মতামত

বুট পলিশার থেকে প্রেসিডেন্ট: লুলা দা সিলভা

-রিজওয়ানুর রহমান খান

রিজওয়ানুর রহমান খান (ফাইল ছবি)

একজন শ্রমিক নেতার প্রেসিডেন্ট হওয়া খুব সহজ নয়। শ্রমিকেরা যে কোন দেশের উন্নয়ণের মূল হাতিয়ার হলেও তার সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। সেটা আমাদের দেশে যেমন পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তেমন। ব্রাজিলের শ্রমিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা, যাকে আমরা লুলা নামেই চিনি। ১৯৪৫ সালে জন্ম নেওয়া লুলা পিতা-মাতার আট সন্তানের মধ্যে সপ্তম। তিনি আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। ১২ বছর বয়সে তিনি জুতা পালিশের কাজ করেন। ১৯ বছর বয়সে একটি অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ কারখানায় কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল হারান। দুর্ঘটনা পরবর্তী চিকিৎসা ও হাসপাতালে ছুটাছুটির সময় শ্রমিক সংগঠনের সহযোগিতা তাঁকে নতুন অভিজ্ঞতা দেয়। এরপর তিনি ’ভিলারেস মোটালস এসএ’ -তে কাজ নেন এবং শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি শ্রমিক ইউনিয়নে যোগদান করেন। কর্তব্যনিষ্ঠ ও ত্যাগী লুলা দা সিলভাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৫ এবং ১৯৭৮ সালে পরপর দু’বার ব্রাজিলের বৃহত্তর শিল্প অঞ্চল সাও পাওলোর দুটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভার ইস্পাত শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে ব্রাজিলের সামরিক শাসনের সময় তিনি ধর্মঘট এবং আন্দোলনের কারনে জেল খাটেন। সামরিক সরকারের অধিনে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য কারাবন্দী অন্যান্যদের ন্যায় তিনিও সামরিক শাসনের পর আজীবন পেনশন পান।
১৯৮০ সালে শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা ’পার্টিডো ডস ট্রাবালহাডোরস’ (পিটি) বা ওয়ার্কার্স পার্টি নামে একটি বামপন্থি দল প্রতিষ্ঠা করে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। একজন ব্রাজিলীয় রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তণ শ্রমিক নেতা ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরপর দুই দফায় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৩৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এটা জেনে অবাক হতে হয় ২০০২ সালে নির্বাচনে বিজয়ের আগে তিনি ৩ দফা নির্বাচনে হারেন। একজন শ্রমিক নেতার এই অদম্য মনোবলে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। দুই মেয়াদে তিনি অনেক কল্যাণমূলক কাজ শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বহু আগে ফেডারেল ডেপুটি থাকা কালে ব্রাজিলের সংবিধান প্রণয়নের সময় তিনি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ’বোলসা ফ্যামিলিয়া’ এবং ’ফোমে জিরো’ সহ ব্যাপক সামাজিক কর্মসূচি চালু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ’পারমানবিক কর্মসূচী’ এবং ’জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়ে তিনি উচ্চ কন্ঠ ছিলেন। তাঁকে ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের একজন বলা হয়। ২০১০ সালের নির্বাচনে দিলমা রুসেফের কাছে পরাজিত হন।
২০১১ সালে তার গলায় ক্যান্সার ধরা পড়লে, কেমোথেরাপি করা হয় এবং তিনি ক্যান্সার সারভাইভার হিসেবে নবউদ্যমে কাজ শুরু করেন। দিলমা রুসেফ ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব পালনকালে ২০১৬ সালে অভিশংসিত হন। জুলাই ২০১৭ সালে লুলাকে একটি বিতর্কিত বিচারে মানিলন্ডারিং এবং দূর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তিনি ৫৪০ দিন জেলে কাটান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে লুলা প্রতিদ্ব›িদ্বতার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালে সুপ্রিম ফেডারেল আদালতের রায়ে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ২০২২ সালের নির্বাচনে লুলা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর বিরুদ্ধে ৩ৃতীয় মেয়াদে লড়াই এর ঘোষণা দেন। অক্টোবরে প্রথম দফা নির্বাচনে তিনি ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনেও তিনি বিজয় ছিনিয়ে আনবেন। অদম্য মনোবলের অধিকারী একজন শ্রমিক নেতা তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হয়ে একটি ইতিহাস গড়বেন শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এই প্রত্যাশা ও শুভ কামনা রইল লুইস ইনাসিউ লুলা দা সিলভার জন্য।

লেখকঃ সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার বিলস এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বিএফটিইউসি