মতামত

বৈষম্য বিলোপ ছাড়া মানবাধিকার রক্ষা অসম্ভব

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

২য় বিশ্বযুদ্ধে দৃশ্যত মিত্র বাহিনী বা আমেরিকানরা জয়ি হয় আর জার্মানরা পরাজিত হলেও বস্তুত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। তাই ২য় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি ঘোষণার পর মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি সবার আগে স্থান পায়। ফলে ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ ঘোষনা করে “সার্বজনিন মানবাধিকার ঘোষনা”। সার্বজনিন মানবাধিকার ঘোষনার ধারা ১ এ উল্লেখ করা করা হয়েছে – ‘সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে’।  ধারা ২ তে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নির্বিশেষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে।

সময়ের পরিক্রমায় মানবাধিকারের প্রাসংগিকতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদে সিডও সনদ গৃহীত হয় এবং ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হতে তা কার্যকর হতে শুরু করে। সিডও সনদে ৩০টি ধারা আছে যার প্রথম ১৬টি ধারাতেই নারীর প্রতি বৈষম্যের ধরন বা প্রকারভেদ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সিডও সনদের মূল উদ্দেশ্য নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও এই সনদের নামকরণ হয়েছে “নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের সনদ”। অর্থাৎ নারীর মানবাধিকার রক্ষায় নারীর প্রতি ১৬ টি বৈষম্যের বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। যা বিলোপ সাধিত না হলে নারীর মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব নয়

আমাদের সংবিধানের ২য় অধ্যায়ে সুযোগের সমতা সংক্রান্ত বিষয় নির্দিষ্ট করতে গিয়ে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে -তাতে আমরা দেখি সংবিধানের ধারা ১৯(১) এ রাষ্ট্রকে  সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। ধারা ১৯(২) এ মানুষে মানুষে  সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বিলোপ সাধন সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে।

ধারা ২৭, ২৮, ২৯ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই -আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান। অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির মাধ্যমে কোন প্রকার বৈষম্য করা যাবেনা এবং সরকারী চাকরি লাভের সুযোগের ক্ষেত্রেও সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে।

আমরা জানি ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নকে টেকসই করার লক্ষে জাতি সংঘ ঘোষণা করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা বা Sustainable Development Goal যাকে সংক্ষেপে বলা হয় SDG। বর্তমান বিশ্বে সবচাইতে আলোচিত বিষয় হচ্ছে- SDG। জাতিসংঘ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত SDG অর্জনের সময়কাল হিসাবে ঘোষনা করেছে। SDGএর ৫ নং গোল হচ্ছে – লিঙ্গ সমতা বা Gender Equality। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন টেকসই করতে হলে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা অন্যতম প্রধান শর্ত। আর লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হলে নারী ও মেয়ের বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। নারী পাচার, যৌন হয়রানি ও অন্য সব ধরণের শোষন বঞ্চনা সহ সকল নারী ও মেয়ের বিরুদ্ধে সকল ধরণের সহিংসতার অবসান ঘটাতে হবে।

সার্বজনিন মানবাধিকার ঘোষণার ২৩ ধারা সকল শ্রমিকের সম্মানজনক মজুরি নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ আছে অথচ আমাদের শ্রম বাজারে তীব্র মজুরী বৈষম্য বিরাজমান। আমাদের দেশে শ্রমিকেরা যে মজুরি পায় তা দিয়ে জীবনমান পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যে যত বেশি প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করে সে ততবেশি মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।  যা আইএলও কনভেশন ১০০ এর চরম লঙ্ঘন।

বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এবং আনন্দময় একটা বিষয় হচ্ছে- নারীর গর্ভ ধারন। অথচ আমাদের সন্তান সম্ভাবা নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে তালবাহানার শেষ নাই। সম্প্রতি শ্রম বিধিমালায় মূল আইনকে পাশ কাটিয়ে মাতৃত্ব কল্যাণ সুবিধা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার মাতৃত্ব কল্যাণ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবেও বড় ধরনের বৈষম্যর দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই। সরকারী নারী কর্মচারীরা ছুটি পায় ৬ মাস আর বেসরকারী নারী শ্রমিক-কর্মচারীরা পায় ১১২ দিন অর্থাৎ ৪ মাস থেকেও কম।

কোন দেশের বৈষম্যের মাত্রা নির্ধারন করার জন্য বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হলো সেই দেশের গিনি সহগ  নির্ণয় করা। যার মান থাকে ০ থেকে ১ এর মধ্যে। গিনি সহগের মান ০ হলে বৈষম্য নাই আর গিনি সহগ ১ হলে চরম চরম বৈষম্য। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল ০.৩৬। অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশেও আয় বৈষম্য অত ছিলনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটা পরবর্তীতে আরো না কমে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে গিনি সহগ ছিল ০.৪৮। আমার ধারণা করোনা পরবরতী এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কিংবা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের প্রভাব ও রাষ্ট্রীয় লুটপাটন্ত্রের প্রভাবে বর্তমানে গিনি সহগ ০.৫ এর উপরে চলে গেছে যা উচ্চ আয় বৈষম্যের নির্দেশক।

বৈষম্যের এ চিত্র কেবল বাংলাদেশে নয়। ১৯১৭ সালের অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ৮ জন মানুষের হাতে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদ রয়েছে। এটাকে বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। যা আসলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য ফল। তারপরও বৈষম্য সহনীয় মাত্রায় রাখার একটি প্রবল চাপ বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষ থেকে জারি রাখতে হবে। আমাদের শ্রমজীবী মানুষের এই মুহুর্তের চ্যালেঞ্জ বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তথা প্রযুক্তির আগ্রাসন যে হারে উল্লম্ফন ঘটছে তাতে বৈষম্য আরো বাড়বে বৈ কমবেনা।  তাই শ্রমজীবী মানুষের আগামীর চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন হবে।

লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক