বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৫৯): আগস্ট

– বিজন সাহা

আমি যখন ভোলগার তীরে হাঁটি অনেক সময় নিজের অজান্তেই চলে চাই আমার কালীগঙ্গার তীরে। শীতে বরফের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার শব্দ মনে করিয়ে দেয় চৈত্র মাসে কালিগঙ্গার বালুচরে হেঁটে যাবার স্মৃতি। শুধু তাই নয় রুশ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমি দেখি বাংলাদেশের ছবি। এটা কি শুধু একান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি? আমি কিন্তু জীবনের বহু ক্ষেত্রেই এসব মিল  দেখতে পাই। বর্তমান ইউক্রেন সংকট আমাকে বিভিন্ন ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। আজ আমরা কথা বলব আগস্ট মাস নিয়ে।

আগস্ট মাস। বাঙালীর জীবনে এক ভয়াবহ মাস। এই আগস্টেই ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল কিন্তু একই সাথে দেখেছিল অনেক মৃত্যু। সেই মৃত্যুতে মুক্তির আনন্দ অনেকের জন্যেই ম্লান হয়ে গেছিল। সমস্ত উপমহাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেও পরাধীন হয়েছিল নতুন শক্তির কাছে। সে শক্তি ছিল আরও পাশবিক, আরও বিধ্বংসী। সেই শক্তি মানুষকে মানুষ না করে হিন্দু আর মুসলমান বানিয়েছিল – ঐক্যের পরিবর্তে ভাঙ্গনের বাণী শুনিয়েছিল। সেই বিভাজনের ক্ষত এখনও অনেক পরিবার বহন করছে আর গোটা মহাদেশ এখনও দেশভাগ নামক সেই পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের রেডিয়েশনের দ্বারা ধীরে ধীরে জ্বলে পুড়ে মরছে। পারমানবিক বোমা ঝলসে দেয় শরীর, সাম্প্রদায়িক বোমা বিকৃত করে মন। আর একবার সেটা শুরু হলে শত শত বছরেও মানুষ সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে মুক্ত হতে পারে না। একটু সুযোগ পেলেই তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তবে সেটা শুধু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নয়, যেকোনো ধরণের শোভিনিজম এই পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। ১৯৪৭ এর ১৪ ও ১৫ আগস্ট যদি ছিল ভাঙ্গনের মধ্যেও সৃষ্টির আশ্বাসে ভরা, ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট শুধুই কান্না দিয়ে ভেজা। হ্যাঁ, সেদিন বাঙালী হারিয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে, হারিয়ে তাদের স্বপ্ন। এরপরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আবার আঘাত আসে বাঙালীর উপর। এজন্যেই আগস্টকে অনেকেই বলে ভয়াল আগস্ট।

বাঙালীর মতই আরও একটা জাতি আগস্টকে সন্দেহের চোখে দেখে। এটা রুশ জাতি। এরা তাই বলে ব্ল্যাক আগস্ট।  ১৯৯১ সালে ১৯ আগস্ট মস্কো দেখেছিল ট্যাঙ্কের বহর, শুনেছিল রাস্তায় ট্যাঙ্কের গর্জন। তবে সেটা গুলির নয়, চাকার শব্দ। সেদিন স্তম্ভিত সোভিয়েত জনতা দেখেছিল কিভাবে তাদের হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা কর্পূরের মত উবে যাচ্ছে। সে সময় যদিও গরবাচেভের শাসনের প্রতি কারও আর মোহ ছিল না, নব্য অর্থনৈতিক অব্যবস্থার নাগপাশে সাধারণ মানুষের জীবন যায় যায় অবস্থা – তারপরেও কেউ এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর তাই তারা রাস্তায় নেমেছিল, মস্কো, লেনিনগ্রাদের রাস্তায় রাস্তায় লাখ মানুষের উপস্থিতি সামরিক জান্তাদের বাধ্য করেছিল পরাজয় স্বীকার করতে। তবে তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এরপর আর কখনই শয্যা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এটাই ছিল তার মরণ শয্যা। একটা দেশ, একটা অনন্য সামাজিক পরীক্ষাগার, সারা বিশ্বব্যাপী কোটি মানুষের স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেল অতীতের কালো গহ্বরে। হয়তো ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসবে বলে। তবে এখানেই শেষ নয়। এরপর বার বার আগস্ট দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে এদের জীবনে। ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসেই যাত্রীবাহী বিমান তু ১৫৪ ধ্বংস হয়েছে। সাথে নিয়ে গেছে কয়েক শ প্রাণ।  ১৯৯৪ সালে তৎকালীন ফাইনানশিয়াল পিরামিড এমএমএম ধ্বসে পড়ে যাতে গ্রতিগ্রস্থ হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। ১৯৯৮ সালে আগস্টেই রাশিয়া ডিফল্ট ঘোষণা করে যা মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে। এর এক বছর পরে ১৯৯৯ সালের আগস্টেই শুরু হয় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ। ২০০০ সালে ১২ আগস্ট সলিল সমাধি লাভ করে পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন কুরস্ক। আর এ কারণেই আগস্ট এলেই এরা সাবধান হয় এই বুঝি আবার কিছু হবে।

হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, ইউক্রেনে যুদ্ধ বাদ দিলে হয়তো সবকিছু এবার আগস্টে গতানুগতিক ভাবেই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মস্কোয় সন্ত্রাসী আক্রমনে নিহত হল দারিয়া দুগিনা, প্রখ্যাত রুশ দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ আলেসান্দর দুগিনের মেয়ে। দুগিনকে পশ্চিমা বিশ্বে জাতীয়তাবাদী বলে মনে করা হয়, তবে তাঁর জাতীয়তাবাদ আর যাই হোক উগ্র জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা যা বুঝি সেরকম নয়। উনি আসলে রাশিয়াকে ইউরোপীয় সভ্যতার অংশ হিসেবে না দেখে ইউরোপ ও এশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত এক ভিন্ন সভ্যতা হিসেবে দেখতে চান আর রাশিয়ার ইউরেশিয়া আইডেন্টিটির পক্ষে বলেন। যদিও পশ্চিমে তাঁকে ভ্লাদিমির পুতিনের গুরু হিসেবে বলার চেষ্টা করা হয় আমার কখনও সেটা মনে হয়নি। পুতিন নিজে পশ্চিমপন্থী এবং সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে। আর তাই ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণের পর তিনিই প্রথম জর্জ বুশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে তিনি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে আসেন। এতে যত না তাঁর নিজের তারচেয়ে বেশি কৃতিত্ব পশ্চিমা বিশ্বের। ২০১৪ সালের পর থেকে দুগিন পুতিনের অনেক পদক্ষেপ সমর্থন করেন। তাই দুগিনকে ক্রেমলিনের আইডিওলজিস্ট হিসেবে দেখা মনে হয় ঠিক হবে না। অন্তত তিনি সোভিয়েত আইডিওলজিস্ট সুসলভ নন। যাহোক, ফিরে আসা যাক আগস্টে।

নব্বুইয়ের দশকে এমনকি এর পরেও দীর্ঘ দিন আগস্টের দিনগুলি স্মরণ করা হত। আহামরি তেমন কিছু না হলেও ২১ আগস্ট যারা মারা গেছিল সেই মৃতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হত। যদিও সেই মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে তবে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বিচারের রায় অনুযায়ী এতে সৈন্যদের দোষ ছিল না। উত্তেজিত জনতা ট্যাঙ্কে অবস্থিত সৈন্যদের আক্রমণ করলে তারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছে সংঘর্ষ এড়াতে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। যাহোক প্রথম দিকে যদিও পাবলিকলি মৃতদের স্মরণ করা হত তবে গত কয়েক বছর সেটা দেখছি না। এবার এমনকি টিভিতে এ নিয়ে কোন কথা বলা হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। কেন? আসলে যে আশা নিয়ে ১৯৯১ সালের আগস্টে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল বিপদের ঝুকি নিয়ে সেই আশা তাদের পূরণ হয়নি। বিপদে সে ঠিকই পড়েছে, কিন্তু আশা, আকাঙ্ক্ষা অধরাই রয়ে গেছে। আসলে মানুষ যখন লড়াই করতে নামে সে চায় তার বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নত পর্যায়ে যেতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেক কিছুর অভাব ছিল, কিন্তু সেই সাথে অভাবের অভাবও ছিল। মানে অধিকাংশ মানুষ নুন্যতম চাহিদা মেটাতে পারত। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান – এসব আহামরি না হলেও ছিল। মানুষ চেয়েছিল আরেকটু ভাল খাবার খেতে, আরও সুন্দর জামাকাপড় পরতে। চেয়েছিল দোকানে সে যেন নিজের খুশি মত জিনিস বেছে নিতে পারে। কিন্তু এর পরিবর্তে অধিকাংশ মানুষ পেয়েছিল দারিদ্র্য। আগে দোকানে জিনিস ছিল না, এখন দোকানে সব আছে পকেটে কেনার পয়সা নেই। সে সময়ের একটা চুটকি ছিল –
অনেক দিন পরে এক বন্ধুকে দেখে একজন প্রশ্ন করল
– কিরে, এত কাবু হয়ে গেলি যে, শরীর খারাপ নাকি?
– না, শরীর ঠিকই আছে। খাওয়ার সময় নেই।
– কি এত কাজ যে সময় করে খেতে পারিস না?
– আমি তিন জায়গায় কাজ করি তাই খাওয়ার সময় পাই না।
– তাহলে দুই জায়গায় কাজ কর। তখন খাওয়ার সময়ের অভাব হবে না।
– কিন্তু তখন খাবার কেনার পয়সা থাকবে না।

