মতামত

বঙ্গবন্ধু আরেকটি গণঅভ্যুত্থান চাইছেন সোনার বাংলা গড়তে

-স্বপন দত্ত

বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে কট্টর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের কবল থেকে বের করে এনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে (পূর্ব বাংলা) একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করা সহজ ছিলো না। বিশেষত, রুশ-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধকালীন বৈশ্বিক রাজনীতির স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে চীন ও মার্কিন প্রভাবাধীন বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাঙন ঘাটানো ছিলো অতিশয় অনিশ্চিত ও অসম্ভব-প্রায় একটি কাজ। কিন্তু বিদ্রোহী বাঙালি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হয়েছে। তৎকালীন উপমহাদেশের সঙ্গীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক দক্ষতা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা ও কৌশলই ছিলো বাঙালির বিশেষ সম্পদ।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট খোকা। কি ভাবে ক্রমান্বয়ে রাজনীতিবিদ হলেন ? হলেন, স্কুল জীবনেই অধিকার আদায়ের প্রবল বোধের প্রকাশ থেকেই। তারপরে, কোলকাতায় শিক্ষা জীবনে সেকালের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের রাজনীতি, পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হয়ে ছাত্র-যুব সংগঠন, ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব পাকিস্তানে এ অঞ্চলের জনগণের সমুচিত প্রাপ্য অধিকার, মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির আন্দোলন, মুসলিম লীগ ত্যাগ করে সেকালের বামপন্থীদের আশ্রয় মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে “আওয়ামী মুসলিম লীগ” গঠন, পরবর্তী কালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে জাতি-ধর্ম ও গোষ্ঠী-গোত্র-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে শুধুই “আওয়ামী লীগ” পরিচয়ের রাজনৈতিক দলের পত্তন, অতঃপর ১৯৭১ সালে -“যার যা আছে, তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়” – আহ্বান জানিয়ে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে হয়ে উঠলেন একজন অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা। এভাবেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি থেকে হয়ে গেলেন “জাতির জনক”। এই ইতিহাস আমাদের প্রায় সবারই জানা। এই ইতিহাসের অধ্যায়কে আরো অনুপুঙ্খ ভাবে ও নিবিড় ভাবে জানতে হলে, ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধীনতার পথে যাত্রার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহগুলোকে তাদের গভীর গভীরতরো শিকড়ে গিয়ে সঠিক প্রত্যয়ে কার্যকারণসহ অনুধাবন করতে আগ্রহী হলে, তাতে সহায়ক হবে বঙ্গবন্ধু রচিত ওই তিনটি গ্রন্থ। যদিও তাঁর এ আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত।তারপরও এতে ছেলেবেলা থেকেই তাঁকে আমরা পাই। আর পাই কোলকাতাকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্র লীগের কর্মকাণ্ড। পাই দেশভাগ কালীন রাজনীতির টানা-পড়েন, দাঙ্গা। আরো পাই, দেশ-বিভাগ পরবর্তী বিপর্যস্ত দিনগুলোতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কাহিনীনিচয়, ১৯৫৪ সালে যুক্তপ্রন্ট গঠনের আমল পর্যন্ত। বাকী অংশগুলো তাঁকে হত্যার পরবর্তী সময়ের নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের পরিস্থিতিতে হয়তো বিপন্ন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে বাঙালি গণহত্যায় উন্মাদনায় ঝঁপিয়ে পড়ে ক্রুর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ভাবে জিতে আসা বাঙালির প্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের হাতে আইন অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, বঙ্গবন্ধুকেই সে রাতেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয় মাস আটক করে রাখে কারাগারের নির্জন কক্ষে। কিন্তু সেই দুর্যোগময় দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক নিকট সঙ্গীরা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সিদ্ধান্ত ও পরামর্শে অব্যাহত অবস্থান নিয়ে যুদ্ধকৌশলের খেলায় সার্বিক পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় ভারত ও তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর প্রতিপক্ষ সোভিয়েত রাশিয়ার দৃঢ় সমর্থনে ।

চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিলো পূ্র্ববাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতীয় মুক্তি-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার ঘোর বিরোধী। এই বিরোধিতা মোকাবেলা করার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শন ও দূরদর্শী বহুমুখী ব্যবস্থাপনাসহ পূর্ববাংলার জনগণকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নেতৃত্ব দান এবং একটি নোতুন রাষ্ট্রের পত্তন তথা বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব করতে পারায়, এর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন বৈশ্বিক নেতারূপে পরিচিত অর্জন করতে সমর্থ হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তো বটেই, বিশ্বের দেশে দেশে শোষিত জনগণের জাগরণ ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিলো প্রশ্নাতীত। দেশে ও বিদেশ তাঁর দেওয়া ভাষণগুলো পর্যালোচনা করে দেখলে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ বিরোধী তীক্ষ্ণ আপোষহীন ভূমিকার জন্যেই আন্তরিক মুগ্ধতা প্রকাশ করে কিউবার কিংবদন্তি-নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বাঙালির নেতা শেখ মুজিবকে বিশ্বের বিস্ময় হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছেন।

বলেছেন, “আমি হিমালয় দেখি নি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।” যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপ এবং সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর নীতিগত অবস্থান তাঁকে বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তর কালে, বিংশ শতাব্দীর সেই সত্তরের দশকের দিনগুলোতে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এভাবেই সম্মান ও সমীহ অর্জনকারী একজন বাঙালি রাজনীতিবিদের উজ্জ্বল আবির্ভাব ঘটতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান কেবলই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তবায়কই নন, তিনি একটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানও। তিনি একটি জাতির হাজার বছরের আত্মপরিচয়ের স্বপ্ন-বাস্তবায়নকারী। বিশ্বের বুকে ভাষাভিত্তিক একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘদিনের রাজনীতির অভিজ্ঞতার কারণে তিনি এই স্বাধীন দেশের জন্যে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করেছেন সারাবিশ্বে সমাদৃত নোবেলজয়ী একজন কবির কবিতা। যে কবিতা
স্বদেশের প্রকৃতিঘনিষ্ট সৌন্দর্যরাজীর মহিমাকে ধারণ করে। এ কবিতার বাণী ও সুর গণহৃদয়ের উপলব্ধির কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করে দেশপ্রেমের শিকড়সংযোগ। শেখায় দেশকে আত্মস্থ করার সাধনা। কোনোরূপ যুদ্ধোন্মাদনারই ইন্ধনমাত্র নেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের এই জাতীয় সঙ্গীতে। অপরাপর কিছু কিছু দেশের মতোন এই জাতীয় সঙ্গীতটি উপাসনালয়ের প্রভাবযুক্ত নয়, প্রভাবমুক্ত। মাটি-মাতা-মানুষ নিয়ে এই জাতীয় সঙ্গীতে রয়েছে অকৃত্রিম ও অকৃপণ ভালোবাসার বাণী। যার ফলে, জাতীয় সঙ্গীতটি বিশেষ ভাবে হয়ে উঠেছে গণহৃদয়ের জন্যে এক নিগূঢ় প্রেরণা।

১৯৭১ সালে, পদ্মা-যমুনা- মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত পলিমাটির এই সুজলা-সুফলা ভূখণ্ডে, তথা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ক্রান্তিলগ্নে, ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), যে ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন উদগ্রীব জাতির উদ্দেশে দিয়েছিলেন, তা জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস তৈরি করতে অনুঘটকের কাজ করেছে। এ ভাষণ বিশ্বের গবেষকবৃন্দের বিবেচনায় এতোটাই উদ্দীপনার উপাদানে ঠাসা যে, তা জনগণের চেতনার সলতেকে জ্বালিয়ে রাখতে বিস্ফোরকের ভূমিকা নেয়। এটি বিশ্বের রাজনৈতিক ভাষণসমূহের মধ্যে একটি অনন্য উদাহরণ রূপেই অভিহিত ও চিহ্নিত হয়ে আছে।

এই ভাষণের উদ্দীপনাময় উচ্চারণের তেজস্বান মহিমায় উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংকীর্ণ অধ্যায়ের নীতিগত অবসান হয়। জাতিগত বিভাজনের বিষাক্ত কৌশল ছিলো পাকিস্তানী দ্বিজাতি তত্ত্ব। তারও নৈতিক পরাজয় এবং ঘটে রক্তাক্ত অবসান। এর মধ্য দিয়ে জন্ম হয় নোতুন এক দেশের, ভাষাভিত্তিক আসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের, যার নাম গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

এই বাংলাদেশটাকে সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন দেশটার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ছিলো তাঁর সমগ্র জীবনের সাধনা। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবী উত্থাপন করে পূর্ববাংলা তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পথে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফার দাবীসমূহ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এর মাধ্যমে তিনি ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার পথেই যাত্রা শুরুর বার্তাই পাকিস্তানী সামরিক জেনারেলশাসিত সম্প্রদায়িক সরকারের আমলে তুলে ধরেন।
ফলে, তাঁকে গ্রেফতার করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করা হয় বিচারের নাটকে মৃত্যুদণ্ড দণ্ডিত করার উদ্দেশ্য। এর বিরুদ্ধে ১৯৬৯-এ পূর্ববাংলার মানুষ সংগঠিত করে গণ-অভ্যুত্থান। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করে ৬ দফা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে। এর পরের যে ইতিহাস, তা তো বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গৌরবকথা।

দেশী-বিদেশী যড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিপথগামী সেনাসদস্যদের দ্বারা ১৯৭৫-এর ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। মাত্র ৫৪ বছরের জীবৎকালে তিনি ছাত্রজীবনসহ সব মিলিয়ে প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় জেলেই কাটিয়েছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালের কারা-অন্তরালে থাকাকালে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের আত্মস্মৃতি , দীর্ঘদিন কারাগারে কাটানোর অভিজ্ঞতা এবং দু’বারের নয়াচীন ভ্রমণ নিয়ে নানান উপলব্ধির আখ্যান রচনা করেছিলেন।

