মতামত

প্রতিনায়ক এবং লাল সন্ত্রাস -লেখক ও বইয়ের রাজনৈতিক পর্যালোচনা – ২

-অপু সারোয়ার

 হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা খোঁড়া ছেলেটি

বিশ্ব  বিখ্যাত জার্মান গল্প। জনশ্রুতি,  প্রায় ৭০০ বছরের বেশি আগে জার্মানির ছোট শহর হ্যামিলিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর ভিত্তি করে গল্প রচিত। এই গল্পের সামান্য হেরফেরে বেশ কয়েকটি রূপ প্রচলিত রয়েছে। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা রূপকথার চেয়েও বেশি,গভীর ঐতিহাসিক রহস্যের প্রতীক । সাধারণ ভাবে গল্পটি হচ্ছে -হ্যামিলনের শহরের মানুষ ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল । ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য শহরের মেয়রের নেতৃত্বে  ঠিক করলেন, শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে এসে হাজির হলো রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। বাঁশিওয়ালা জানাল বাঁশির সুরে শহরকে ইঁদুর মুক্ত করা সম্ভব। শুনে সবাই অবাক। বাঁশিওয়ালাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কারের বিনিময়ে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করার আদেশ দিলেন মেয়র। বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন বাঁশিওয়ালা। বড় অদ্ভুত সেই সুর। তার বাঁশির শব্দ শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো সব ইঁদুর। যেখানে যেরকম ইঁদুর ছিল সবই বেরিয়ে এলো বাঁশিওয়ালার মায়াবী সুরের টানে। এক সময় ইঁদুরগুলোকে নিয়ে গিয়ে নিকটবর্তী  নদীতে ফেলে দিলো বাঁশিওয়ালা। এরপর পারিশ্রমিক চাইতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিল শহরের মেয়র ও গণ্যমান্য মানুষরা। রেগে গিয়ে তখনকার মতো শহর ছেড়ে চলে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। কিছুদিন পর এক ধর্মীয় উৎসবের দিনে শহরের বড়রা যখন গির্জায় জমায়েত হয়, তখন আবার ফিরে এলো বাঁশিওয়ালা। এবার তার বাঁশির সুরে বেরিয়ে এলো শহরের ছোট শিশুরা। তাদের সঙ্গে নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। শিশুদের মধ্যে একজন খোঁড়া বালক   পিছিয়ে পড়েছিল। এই খোঁড়া বালকটি নাকি ফিরে এসে এসব কথা জানাল শহরবাসীকে। গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হচ্ছে এক ভাবলেশহীন নির্দয় মানুষ। যিনি নগরকর্তার সাথে বিরোধের জেরে শহরের শিশুদেরকে নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল।

প্রতিনায়ক বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা শিরোনামে দশ পৃষ্টা ব্যাপী (৪২৫-৪৩৫ পৃষ্ঠা) একটি অধ্যায় লিখেছেন। এই দশ পাতার লেখায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হচ্ছে সিরাজুল আলম খান! সিরাজুল আলম খান রাজনীতির মানুষ, রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা করেছেন। সিরাজুল আলম খানের মূল্যায়ণ তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের আলোকে  ইতিহাসে  নির্ধারিত হবে। অতি মানবিক বা ভাবলেশহীন নির্দয় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হিসেবে উপস্থাপনের যুক্তি নাজুক। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা  বলতে যদি মহিউদ্দিন আহমদ সম্মোহনী শক্তির সিরাজুল আলম খানকে বুঝিয়ে থাকেন তবে তা খাপ ছাড়া উপমা।  যুদ্ধ পূর্ব কাল কিংবা যুদ্ধত্তোর কালে সিরাজুল আলম খানের সাথে যাঁদের রাজনৈতিক চিন্তার ঐক্য হয়েছিল তাঁদেরকে হ্যামিলনের গল্পের শিশু-কিশোর বা ইঁদুর ভাবা অন্যায় ও  উন্নাসিক। সিরাজুল আলম খানের সাথে  যাঁরা  যুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের উদ্যোগেই  জয় বাংলা স্লোগান, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রস্তাবনার সূচনা হয়েছিল। স্বতঃষ্ফূর্ত ভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ছাত্র বুদ্ধিজীবীরা ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন।

হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা  শিরোনামে সিরাজুল আলম খানকে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ভাবলেশহীন নির্দয় বাঁশিওয়ালার সাথে তুলনা করলেও  লেখার মুল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সিরাজুল আলম খানকে রাজনৈতিক ভাবে পুনর্বাসিত করার জন্য মহিউদ্দিন আহমদের ” অরাজনৈতিক ” প্রীতি সম্মিলনীর আযোজন। (১১)  কেন এই  আয়োজনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল তা মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্যে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে ” অর্থ শাস্ত্রে মার্জিনাল ভ্যালু বা প্রান্তিক উপযোগিতার তত্ব আছে। সঙ্গীরা একে তাঁকে ত্যাগ করায় তাঁর প্রান্তিক মূল্যমান ঠেকে শূন্যের কোঠায়। তিনি এখন ‘ৰেচিড অব পলিটিক্স’- রিক্ত, পরিত্যাক্ত। ” (১২)

‘ৰেচিড অব পলিটিক্স’- রিক্ত, পরিত্যাক্ত সিরাজুল আলম খানের প্রান্তিক মূল্যমানকে উপরে তোলার জন্য মহিউদ্দিন আহমদ বা শামসুদ্দিন  পেয়ারারা কলম ধরেছেন। বন্দনা ও দায় মুক্তি দেওয়ার প্রচেষ্টায়  মহিউদ্দিন আহমদরা  জাসদের খোঁড়া ( যুদ্ধাহত ) ছেলে কর্নেল তাহেরের উপর চড়াও হয়েছেন। বিভিন্ন জনের বয়ানে কর্নেল তাহেরের উপর দায় চাপানোর চেষ্টা চালিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। (১৩)

প্রতিনায়ক বইয়ের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা   অধ্যায়ের সহজ পাঠ থেকে জানা যায় লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ চটকদারি নামের পিছনের কাহিনী। এই কাহিনী উঠে এসেছে মহিউদ্দিন আহমদের কলমেই। ” ২০০০ সালে আমি [ মহিউদ্দিন আহমদ ] একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। একটি প্রীতি সম্মিলনীর আয়োজন করেছিলাম নীল ক্ষেতের আনোয়ারা রেস্টুরেণ্টে। নাম দিয়েছিলাম আনোয়ারা রেস্টুরেণ্টে ককাস [ caucus । ……………. আমাদের মধ্যমণি ছিলেন সিরাজুল আলম খান।” (১৪)  Caucus [ ককাস ] শব্দের অর্থ রাজনৈতিক গোষ্ঠী। সহজ ভাষায় লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ সিরাজুল আলম খান সমর্থক গোষ্ঠীকে সঙ্গবদ্ধ করতে উদ্দ্যোগী হয়েছিলেন ২০০০ সালে। সব মানুষের রাজনৈতিক মত -পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। মহিউদ্দিন আহমদের এই উদ্দোগ নস্টালজিয়া ককাস  [Caucus ] আনোয়ারা রেস্টুরেণ্টে ককাস  যে নামেই ডাকা হোক না কেন এই উদ্যোগ রাজনৈতিক।  মহিউদ্দিন আহমদ নিজেকে ৭৬/৭৮/৮০ সালের পরে রাজনীতির সাথে তিনি কোন ভাবেই সম্পর্কিত নন হিসেবে দাবী করে থাকেন।  (১৫) অপর দিকে নিজের লেখাতেই তুলে ধরছেন ২০০০ সালের ককাস  [Caucus ] রাজনৈতিক গোষ্ঠী গঠনের কথা।