আসলে সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুধু দেশ ভাঙ্গা, দেশে যাতে সমাজতন্ত্র আর কখনও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেই চিন্তাতেই ব্যস্ত ছিল আর ব্যস্ত ছিল সমাজতন্ত্রের অর্জিত সমস্ত পুঁজি নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিতে। সাধারণ মানুষ এদের কাছে ছিল নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য দাবার ঘুঁটি।  আর তাই আজ ১৯৯১ সালের আগস্টের কথা আগের মত করে আর কেউ মনে রাখে না। যে তিনজন মারা গেছিল তাদের আত্মীয় স্বজনরা নিশ্চয়ই তাদের স্মরণ করে আর কিছু লোক যারা এ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভ করতে চায় তারা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ১৯৯১ সালের আগস্ট এখন দুঃস্বপ্নের মতই মনে হয়। তবে ২১ আগস্টের শহীদদের কথা মনে না রাখলেও এখন ঘটা করে পালন করা হয় ২২ আগস্ট। এটা রাশিয়ার পতাকা দিবস। ১৯৯১ সালে এই দিন রুশ সোভিয়েত ফেডারেশনের পতাকা নামিয়ে উত্তোলন করা হয় তিনরঙা পতাকা – ট্রিকলর। এই পতাকা, মানে তিন রঙ্গা পতাকা অবশ্য জারের আমলেও ছিল। সাদা নীল লাল – এই তিনরঙা পতাকা ১৭২০ সালে রুশ জাহাজের পতাকা হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৮৬৫ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত রুশ সাম্রাজ্যের পতাকাও ছিল এটা। বিপ্লবের পরে তেরঙ্গা পতাকা সব রঙ হারিয়ে রক্তে লাল পতাকায় পরিণত হয় যার এক কোণে ছিল মেহনতি মানুষের কাস্তে হাতুড়ি। তবে ২২ আগস্ট ১৯৯১ সে আবার রাশিয়ার পতাকা হিসেবে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। এখন প্রতি বছরই ২২ আগস্ট এদেশে পতাকা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিভিন্ন শহরে প্রচণ্ড উদ্দীপনার সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এবার সারা দেশ থেকে জড়ো করা কাপড়ের টুকরো দিয়ে এক বিশাল পতাকা তৈরি করা হয় পাক্লন্নিয়ে গরিতে। পাক্লন্নিয়ে গরি – বিশাল মেমোরিয়াল যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের স্মরণে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এবার যেসব কাপড়ের টুকরা একত্রে করে পাতাকা তৈরি করা হয় সেখানে লেখা ছিল ইউক্রেনে যুদ্ধ রত সৈন্যদের সাফল্য কামনা করে বিভিন্ন বার্তা। লিখেছিল সমস্ত রাশিয়ার বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে বসবাসকারী মানুষজন। তাই আগস্ট এখন শুধু ভয়াল নয় স্বপ্ন দেখার মাসও ঠিক যেমনটা আমাদের দেশেও যখন শোককে শক্তিতে পরিণত করে ভবিষ্যৎ গড়ার শপথ নেয় মানুষ।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো