চলমান সংবাদ

আদমশুমারি: জনসংখ্যা ও গৃহগণনার এবারের প্রক্রিয়াকে ‘ডিজিটাল জনশুমারি’ কেন বলা হচ্ছে

জুন মাসের এক সপ্তাহ সারা দেশজুড়ে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে।
জুন মাসের এক সপ্তাহ সারা দেশজুড়ে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে।

বাংলাদেশে ১১ বছর পর বুধবার থেকে শুরু হয়েছে জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে এই কার্যক্রম করা হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।

আগামী এক সপ্তাহ সারা দেশজুড়ে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ জনশুমারি করা হয়েছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।

সাধারণত প্রতি ১০ বছর পরপর বাংলাদেশে আদমশুমারি হয়ে থাকে। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত বছর আদমশুমারি হতে পারেনি।

কিন্তু কেন এবারের জনশুমারিকে ডিজিটাল জনশুমারি বলে বর্ণনা করছেন কর্মকর্তারা? অন্য বছরের তুলনায় এই শুমারিতে কী পার্থক্য রয়েছে? জনশুমারি ও গৃহগণনা কেনই বা করা হয়ে থাকে?

ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা

এর আগে আদমশুমারি বলা হলেও এবার এই জরিপকে জনশুমারি বলে ডাকা হচ্ছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে যে আদমশুমারি বা জনশুমারিগুলো করা হয়েছে, সেগুলো কাগজে-কলমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। তার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার খুব বেশি ছিল না। কিন্তু এবার প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হচ্ছে।

উনিশশো চুয়াত্তর সাল থেকে শুরু করে এর আগে বাংলাদেশে পাঁচটি আদমশুমারি করা হয়েছে। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোতেও প্রতি ১০ বছর পরপর আদমশুমারি হয়ে থাকে। এর মাঝে অবশ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অর্থসহ নানাখাতের জরিপ করে থাকে কর্তৃপক্ষ।

এবারের জনশুমারি প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ দিলদার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”এবার পুরো তথ্য সংগ্রহের কাজটি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে করা হচ্ছে। মাঠ থেকে আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহার করে এই কাজটি করছেন। শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহের কাজটিতে মানুষের সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু সেই তথ্য প্রক্রিয়া করা, যাচাই-বাছাই, পর্যালোচনার সব কাজ ডিজিটাল অবকাঠামো, সফটওয়্যার ব্যবহার করে করা হচ্ছে।”

তিনি জানান, এর আগে জনশুমারি কাগজে কলমে করা হলেও এবার পুরো প্রক্রিয়াটি করা হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

জনসংখ্যা
সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ২৩ লাখ। প্রতি ১০ বছরে অন্তত দুই কোটি জনসংখ্যা বাড়ে বলে ধারণা করা হয়।

এজন্য মাঠ পর্যায়ে সাড়ে তিন লাখের বেশি যে তথ্য সংগ্রহকারীরা কাজ করছেন, তাদের ট্যাব দেয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের সময় তারা সেই ট্যাবে তথ্য প্রবেশ করাচ্ছেন।

এরপর ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেটি মূল সার্ভারে চলে আসার কথা।

এভাবে করার মাধ্যমে একই ব্যক্তি বা বাড়ি দুইবার গণনা হওয়ার সুযোগ থাকবে না বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

এসব তথ্য বিশ্লেষণের জন্য সফটওয়্যারে তিনশোর বেশি নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে বিবিএস।

ওয়েবভিত্তিক ইন্টিগ্রেটেড সেনসাস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইসিএমএস) প্রস্তুতসহ জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমে (জিআইএস) এই কাজটি করা হচ্ছে।

মাঠ পর্যায়ের এসব তথ্য সংরক্ষণের জন্য গাজীপুরে বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানির সার্ভার ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্ভারে এসব তথ্য আসবে।

প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ দিলদার হোসেন দাবি করছেন, এসব তথ্য সম্পূর্ণ এনক্রিপ্ট অবস্থায় থাকায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত তথ্য শতভাগ নিরাপদ থাকবে।

কেন আদমশুমারি করা হয়?

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ইলোরা চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বুধবার সকালে একজন তথ্য সংগ্রহকারী এসে তার নিজের ও পরিবারের সব তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছেন।

”আমার নাম, জন্ম তারিখ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যাংক হিসাব ও বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে কিনা, কোথায় জন্ম হয়েছে, কি করি, বাসায় কে কে আছেন, তারা কি করেন, নিজের বাড়ি কিনা, সাবলেট আছে ইত্যাদি জেনে নিয়েছেন। কোন কাগজপত্র দেখতে চাননি। যা বলেছি, সেগুলো একটি ট্যাবে লিখে নিয়েছেন.” তিনি বলছেন।

এর আগে সর্বশেষ ২০১১ সালে একইরকম তথ্য তিনি দিয়েছিলেন বলে জানান।

জনশুমারির পাশাপাশি গৃহগণনা ও আর্থিক অবস্থাসহ ৩৫ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছে পরিসংখ্যান ব্যুরো
জনশুমারির পাশাপাশি গৃহগণনা ও আর্থিক অবস্থাসহ ৩৫ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছে পরিসংখ্যান ব্যুরো

প্রকল্পের পরিচালক মি. হোসেন বলছেন, ”জনশুমারিতে নেয়া এসব তথ্য পর্যালোচনার পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা, তাদের আর্থিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে কতগুলো বাড়ি আছে, সেসব বাড়িতে কতজন বসবাস করেন তাও জানতে পারা যাবে।”

একইসঙ্গে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ির ধরন, টয়লেটের সুবিধা, বিদ্যুৎ, পানি ও রান্নার জ্বালানির উৎস ইত্যাদি তথ্যও সংগ্রহ করছেন।

জনশুমারি ও গৃহগণনার এসব তথ্য গবেষণা, জাতীয় নির্বাচন, দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দ ইত্যাদি কাজে সহায়তা করবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

যেভাবে করা হচ্ছে জনশুমারি ও গৃহগণনা

মি. হোসেন বলছেন, ”বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম বা ওয়ার্ডে একজন করে তথ্য সংগ্রহকারী কাজ করছেন। তারা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে গিয়ে সেখানে বসবাসকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য নেবেন। সেই সঙ্গে ওই বাড়ির অবস্থা সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করবেন।”

গণনায় সারাদেশের মানুষের কাছে ৩৫টি তথ্য জানতে চাইবেন তথ্য সংগ্রহকারীরা। অনেক জরিপ নমুনা বাছাই করে করলেও আদমশুমারি ও গৃহগণনায় সারা দেশের মানুষকে আওতাভুক্ত করছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।

এজন্য সারাদেশে একযোগে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৭ জন গণনাকারী ট্যাবের (কম্পিউটার) সাহায্যে সাত দিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করবেন।

সেইসঙ্গে ৬৩ হাজার ৫৪৮ জন সুপারভাইজার, ৩ হাজার ৭৭৯ জন আইটি সুপারভাইজার, ৩ হাজার ৭৭৯ জন জোনাল অফিসার, ১৬৩ জন জেলা শুমারি সমন্বয়কারী এবং ১২ জন বিভাগীয় শুমারি সমন্বয়কারী কাজ করছেন।

প্রতি ১০ বছর পরপর বাংলাদেশে আদমশুমারি করা হয়ে থাকে
প্রতি ১০ বছর পরপর বাংলাদেশে আদমশুমারি করা হয়ে থাকে

এই ব্যক্তিরা মূলত তথ্য সংগ্রহের কাজ তদারকি করবেন। তবে আগে এসব তথ্য কাগজ-কলমে সংগ্রহ করার পর সেগুলো আবার নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিসংখ্যার ব্যুরোর প্রধান দপ্তরে নথিভুক্ত করতে হতো।

কিন্তু এবার ট্যাব ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে এসব তথ্য সংগ্রহ করায় তা তাৎক্ষণিকভাবেই বিবিএসের সার্ভারে জমা হচ্ছে।

একুশে জুন পর্যন্ত এভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলবে। এরপর এসব তথ্য বিশ্লেষণের কাজ শুরু হবে।

মি. হোসেন বলছেন. আগামী তিনমাসের মধ্যেই তারা জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে পারবেন বলে আশা করছেন।

আদমশুমারি নিয়ে কিছু তথ্য

  • ভারত উপমহাদেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ব্রিটিশ আমলে, ১৮৭২ সালে। পরের আদমশুমারি হয় ১৮৮১ সালে। এরপর থেকে এই উপমহাদেশে প্রতি ১০ বছর পরপর আদমশুমারি হয়েছে।
  • বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয় ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
  • প্রতি ১০ বছর পরপর ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ ও ২০১১ সালে আদমশুমারি ও গৃহগণনা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ২০২১ সালে না হয়ে একবছর পিছিয়ে যায়।
  • পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৬৩ লাখ। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ২৩ লাখ। প্রতি ১০ বছরে অন্তত দুই কোটি জনসংখ্যা বাড়ে বলে ধারণা করা হয়।
  • দুই হাজার এগার সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের সীমান্ত এলাকায় আদমশুমারি করে।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা