মতামত

বিধি ৩৯ক এর কোন আইনগত ভিত্তি নাই

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ছোট-খাট কিছু সংশোধন বাদ দিলেও ২০১৩  এবং ২০১৮ সালে বড় ধরণের দুইটি সংশোধন হয়েছে। তবে ২০১৮ সালে শ্রম আইনের ব্যাপক সংশোধনের পর ২০১৫ সালে প্রনীত শ্রম বিধিমালা সংশোধন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রায় চার বছর পর সম্প্রতি শ্রম বিধিমালা সংশোধন করে গ্যাজেট পাশ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সংশোধিত বিধিমালা কতটুকু শ্রমিক বান্ধব হয়েছে? কিংবা সংশোধিত বিধিমালা কি আদৌ নিরপেক্ষ হয়েছে?

আমি ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত ৫টি পর্বে বিধিমালার সংশোধনীতে শ্রমিকদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে মাতৃত্বকালীন ছুটির পাওনার হিসাব নিয়ে এবং এ বিষয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে বিধায় আবারো লিখার তাগিদ অনুভব করছি।

সংশোধিত বিধিমালায় নতুন সংযোজিত ৩৯ক তে উল্লেখ করা হয়েছে – শ্রমিকের সর্বশেষ মাসিক প্রাপ্ত মজুরিকে ২৬ দ্বারা ভাগ করে ১ দিনের গড় মজুরি নির্নয় করতে হবে। শ্রম আইনে মজুরির সংজ্ঞা ধারা ২(৪৫), ১৪ এবং ১২০ এ তিন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং এখানে মজুরির সংজ্ঞা কী হবে সেটা নিয়েও একটা বিতর্ক আছে। তবে শ্রম আইনে ধারা ১৪ দ্বিতীয় অধ্যায় এবং ধারা ১২০ দশম অধ্যায়ের জন্যই প্রযোজ্য বলে যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে সেহেতু মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য মজুরির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ২(৪৫) প্রযোজ্য বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।  কিন্তু মাতৃত্বকালীন ছুটির হিসাবে প্রাপ্ত শব্দটাতেই আমার আপত্তি।

প্রাপ্ত শব্দটাতে আমার আপত্তি কী কারণে সেটা বুঝানোর জন্য একটা উদাহরন দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি, যেমন ধরুন,  একজন শ্রমিকের মোট মজুরি ৮০০০ টাকা এবং তার মূল মজুরি ৪১০০ টাকা। তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যাওয়ার সময় সর্বশেষ মাসে ২ দিন অনুপস্থিত ছিলেন তাহলে ২ দিনের জন্য তার মজুরি কর্তন হবে (৪১০০ ÷ ৩০)× ২  টাকা = ২৭৩ টাকা । তাহলে তার সর্বশেষ মাসিক প্রাপ্ত মজুরি হবে (৮০০০-২৭৩) টাকা = ৭৭২৭ টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১ দিনের গড় মজুরি বের করার জন্য ৮০০০ টাকাকে ২৬ দ্বারা ভাগ করা হবে নাকি ৭৭২৭ টাকাকে ২৬ দ্বারা ভাগ করা হবে? এর সমাধান কে দিবে?

কেউ কেউ নতুন সংযোজিত বিধি ৩৯ক এর ব্যাখ্যায় বলছেন, সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরি উল্লেখ থাকলেও সর্বশেষ মজুরি তথা ৮০০০ টাকাকেই ২৬ দ্বারা ভাগ করে ১ দিনের মজুরি বের করতে হবে কিন্তু বিষয়টার সাথে আমি একমত হতে পারছিনা কেননা তাহলে প্রাপ্ত শব্দ যুক্ত করার পেছনে যুক্তিটা কী? কোন মালিক যদি ৭৭২৭ টাকাকে ২৬ দ্বারা ভাগ করে ১ দিনে মজুরি হিসাব করে তাকে কি চ্যালেঞ্জ করা যাবে? অযথা এই জটিলতা সৃষ্টি করার কোন প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করিনা। আরো  আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে বিধি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম কিংবা যে বিধি নিয়ে এত বিভ্রান্তি, সেই বিধিটার কি আইনগত কোন ভিত্তি আদৌ আছে?

এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবার একটু শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করা যাক। শ্রম আইনের ৪৮(২) ধারায় উল্লেখ আছে, গড় মজুরি গননার জন্য নোটিশ প্রদানের অব্যবহিত পূর্ববর্তী ৩ মাসে তার প্রাপ্ত মোট মজুরিকে উক্ত সময়ে প্রকৃত দিনগুলি দ্বারা ভাগ করতে হবে। অর্থাৎ আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকার পর এবং আইনটি এখনো কার্যকর থাকায় এ বিষয়ে বিধিমালায় আর কোন ব্যখ্যার প্রয়োজন নাই বলেই আমি খুব দৃঢ়ভাবে মনে করি। শ্রম আইন এবং বিধিমালার বিষয়ে যারা প্রাথমিক জ্ঞান রাখেন তারা প্রত্যেকেই এই ব্যাপারে একমত হবেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের রথি-মহারথিরা কি না বুঝেই এমন একটি ভুল করেছেন? এই ব্যাপারে আমার সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, বুঝে কিংবা না বুঝে যেভাবেই করা হোক না কেন – এ ধরনের ভুল ক্ষমার অযোগ্য এবং অমার্জনীয় অপরাধ। সরকারের পক্ষ থেকে যারা বিধিমালা সংশোধনের সাথে যুক্ত ছিলেন তারা সবাই সরকারের বেতন ভুক্ত কর্মকর্তা তাদের প্রতি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)