন আবার সবাই হয়তো গাইবে

ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার তুফান,
প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল
কমরেড লেনিনের আহ্বান,
চলে মুক্তি সেনাদল।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া