মতামত

বঙ্গবন্ধু ও মুজিববাদ

— রবীন গুহ

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, ভরাট জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর, আবেগ ও যুক্তির সমন্বয়ে বিস্ময়কর মাদকতায় ভরা বক্তৃতা ইত্যাদি গুনাবলীর সমাহারের জন্য এদেশের ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিউইয়র্ক ভিত্তিক সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজউইক ১৯৭১ সালে ‘রাজনীতির কবি’(Poet Of Politics) হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। একটি অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত জাতিকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম আর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। বাঙ্গালীর সময়ের দাবীকে তিনি শিল্পীর নিপুন শৈলীতে কালজয়ী রাজনীতির ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রবীণ প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন, “মুজিবের ‘রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও মওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে।” ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের তার দীপ্তকন্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ হয়ে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জাগরণের মূলমন্ত্র। স্বাধীনতার পরে দেয়া এক ভাষনে নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি জাম্প করার মানুষ নই। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৩ বছর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি ইমপেশেন্ট নই। আমি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট নই।” তাঁর আজন্ম স্বপ্ন দীর্ঘদিনের শোষিত বাঙ্গালীর মুক্তির পথ স্বাধীনতার দিকে তিনি এগিয়েছিলেন-ধাপে ধাপে।

রাজনীতিতে সঠিক সময়ে সঠিক  রণকৌশল নির্ধারণের উপর নির্ভর করে সফলতা। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ২৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রণকৌশল নির্ধারণে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর রাস্ট্রচিন্তা ও রাজনৈতিক দর্শণে জনগণের আশা-আকাঙ্খার চূড়ান্ত রূপ প্রতিফলিত হয়। তাঁর জীবন-দর্শন-রাজনীতি-রাস্ট্রচিন্তার এক অপূর্ব মেলবন্ধন হিসেবে ‘মুজিববাদ’ পরবর্তিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে যথেস্ট গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনে যে রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা বা প্রচার করে গেছেন,তাই সংক্ষেপে মুজিববাদ বলা হয়। বঙ্গবন্ধু  এক সাক্ষাতকারে বলেন, “আমি মনে করি,  বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। আমার উপর্যুক্ত মতকে অনেকে বলছেন ‘মুজিববাদ’। এদেশের লেখক, সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কী নামকরণ করবেন সেটা তাদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোনো মোহ নাই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ণ। আমি চাই শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ! আমি চাই আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।” স্বাধীনতার পূর্বে যেমন ছিল ছয় দফা, স্বাধীনতা উত্তরকালে তা বদলে হয় সংবিধানের চার মূলনীতি -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীনতার পরে একটা মানবিক ও স্বাবলম্বী রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষে এই চারটি স্তম্ভের অন্তঃনিহিত গভীর দর্শনই মুজিববাদ নামে পরিচিত লাভ করে।

বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাদৃশ্যের মাধ্যমে যে ঐক্যানুভূতি গড়ে উঠেছে তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একদিনে গড়ে উঠে নি; বরং তা বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন শক্তিকর্তৃক শোষিত-বঞ্চিত হওয়া থেকে উদ্বুদ্ধ-উদ্ভূত ক্ষোভেরই ফলশ্রুতি। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পরিপুষ্ট করেছে। আর এটাই পূর্ণাঙ্গতা অর্জন করেছে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানী ভাবধারার মুসলিম জাতীয়তাবাদকে ছুড়ে ফেলে বাংলা ভাষা ও বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতিকেই বংগবন্ধু জীবনের পাথেয় করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় পরিচয়কে ছাপিয়ে বাঙ্গালীর আত্মপরিচয়ই হয়ে উঠে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রঃ ‘তুমি কে আমি কে? বাঙ্গালী বাঙ্গালী।’ একাত্তরের সেই শ্লোগান বাঙ্গালী উজ্জ্বীবিত করে, দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙ্গে বাঙ্গালী প্রথম আত্মপরিচয়ের ভিত্তিকে নিজস্ব রাস্ট্র গঠনের জন্য হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ বলে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীজীবনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “আমার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান…।”  মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বাঙালী পরিচয়কেই সব কিছুর উর্ধে তুলে ধরেছেন। “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে”- কথাটা তিনি বলেছিলেন ১৯৭২ সালের ১৬জুলাই।

সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন জাতিরাস্ট্র গঠনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য। একটা ধর্ম আরেকটা ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেনা, নিজ ধর্মের ভিতরেও কোন মত বা কাস্ট এর দোহাই দিয়ে কোন জোর খাটানো যাবেনা, রাস্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে পারবেনা এবং রাস্ট্র ব্যক্তির ধর্মীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ধর্ননিরপেক্ষতা বলতে এটাই বোঝায়। তবে এই নিয়ে নানা  বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধু দ্বর্থহীনভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে সে পালন করবে, কেউ বাধা দেবেনা-এটাই ধর্মনিরপেক্ষতা।

ব্রিটিশ দার্শনিক জন লকের মতে, গনতন্ত্র হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের সাপেক্ষে। বঙ্গবন্ধুও মনে করতেন, কারো কথা যদি যুক্তিসঙ্গত হয়, তবে সে সংখ্যায গরিষ্ঠ না হলেও তার কথা শুনতে হবে। গনতন্ত্রের আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নির্বাচন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের  ভোট পেয়েই প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে সবার অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে  নির্বাচন পরিচালনা করা গনতন্ত্রের পূর্বশর্ত। সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে জনগনের অংশগ্রহন ও কাজের ভাল-মন্দ বিবেচনা করে মতামত প্রকাশের অধিকার থাকবে। তথ্য জানার অধিকার থাকবে। রাজনীতির চোরাগলিতে তিনি কখনো হাটেননি, দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তিনি গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লড়াই ও ৭০ এর নির্বাচনের ভুমিধ্বস বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন।

আমরা নিরপেক্ষ নই,আমরা শোষিত বন্চিত মেহনতি মানুষের পক্ষে। এটাই হচ্ছে সমাজতন্ত্র। অন্যদিকে ধনতন্ত্র মানে, ফেল কড়ি, মাখ তেল। সবকিছুর জন্য টাকা দিতে হবে। বাজার অর্থনীতিতে পুঁজির আধিপত্য থাকে, মেধার আধিপত্য থাকে, অর্থবিত্তহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে সরকারের নীতিমালা করা হয়না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদ মেটানোর দায় সরকার নেয়না। বঙ্গবন্ধু সবসময় ছিলেন সাধারণ মানুষের পক্ষে। তিনি বলতেন, পৃথিবী আজ দুভাগে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। আজীবন তিনি শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। এদেশের ভাগ্যবঞ্চিত গরীব মানুষই ছিল উনার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে তিনি বলেন, “গরীব হবে এই রাষ্ট্র ও সম্পদের মালিক, শোষকরা হবে না।”  কুস্টিয়াতে তাঁর অন্য এক বক্তব্যে আরো স্পস্ট করে বলেন, “সম্পত্তি এখন সাড়ে সাতকোটি লোকের। যা উৎপাদন হবে সাড়ে সাত কোটি লোক ভোগ করবে। এদেশ শোষণহীন সমাজ হবে।” সেই সময়ের বিশ্বব্যাপী পুজিবাদ বিরোধী সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের যে ঢেউ তার  ছোঁয়া এসে আলোড়িত করেছিল তরুণ শেখমুজিবকেও। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানান দেন, “ চিলির আলেন্দের মত রক্তে লাল হয়ে যাবো, তবুও পুঁজিবাদের কাছে মাথা নত করবো না।” শেষে  নিজের জীবন দিয়েই কথাটার যথার্থটা প্রমান করে গেলেন।

একটা সময় ছিল, টিভি বা রেডিওসহ বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হতোনা, মাইকে ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচারও অতটা সহজ ছিলনা। কিন্তু পোস্টার, দেয়াল লিখন, বক্তৃতা ইত্যাদিসহ মানুষের মুখে মুখে ‘মুজিববাদ’ শব্দটি প্রচলিত ছিল। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ তখনো মুজিববাদী ছাত্রলীগ হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু “মুজিববাদ’ শব্দটির কথা আর তেমন শোনা যায়না, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও! পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে এদেশে যে পাকিস্তানী ভাবধারার রাস্ট্রব্যবস্হা কায়েম হয়েছে, বারবার সেখানে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাস্ট্রের চারমূলনীতিকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা আজও বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু আছেন কেবল নামে ও ছবিতে। তাঁর নীতি-আদর্শ-দর্শণের প্রয়োগ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এখন কেবল ছবি, ম্যুরাল আর দু-একটা ভাষণ প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। অথচ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শণ-রাজনীতিকে জানতে হলে ‘মুজিববাদ’ এর চর্চার প্রয়োজন। বাঙ্গালী জাতির সবচাইতে দুঃখের দিন ১৫ আগস্টের এই শোকের দিনে ‘মুজিববাদ’ এর চর্চা আর দেশ-পরিচালনা ও রাজনীতিতে তার প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমেই জাতির জনকের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।

১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেদিন শহীদ হওয়া তাঁর পরিবারের সকল সদস্য ও অন্যান্য সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

— রবীন গুহ

কৃতজ্ঞতাঃ

শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি, আবুল ফজল

বঙ্গবন্ধুর রাস্ট্রচিন্তা ও বর্তমান বাংলাদেশ, শামসুজ্জামান খান

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও বঙ্গবন্ধু, সাহেদ মন্তাজ

উইকিপিডিয়া