আমি সিরাজুল আলম খান অনুলেখক শামসুদ্দিন পেয়ারা বইটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে একঝাঁক বহুল পরিচিত মৃত মানুষকে সাক্ষী রেখে জনাব খানের কথোপোকথন। প্রতিনায়ক বইয়ের হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা অধ্যায়ে লেখক জনাব খানের পথ অনুসরণ করেছেন !  লেখকের ভাষায় ” এ অনুষ্ঠান আয়োজনে আমাকে সাহায্য করেছিল প্রায়ত বন্ধু একরামুল হক। আমন্ত্রিতদের তালিকা মূলত তাঁরই তৈরী। (১৬)

লাল সন্ত্রাস

মহিউদ্দিন আহমদ দুই হাতে লিখে চলছেন। বই পুস্তকের নাম বেশ চটকদারী। প্রতিনায়ক , লাল সন্ত্রাস ইত্যাদি।  লাল সন্ত্রাস বইটি বামপন্থী নেতা সিরাজ সিকদার ও পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনীতি নিয়ে লেখা। বইয়ের নামের মত প্রচ্ছদ আকর্ষণীয়। পুরো পাতা জুড়ে সিরাজ সিকদারের ছবির নিচে লাল সন্ত্রাস লেখা। লাল সন্ত্রাস নামের পক্ষে সাফাই গেয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন ” বই বের করার আগেই একজন বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বিরূপ মন্তব্য করলেন। বইয়ের নাম লাল সন্ত্রাস নিয়ে তাঁর আপত্তি। কিন্তু বইটি পড়লেই দেখতে পেতেন, লাল সন্ত্রাস আমি নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করিনি। মাও সে–তুংও তো লাল সন্ত্রাস ব্যবহার করেছেন।” (১৭) নিদারুন উপমা। এক লাফে মাও সে–তুংও  এর সাথে তুলনা। মাও সেতুং কোথায় কোন লেখায় লাল সন্ত্রাস ব্যবহার করেছেন তা উল্লেখ করতে সক্ষম হন নাই জনাব মহিউদ্দিন আহমদ। মাও সেতুঙ প্রচুর লিখেছেন। ইংরেজী ভাষায় অন্তত মোঃ সেতুং রচনাবলী নয় খন্ড বই প্রকাশিত। মাও সেতুঙের প্রধান লেখায় লাল সন্ত্রাস শব্দের ব্যবহার নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত গবেষক মাও  সেতুং কোথায় লাল সন্ত্রাস ব্যবহার করেছেন তা উল্ল্যেখ করা থেকে বিরত থাকবেন ততক্ষন পর্যন্ত ‘ লাল সন্ত্রাস ‘ মাও  সেতুং এর নামে চালিয়ে দেওয়া নাম গোত্রহীন উদৃতির। কোন লেখকের ছবি বইয়ের প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহার করে বইয়ের নাম ‘ ফরমায়েশী লেখক’  দিয়ে পুস্তক প্রকাশ পুস্তক প্রকাশ করে ভিতরে লেখক সম্পর্কে অনেক ভাল কথা লেখা  তবে যেমন গ্রহণযোগ্য নয়। তেমনি সিরাজ সিকদারের ছবির নিচে লাল সন্ত্রাস গরু মেরে জুতা দানের কৌশল ।

মহিউদ্দিন আহমদ ” একজন বামপন্থী বুদ্ধিজীবী” এর নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন। লাল সন্ত্রাস নাম নিয়ে প্রাক্তন বামপন্থী, এনজিও লর্ড ফরহাদ মাজহারের বক্তব্য পত্রিকায় এসেছে। লাল সন্ত্রাস সম্পর্কে পত্রিকায়  প্রকাশিত ফরহাদ মাজহারের বক্তব্য  ”  তিনি [ মহিউদ্দিন আহমদ ] সর্বহারার রাজনীতিকে ‘লাল সন্ত্রাস’ মনে করেন। যদি চমক সৃষ্টি করা ও বাজার পাওয়ার জন্য এই শিরোনাম দিয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে আমি নিন্দা করি। আন্দাজ করতে পারি বইটি লিখেছেন বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি এবং দিল্লীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য বিপ্লবী প্রতিরোধের সম্ভাবনাকে আগেই নীতিবাদী জায়গা থেকে নাকচ করবার জন্য। পেটি বুর্জোয়ার মোরালিজম দ্বারা তিনি আক্রান্ত।

সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টির সমালোচনা হোক, তাদের গণবিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ডের নিন্দা হোক, সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থান আর গণবিচ্ছিন্ন সশস্ত্রতার পার্থক্য নিয়ে তর্ক হোক। তার দরকার রয়েছে। কিন্তু ‘লাল সন্ত্রাস’ কি? সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টি যদি ‘লাল সন্ত্রাস’ করে থাকে, তাহলে বাংলাদেশে ‘সাদা সন্ত্রাস করলো কারা? ” (১৮) ফরহাদ মাজহার বামপন্থী নন। ১৯৭৫ সালের পর থেকেই তিনি এনজিওর সাথে যুক্ত। ফরহাদ মাজহারের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান হেফাজত – বিএনপি ঘরানায়।

মহিউদ্দিন আহমদের লেখনীর বড় ও উজ্জ্বলতম দিক হচ্ছে তিনি অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্য সংগ্রহের চেস্টা করেছেন। সংগৃহীত সাক্ষাৎকার কিছু অংশ হিমাগারে রেখে – অপ্রকাশিত রেখে নির্বাচিত অংশের আলো আঁধারিতে ‘ ইতিহাসের গল্প ‘ বলেছেন লেখক। লেখকের নির্বাচিত অংশে যা উঠে এসেছে তা উচ্চ মার্গের বুদ্ধিবৃত্তিক দায় মুক্তির চেষ্টা। লাল সন্ত্রাস নাম নিয়ে সমালোচনার জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন ”  লাল সন্ত্রাস আমি নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করিনি। ” (১৯) গবেষকের দাবী যাই হোক না কেন , তিনি যে রক্ষীবাহিনীকে দায় মুক্তির চেষ্টা করেছেন তা স্পষ্ট। আনোয়ার উল আলম এর জবানীতে লাল সন্ত্রাস বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে ” আমি [ আনোয়ার উল আলম ] স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই , এ ব্যাপারে [ সিরাজ সিকদার ] রক্ষী বাহিনীর বিন্দু মাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না। (২০)  আনোয়ার উল আলম গঠন-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আত্তীকরণ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদের প্রতিনায়ক ও আনোয়ার উল আলমের রক্ষীবাহিনীর সত্য -মিথ্যা বই দুইটির সীমাবদ্ধতার অনেক গুলি বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকারী ( পুলিশ – রক্ষীবাহিনী কিংবা অন্য কোন ) সংস্থার হাতে থাকার পরেও কিভাবে খুন হলেন সিরাজ সিকদার। মহিউদ্দিন আহমদের প্রতিনায়ক বইয়ে ‘ আনোয়ার উল আলম’ নাম একটি অধ্যায় রয়েছে( পৃষ্ঠা ১৯৭  -২০০ পৃষ্ঠা ) ।  আর ‘ আনোয়ার উল আলমের রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা বইয়ে ‘ সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ( পৃষ্ঠা ৯৯ -১০৩ ) এর বক্তব্য অতি মাত্রায় মিল। দুই বইয়ের বক্তব্যই ‘ আনোয়ার উল আলমের। বক্তব্যের মিল থাকার মধ্যে কোন অসঙ্গতি নেই। অতি মাত্রায় মিল হচ্ছে ‘ আনোয়ার উল আলমের রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা ‘ বইয়ের সামান্য হেরফের ও ছোট আকারে প্রতিনায়ক বইয়ে জুড়ে দেওয়া।

সামান্য হেরফের পূর্ব প্রকাশিত বইয়ের অংশ বিশেষ ব্যবহার করাকে একাডেমিক -শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে  Plagiarism বলে। সাধারণের ভাষায় অন্যের লেখাকে নিজের নাম চালিয়ে দেওয়া।   শুধু মাত্র বইয়ের পিছনে তথ্য সূত্র হিসেবে পূর্ব প্রকাশিত বইয়ের নাম উল্ল্যেখ করার মধ্য দিয়ে Plagiarism থেকে দায় মুক্তির প্রচলন একাডেমিক -শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে  নেই। গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ পরিশিষ্ট তথ্যসূত্র ( পৃষ্ঠা ৪২৫ ) হিসেবে ” রক্ষীবাহিনীর সত্য -মিথ্যা”  লেখক আনোয়ার উল আলম এর বইয়ের কথা উল্ল্যেখ করেছেন । তবে প্রতিনায়ক বইয়ের কোন অংশের তথ্য সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত তার স্পষ্ট উল্ল্যেখ নাই। মানুষ চোখ দিয়ে জগৎ দেখে। তবে যখন সেই চোখে ধুলো পড়ে তখন মানুষ তা দেখতে পায়  না।

সেলফ সেন্সরশিপ এবং বদরুদ্দীন উমর প্রসঙ্গ

মহিউদ্দিন আহমদ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী – লেখক গবেষক, এনজিও লর্ড ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাকার পরিচয়ে পরিচিত। এমন মানুষের কাছে পাঠকের প্রত্যাশা অনেক। মহিউদ্দিন আহমদ নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা সম্পর্কে অতি আত্মবিশ্বাসী। মহিউদ্দিন আহমদ নিজের লেখার স্টাইলকে বাংলাভাষায় অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সাহিত্য লেখক গবেষক বদরুদ্দীন উমরের চেয়ে উত্তম হিসেবে দাবী করেছেন।  মহিউদ্দিন আহমেদের ভাষায় ”  বদরুদ্দীন উমর গবেষণামূলক বই–ই লিখেছেন বেশি। প্রবন্ধের ভঙ্গিতে লেখা এসব বইয়ে প্রচুর তথ্য আছে। কিন্তু ভাষাটা আকর্ষণীয় নয়। ফলে সাধারণ পাঠককে খুব আকৃষ্ট করে না। ” (২১)  বদরুদ্দীন উমরের লেখা প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য। মহিউদ্দিন আহমদ উমরের লেখা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা নির্ভেজাল অসত্য। সবচেয়ে বড়কথা বদরুদ্দীন উমর লেখার প্রচার প্রসারের জন্য প্রথমা প্রকাশনী মত কোন প্রকাশনীর মদদের দরকার পড়ে  নাই।  বদরুদ্দীন উমর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় শতাধিক বই লিখেছেন। বদরুদ্দীন উমর রাষ্ট্রীয় পুরুস্কার ও ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে লিখে গেছেন। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় বদরুদ্দীন উমর সম্পর্কে প্রতিবেদনের ভাষ্য ”  লেখক রাজনৈতিক জীবনে বদরুদ্দীন উমরের কোনো আদর্শচ্যুতি ঘটেনি, তাঁর চিন্তাচেতনার ধারায় ধারে হতবুদ্ধিতা বিভ্রম স্থান পায়নি, পাকিস্তান জমানা থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাঁর স্পষ্টবাদী আপসহীন স্পর্ধাগ্লানির কলুষতায় মলিন হয়নি, কোনো মোহ তাঁকে স্খলিত করতে পারেনি সর্বোপরি, তিনি শ্রমজীবীনিপীড়িত মানুষের মুক্তি মর্যাদার লড়াইয়ে দার্ঢ্যময় অবিচল এক সংগ্রামীর দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর স্ফটিক স্বচ্ছ শ্রেণিসচেতন দৃষ্টিভঙ্গিসংবলিত বিশ্লেষণ, ভাষ্য, গবেষণা লেখায় সমৃদ্ধ ১২০টি গ্রন্থ দিয়ে শুধু প্রতীকার্থেই নয়; সত্যিকার অর্থেই বদরুদ্দীন উমরকে অবিচ্যুত নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করায় ভ্রান্তি নেই (২২) বদরুদ্দীন উমরের স্পষ্টবাদিতার সাথে লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখকী স্টাইলকে জনাব আহমদের নিজেস্ব বয়ান দিয়েই তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। উভয় বক্তব্যই প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য ”  আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি ছিল সেটি লেখক হিসেবে যেমন আমার, তেমনি প্রকাশকেরও খুব বেশি নয় আমি কিছুটা সেলফ সেন্সরশিপ করেছি (২৩) সত্য উচ্চারণের জন্য  মহিউদ্দিন আহমদকে  ধন্যবাদ দিতে কার্পণ্য করার অবকাশ নেই।