দীর্ঘকাল পরে সেই ডায়েরিগুলো পাওয়া গেলে আমার বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থ পাই। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”। ” কারাগারের রোজনামচা” প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। ২০২০ সালে “আমার দেখা নয়াচীন” প্রকাশিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ পাঠ করলে চেনা যায় বঙ্গবন্ধুকে। জানা যায় তাঁর “বঙ্গবন্ধু” হয়ে ওঠার রাজনীতি। পাওয়া যায় “মানুষ” শেখ মুজিবুর রহমানকে।

চমৎকৃত হওয়া বিষয়, কোলকাতায় ছাত্রজীবন যাপন কালে যে শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একান্ত অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, নিরলস অনুগত সমর্থক ও কর্মী ছিলেন, পাকিস্তানের রাজনীতির জটিল পরিবেশে তিনি ধীরে ধীরে আপন চিন্তা-চেতনার আলোয় নিজস্ব গতিপথ বদলাতে নিচ্ছেন। নব দল গঠনে বেছে নিচ্ছেন মওলানা ভাসানীকে। যাঁর রয়েছে বিপুল সংখ্যক মুরিদ আর ব্যাপক ধরনের গণ-সমাজের সাথে সংযোগ।

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে নানা রাজনৈতিক দোলাচলের আকস্মিকতার মাঝে সোহরাওয়ার্দী সাহেব হঠাৎ করেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন।প্রচলিত আছে, তখন কোনো সভায় তিনি সম্ভবত বেফাঁস মন্তব্য করে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান তার দাবীকৃত সব প্রাপ্যই পেয়ে গেছে। এতে, তৎকালীন আওয়ামী লীগনেতা শেখ মুজিব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। অথচ, এর কিছুদিন আগ পর্যন্তও সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের দাবী-দাওয়া নিয়ে কেন্দ্রের কাছে দেন-দরবার করেছিলেন। এ প্রধানমন্ত্রিত্ব জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব খুব বেশি উপভোগ করতে পারেন নি।ক্ষমতায় ইস্কান্দার মীর্জা এসে তাঁকে উৎখাত করে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। বৈরুতের একটি হোটেলের রুমে প্রায় নির্বান্ধব অবস্থায় কুটিল রাজনীতিতে মারা যান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

পাকিস্তানের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইস্কান্দার মির্জাও টিকতে পারেন নি। বড়োই ক্ষমতার পিপাসা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর। এই পিপাসা পাকিস্তানের জন্ম থেকেই। ১৯৫৮ সালেই সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে ইস্কান্দার মির্জার তখত্ উলটে দেন। ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্যে তিনি মৌলিক গণতন্ত্রের নামে এক ভুয়া গণতন্ত্র চালু করেন। লোভী ও আদর্শহীন মানুষের একটি দল হয়ে ওঠে এর সহযোগী।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, এদেশেও একই ভাবে আদর্শ বিক্রয়কারী সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং দেশপ্রেমহীন কিছু বুর্জেয়া গোষ্ঠী জেনারেলের জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দলের খাঁচায় ভীড়ে গিয়েছিলো। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানের মিনি সংস্করণে পরিণত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলো। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও চেতনাকে বিনষ্টকারীদের কিন্তু আজও নিশ্চিহ্ন করা যায় নি এদেশ থেকে। আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্তরে ওরা এখনও সক্রিয় রয়েছে, অর্থনৈতিক কর্ম-প্রয়াসের আড়ালে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রতিকার ব্যবস্থার কর্মযজ্ঞ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আশাপ্রদ ভাবে দৃশ্যমান নয়। স্বীকার করতেই হবে, দেশের নানা অঞ্চলে যে সমস্ত ঘটনাবলী ঘটে চলেছে, তাতেই বোঝা যায়, প্রতিক্রিয়াশীলদের তুলনায় বহুলাংশেই কমজোরীর ধারা বয়ে চলেছে মুক্তি যোদ্ধাদের একালের প্রজন্ম।

শেষ কথা, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথেই আমার বিজয়ের ভরসা দেখতে পাই। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তার উন্নয়ন এক দশক উদযাপন করেছিলো। কিন্তু তার এক বছরের মধ্যেই, ১৯৬৯ সালে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করে, সেই মামলার আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন বন্ধ করে জেল থেকে মুক্তিদানের দাবীতে সারাদেশে সোচ্চার শ্লোগান ওঠে – “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”।
এই গণ-অভ্যুত্থানেই আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। একই ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে, সোনার বাংলা কায়েম করার জন্যে – আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার জাগরণ ঘটাতে হবে। আর, এ কাজটি করতে হবে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান সাধিত করে ।
★১৩ ই আগস্ট ২০২২★