চলমান সংবাদ

সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও মেগাপ্রকল্পের ধীরগতি বন্দরনগরীর জলাবদ্ধতার মূল কারণ

খালে বাঁধ সরানো হয়নি, নালা-নর্দমা পরিস্কার হয়নি, রেগুলেটর বসানো হয়নি মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতেই ডুবে যায় বন্দরনগরীর অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল। জলাবদ্ধতায় স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। বছরের পর বছর ধরে নেই একই চিত্র বন্দরনগরীর। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্পের কাজ চলমান। কয়েকবছর ধরে এসব প্রকল্প চলমান। প্রতিবছরই বলা হয় আগামীবার জলাবদ্ধতা সহনীয় মাত্রায় থাকবে। র্দীঘ সময় ধরে প্রকল্পগুলি চলমান থাকলেও কাজের অগ্রগতি তেমন না থাকায় নগরবাসীর ভোগান্তি ক্রমাগতই বাড়ছে। অপরদিকে অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্ট জলাবদ্ধতার এই দুর্ভোগের জন্য নগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবা সংস্থাগুলো বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন বিশিষ্ট নাগরিক ও নগর পরিকল্পনাবিরা। তারা বলছেন, তাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ঢাকতে সংস্থাগুলো এক অপরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পে ধীরগতি ও নানা অসঙ্গতির কারণে নগরবাসীকে বছরের পর বছর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মেগা প্রকল্পের আওতায় খালে দেয়া বাঁধ অপসারণ না করা এবং বিভিন্ন নালা-নর্দমা ময়লা-আবর্জনা ভর্তি থাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাই অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর নিম্নাঞ্চল ডুবে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা। রবিবার (১৯ জুন) নগরের নিচু এলাকা মরাদপুর, বহদ্দারহাট, ষোলশহর ২ নম্বর গেইট, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর, বাদুরতলা, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। নগরের বহদ্দারহাটে চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিমের বাসায়ও পানি ঢুকেছে। এরপর গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে মেয়রের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। এসময় তিনি প্রতিবছরের মতো এবারও একই কথা বলেছেন। জলাবদ্ধতার জন্য মেগা প্রকল্পের সংশিষ্টদের ওপর দোষ চাপালেন। তবে মেগা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো বাঁধ দেওয়া হয়নি। পানি নিষ্কাশনের পথ নগরীর নালা-নর্দমাগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হয়ে পড়েছে। আবর্জনা ভর্তি নালা দিয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাই অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর নি¤œাঞ্চল ডুবে যাচ্ছে। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনাবিদরা সেবাসংস্থাগুলোকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য না দিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন। ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। গত ৫ বছর ধরে সিডিএ স্লুইসগেট নির্মাণ শুরু করলেও তার একটিও পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের কোনো সুফলই পাচ্ছে না নগরবাসী। তার ওপর খালে বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা হচ্ছে দাবি করে গত মে মাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিটি কর্পোরেশনের মেয়রও। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান নির্মাণ প্রকল্পের জন্য খালের মুখে যেসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুলে দেওয়ারও দাবি জানান তিনি। তবে এই প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, শহরের কিছু কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে সেই বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি। এসব জায়গার পানি বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না। তবে বাঁধের কারণে পানি ওঠে এসে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে এমন কোনো বাঁধ আমরা দেইনি। দু একটা খালে বাঁধ থাকলেও জলাবদ্ধতা হচ্ছে না। খালের পুরো কাজটা আমরা এখনও শেষ করে উঠতে পারিনি। এখন পর্যন্ত ১২টি খালের কাজ শেষ করা হয়েছে। আরও ছয়টি খালের কাজ শেষ মুহূর্তে রয়েছে। আশা করছি খালের কাজ শেষ হয়ে আসলে জলাবদ্ধতা আগের চেয়ে কমে আসবে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন, জলাবদ্ধতার নিরসণে সেবা সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করতে হবে। সমন্বীত উপায়ে নগরীর কোথায় কোথায় পানি জমছে এসব জায়গা চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। কীভাবে খাল ও নালা পরিষ্কার করে পানি নিষ্কাশনে পথ নিশ্চিত করতে হবে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব’র কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, মেগা প্রকল্পের আওতায় খালে দেওয়া বাঁধ অপসারণ না করা এবং বিভিন্ন নালা-নর্দমা ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি থাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে পুরো নগরী তলিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ও বিপুল পরিমাণ বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, এ অবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনে জনগণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত, কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে নাগরিক পরিবীক্ষণ ও দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করে প্রকল্পের সুফল নগরবাসী যেন পান সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসণে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প ছাড়াও ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএ ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণ’ প্রকল্পের অনুমোদন পায়। পরের বছর থেকে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু করে সংস্থাটি। এছাড়াও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৯ সালে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো আরেকটি প্রকল্পের অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যাপ্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণ করা হবে। সেটির কাজও চলমান রেখেছে পাউবো। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) বিভিন্ন সময় খাল-নালা পরিষ্কারে প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। # ১৯.০৬.২০২২ চট্টগ্রাম #