মতামত

জাহানারাদের মুক্তির সংগ্রাম কে এগিয়ে নেবে?

– ফজলুল কবির মিন্টু

জাহানার এবং সাথে তার প্রতিবন্ধী স্বামী

সিলেটের বিশ্বনাথে জন্ম জাহানারা বেগমের। জাহানারার বয়স ১৫/১৬ হলেও, তার পারিবারিক আর্থিক সংকটের কারণে অন্য দশজন দরিদ্র পরিবারের মেয়ের মতন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ৮০’র দশকে হঠাৎ করেই একদিন গ্রামের মুরুব্বীরা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। বর তারই খালাতো ভাই –যিনি একজন জন্মগতভাবেই বাক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী। বলতে গেলে জাহানারার বরের জন্মগতভাবেই কোন সংসার জ্ঞান ছিলনা। ইসলাম ধর্মেও  সংসার জ্ঞানহীন কোন ব্যক্তির বিয়ে করা বৈধ নয়। তারপরও গ্রামের মুরুব্বীদের চাপে জাহানারা বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয়। জাহানারার মতামত নেয়া হয়নি কিংবা তার মতামতের কোন গুরুত্বই ছিলনা।

জাহানারা নিয়তি ধরে নিয়েই বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী স্বামীর সাথে সংসার করতে থাকেন। জাহানারার সংসারে ৪টি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। মাশাল্লাহ মেয়েগুলো দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছে –যেন ফুটফুটে চাঁদের টুকরো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার ৫ সন্তানের মধ্যে কেবল একজন মেয়ে মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও বাকীরা সবাই বাবার মতনই মানসিক এবং বাক প্রতিবন্ধী। জাহানারার ঘর আলোকিত করে একে একে দুইজন নাতনিও এসেছে, তাদের মধ্যেও একজন বংশগতভাবে প্রতিবন্ধী। জাহানারার কেবল একটিই শান্তনা তার সন্তান এবং নাতনি সবাই শারীরিকভাবে বেশ স্বাভাবিক ও সুস্থ্য।

জাহানারাদের বিয়ের সময় গ্রামের লোকেরা অনেক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জাহানার নিজেও তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি শুনে মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন। দূরের নীল আকাশে উড়িয়েছিলেন স্বপ্নের হাজারো রঙিন ফানুস। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই প্রতিফলন ঘটেনি। জাহানারা আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশি কারও কাছ থেকেই কোন সাহায্য পায়নি। বরং একজন প্রতিবন্ধীর স্ত্রী হওয়ার কারণে পদে পদে তাকে নানা রকম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেই দিন যাপন করতে হয়।  ৫ সন্তান, স্বামী সহ সাত জনের সংসারের ঘানি জাহানারা একাই টানতে থাকে।

২০১২-১৩ সালের দিকে জাহানারা শ্বশুর শ্বাশুড়ি হ্বজে যান।  তারা হ্বজে থাকা অবস্থায় তার এক চাচাতো ভাশুর তাদেরকে ভিটে-বাড়ি ছাড়া করেন।জাহানারার পরিবারের সদস্যরা অন্য আট-দশ জন মানুষের মত স্বাভাবিক ছিলনা –এটাই ছিল তাদের অপরাধ।

এমনিতেই জাহানারার সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাই। সেই অবস্থায় জাহানারা ভিটে-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। আয়-রোজগারের জন্য জাহানারাই একমাত্র ভরসা। বাকীরা শারীরিকভাবে বড় হলেও মানসিকভাবে ৩ থেকে ৫ বছরের বেশী হয়নি –যেন সবাই অবুজ শিশু।

বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর জাহারানারা তার পরিবার নিয়ে একটি বস্তিতে উঠে। বস্তিতে গিয়ে অন্য আরেক বাস্তবতার মুখোমুখি হলো জাহানারা -তার মেয়েগুলো সুন্ধর হওয়াই যেন কাল হলো। বস্তির খারাপ লোকগুলোর লালসার শিকার হল তার ২৩-২৪ বছরের মেয়ে শিবলী বেগম। ঐ মেয়ের স্বামীও ছিল একজন মানসিক প্রতিবন্ধী।  তাদের দুই মেয়ে ছিল। একজন স্বাভাবিক হলেও অন্যজন ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। অভাব ছিল তাদের সংসারের নিত্য সঙ্গী। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে, শিবলী জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে নানান অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। জাহানারার সেই চাচাতো ভাশুর যিনি তাদেরকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করেন তার মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এতে। তিনি লোক লাগিয়ে ২০১৪ সালে শিবলী বেগমকে হত্যা করান বলে অভিযোগ রয়েছে।  এব্যাপারে স্থানীয় থানায় মামলা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না। মামলার আসামীরা কয়েক দিনের মধ্যে জামীন পেয়ে যান। মেয়ে হত্যার বিচারতো দূরের কথা উল্টো জাহানারাকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য  নানা হুমকি ধমকি দিতে থাকে। মেয়ে মারা যাবার পর মেয়ের প্রতিবন্ধি স্বামী এবং দুই মেয়ের দায়িত্বও জাহানার উপর এসে পড়ে। অভাব এবং দুঃসময় যেন জাহানারার পিছু নিতে থাকে। মেয়ে হারানোর শোকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া অসহায় জাহানারার জীবনে নেমে আসে আরও কঠিন বিপর্জয়।  মেয়ে মারা যাবার ৪/৫ বছর কেটে যাবার পর ২০১৮ সালে তার একমাত্র ২০-২২ বছরের বাক প্রতিবন্ধী ছেলে আলী আহসানও হারিয়ে যায়। এলাকার দুইজন ব্যক্তি লাল মিয়া এবং বাবুল মিয়া কাজের কথা বলে তাকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালিতে নিয়ে যায়। সেখানে ২০/২২ দিন কাজ করার পর তাদের ভাষ্যমতে আলী আহসান তাদের এক ভাতিজার সাথে স্থানীয় বাজারে গেলে সে আর ফিরে আসেনি। একদিকে ২০১৪ সালে জাহানারার এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে হত্যা করা হয় অন্যদিকে তার একমাত্র সন্তান নিখোঁজ হয়ে যাওয়া – পুরো বিষয়টা রহস্যজনক মনে হয়।  চট্টগ্রাম থেকে এসে লাল মিয়া এবং বাবুল মিয়া জানায় আহসান হারিয়ে গেছে। তারা ঐ সময় চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানায় একটা সাধারণ ডায়রি করেছে। এ ঘটনার অগ্রগতি বলতে এতটুকুই। এখানে যারা তাকে কাজের কথা বলে চট্টগ্রাম নিয়ে গেছেন তাদের কিংবা রাষ্ট্রের যেন আর কোন দায় নেই। অসহায়-দরিদ্র জাহানারা আর কিছুই করতে পারেনা – কি করা উচিৎ তাও সে বুঝেনা।  এলাকাবাসি-আত্মীয়সজন কিংবা প্রশাসন থেকেও সে কোন সহযোগিতা পায়না।

স্থানীয় একটি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছে- লাল মিয়া এবং বাবুল মিয়া

একমাত্র ছেলে আলী আহসানকে হারিয়ে জাহানারার জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। বেঁচে থাকাই অর্থহীন মনে  হয় তার কাছে। গভীর হতাশাই নিমজ্জিত হয় জাহানরা।

যার সাথে স্থানীয় বাজারে গিয়ে আলী আহসান হারিয়ে গিয়েছিল

জাহানারার বাড়ির পাশেই আছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ২০২০ সালের শেষের দিকে সৌভাগ্যক্রমে এই কেন্দ্রের স্পন্সর বৃটিশ নাগরিক আরশ আলীর সাথে জাহানারার পরিচয় হয়। তিনি জাহানারার বিষয়ে জানতে পারেন। আরশ আলী ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ মানবিক মানুষ ছিলেন তিনি জাহানারার পাশে দাঁড়ালেন। জাহানারার প্রতি তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। এতে জাহানারাও যেন গভীর অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো দেখতে পেলেন। আরশ আলীর সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে  জাহানারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। আর তখন থেকেই তিনি তার হারিয়ে যাওয়া ছেলেকেও খুঁজতে থাকেন। অনেকের কাছে এতদিন পর ছেলের সন্ধান চাওয়া অর্থহীন মনে হয়। তারা বলেন, এতদিন পর খুঁজে কী লাভ?

কিন্তু দুখিনী মা জাহানারা এসব শুনতে চাই না –সে ছেলের সন্ধান চাই। রাষ্ট্র কি জাহানারার পাশে দাঁড়াবে? তারা কি হারিয়ে যাওয়া ছেলে  আলী আহসানকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিবে? সচেতন মহল মনে করে  আলী আহসান হারিয়ে যাবার পর চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানায় যে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল সেটিকে নিয়মিত মামলা হিসাবে রেকর্ড করে তা তদন্তের দায়িত্ব র‍্যাব, পিআইবি কিংবা সিআইডিকে দিলে ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে যাদের সাথে আলী আহসান চট্টগ্রামে গিয়েছিল তাদেরকে পুলিশের তত্ত্বাবধানে নিয়ে জিজ্ঞসাবাদ করা হোক।

জাহানারা একজন দুখিনি মা। না-এমন অসহায়-দুখিনি কেবল জাহানারা একজন নয়। সারা বাংলায় গ্রামে গঞ্জে খোঁজ নিলে এরকম হাজারো জাহানারার সন্ধান পাওয়া যাবে। সমাজে অনেক নেতা নেত্রীর আবির্ভাব হয়। নানান উন্নয়নের গল্প শোনায়। কিন্তু জাহানারাদের কেউ দায়িত্ব নেয় না -জাহানারাদের মুক্তির কথা কেউ বলে না। ঘুনেধরা পুঁজিবাদি-অভিশপ্ত এ সমাজে অজস্র জাহানার মুক্তির সংগ্রামকে কে এগিয়ে নিবে? জাহানারাদের ভরসার জায়গা কি কোথাও নেই?

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি