বিজ্ঞান প্রযুক্তি

তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রচার করা হচ্ছে

-প্রদীপ দেব

গত ২৯ জুলাই চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাইয়ের কাছে রেলগেটের দুর্ঘটনায় এগারোটি তরতাজা প্রাণ ঝরে গেছে। এরকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে প্রায়ই ঘটছে। অথচ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে এসব প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনাগুলির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসাই কাম্য ছিল। অন্যান্য আশাবাদী মানুষের মতো আমিও আশা করছি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্ত করছে এবং আর যেন এধরনের ঘটনা না ঘটে তার ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু গত ক’দিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রেললাইন, ট্রেন এবং চৌম্বকক্ষেত্রের বিজ্ঞানের নামে কিছু ভুল ধারণা প্রচার করা হচ্ছে। কার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এসব বের হয় আমি জানি না। অনেকে এধরনের লেখা শেয়ার করছেন – হয়তো এর ভেতরের বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যার ব্যাপারটা না বুঝেই। ভুল জানা, না জানার চেয়েও ভয়াবহ।

লেখাটিতে বলা হচ্ছে (১) ট্রেন আসার সময় গাড়ি যদি রেললাইনে উঠে, গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, চাকা অচল হয়ে যায়, গাড়ি রেললাইনে আটকে যায়। (২) ট্রেন চলার সময় ট্রেনের চাকার সাথে রেললাইনের ঘর্ষণের ফলে তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। (৩) সেই তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে ওই সময় কাছাকাছি কোন গাড়ি থাকলে তার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। (৪) ঐ সময় কোন মানুষ যদি লাফ দিয়ে রেললাইন পার হতে যায়, তাহলে সেই মানুষ সেখানে আটকে পড়বে। তড়িতচুম্বক ক্ষেত্র তখন সেই মানুষের সমস্ত শক্তি টেনে রাখবে এবং মানুষ মৃত্যুবরণ করবে।

ভাষার একটু এদিকওদিক ছাড়া প্রায় সবগুলি লেখাতেই মোটামুটি এরকম যুক্তি দেয়া হচ্ছে। কোন কোন লেখায় আবার উল্লেখ করা হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের জনৈক অধ্যাপকের নাম। আমাদের দেশের ক্লাস এইট-নাইনে পড়ুয়া শিক্ষার্থীও যদি তাদের বিজ্ঞানের ক্লাসগুলি ঠিকমতো বুঝে থাকে – তাহলে জানে যে কোন চুম্বকই অচৌম্বক পদার্থকে টেনে ধরে রাখতে পারে না। যেকোনো চুম্বক দিয়ে যে কেউই এই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

এবার তাদের যুক্তিগুলি দেখা যাক – (১) রেললাইনে উঠলেই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় – কথাটি সত্য নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে গাড়ির চালক কাছেই ট্রেন দেখে নার্ভাস হয়ে গিয়ে থাকতে পারেন, কিংবা অন্য কোন কারণে হাজারের মধ্যে একটি বা দুটি গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে – কিন্তু তার জন্য চৌম্বকক্ষেত্র জাতীয় কোন কিছু দায়ী নয়। তাছাড়া কোন কারণে যদি রেললাইনে বিদ্যুতের তার পড়ে রেললাইন বিদ্যুতায়িত হয়েও পড়ে – তাহলেও মোটর গাড়ির চাকা রেললাইনে আটকে থাকবে না। কারণ মোটর গাড়ির টায়ার বিদ্যুৎ অপরিবাহী।

(২) লোহার তৈরি রেললাইনের সাথে ট্রেনের লোহার চাকার ঘর্ষণে কিছুটা চুম্বকত্ব তৈরি হতে পারে – কিন্তু সেই চুম্বকত্বের শক্তি এবং স্থায়ীত্ব দুটোই খুব কম। ইনডাকশান বা আবেশ তৈরি হবার সাথে সাথেই তা নষ্ট হয়ে যায়। তড়িৎচুম্বক আবেশ যদি বেশি হতো ট্রেনের চাকা রেললাইনে আটকে থাকতো। আমি যে শহরে থাকি সেখানে অনেক রাস্তাতেই বৈদ্যুতিক ট্রাম চলে। ট্রামের লাইনের উপর দিয়েই মোটর গাড়ি চলে। মাথার উপর বৈদ্যুতিক লাইন, চাকার নিচে লোহার ট্রাম লাইন – (ট্রেন লাইন আর ট্রাম লাইন একই পদার্থের তৈরি, প্রায় একই রকম) – ট্রামের আগে, পিছে, পাশাপাশি সারাক্ষণ মোটরগাড়ি চলছে। বিজ্ঞান তো সব দেশেই একই রকম হওয়ার কথা।

(৩) তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে মোটরগাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই।

(৪) মানুষের শরীরের উপর তড়িতচুম্বক ক্ষেত্রের প্রভাব খুবই কম। এম-আর-আই করার জন্য যে পরিমাণ চৌম্বকক্ষেত্রের সৃষ্টি করতে হয় – তার জন্য অত্যন্ত উচ্চশক্তির বৈদ্যুতিক চুম্বকের দরকার হয়। কিন্তু সেই চুম্বকও কোন মানুষকে টেনে রাখতে পারে না। কারণ মানুষ অচৌম্বক পদার্থ। চুম্বক শুধু অন্য চুম্বক এবং চৌম্বক পদার্থকে টেনে রাখতে পারে। ট্রেন চলাকালীন লাফিয়ে ট্রেন লাইন পার হতে গেলে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে, ট্রেনের চাকার নিচে গিয়ে কাটা পড়তে পারে। কিন্তু ট্রেন লাইনের চুম্বক-ক্ষেত্র মানুষকে টেনে ধরে রাখবে এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের বিজ্ঞানপড়ুয়ারা যদি এসব না বুঝে থাকেন, তাহলে আমাদের স্কুলগুলির পাঠদানে কী সমস্যা তা খুঁজে বের করা দরকার।

লেখকঃ  প্রদীপ দেব, শিক্ষক ও গবেষক, মেডিকেল রেডিয়েশান ডিপার্টমেন্ট, আর-এম-আই-টি ইউনিভার্সিটি।