সেলফ সেন্সরশিপ Self-censorship হচ্ছে  আনুষ্ঠানিক বাধার অনুপস্থিতিতে অন্যদের কাছ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে  তথ্য আটকে রাখা।  গণতান্ত্রিক সমাজের সঠিক কার্যকারিতার জন্য  সেলফ সেন্সরশিপ বাধা হিসাবে কাজ করে।  সেলফ সেন্সরশিপ তথ্যের অবাধ সঞ্চালন , মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধা দেয় । সেলফ সেন্সরশিপ তথ্য অবরুদ্ধ করে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে নতুন আলোকপাতের  বাধা সৃষ্টি করে । প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য থেকে জানা যায় আওয়ামীলীগ উপর লেখার সময় প্রথমা প্রকাশনীর কর্ণধার -মালিক মতিউর রহমান লেখার মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েছিলেন। (২৪) প্রথমা প্রকাশনীর কর্ণধারের এই হস্তক্ষেপের সাথে  সেলফ সেন্সরশিপের সম্পর্ক খুব বেশী দূরবর্তী নয়। সেলফ সেন্সরশিপ ও প্রকাশকের হস্তক্ষেপে লেখা বন্ধ রাখার অপর নাম হচ্ছে ফরমায়েশী লেখা বা ভাষ্য তৈরী। সেলফ সেন্সরশিপ বা খণ্ডিত ভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করার সত্য স্বীকারোক্তির জন্য মহিউদ্দিন আহমদকে ধন্যবাদ জানানোর কোন বিকল্প নেই। বদরুদ্দীন উমর কিংবা মহিউদ্দিন আহমদ দুই লেখকের মধ্যে কে পাঠকের গ্রহণ যোগ্য ভাষায় লিখেছেন তা পাঠক ও গ্রন্থ সমালোচকদের বিচারের উপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। বদরুদ্দীন উমরের লেখার সাথে ভিন্নমত পোষণের অনেকেই করতে পারেন। তবে শতাধিক বইয়ের লেখক বদরুদ্দীন উমরকে  বিভিন্ন বইয়ে পরস্পর বিরোধী তথ্য উপস্থাপনের অভিযোগে কেউ অভিযুক্ত করেন নাই। কিংবা বদরুদ্দীন উমর লিখতে বাধ্য হন নাই আগের তথ্যের সঙ্গে বইয়ে দেওয়া তথ্যের কিছু গরমিল থাকতে পারে  কিন্ত প্রতিনায়ক বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ বিভিন্ন স্বীকার করে নিয়েছেন লেখকের বিভিন্ন বইয়ে তথ্যের কিছু গরমিল রয়েছে।(২৫) মহিউদ্দিন আহমদ প্রতিনায়ক বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করনের ভূমিকায় ‘কিছু  অসংগতি ‘ এর কথা ও  অসঙ্গতি গুলি ‘শুধরে’ নেওয়ার দাবী করেছেন। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুদারতায়  অসংগতি গুলি উল্ল্যেখ করতে অসমর্থতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

 

তথ্য সূত্র:

১১) প্রতিনায়ক – সিরাজুল আলম খান। পৃষ্টা ৪৩০

(১২) প্রতিনায়ক – সিরাজুল আলম খান। পৃষ্টা ৪৩১

(১৩) অস্থির সময়ের রাজনীতি: জাসদের উত্থান পতন – মহিউদ্দিন আহমদ। পৃষ্ঠা- ১৭৯।

(১৪) প্রতিনায়ক – পৃষ্ঠা ৪৩০।

(১৫) বিবিসি -বাংলা – ৩০ অগাস্ট ২০১৭। মহিউদ্দিন আহমদ সাক্ষাৎকার ‘আমার তথ্যগুলো তাদের বর্তমান নষ্ট করে দিচ্ছে’

(১৬) প্রতিনায়ক – পৃষ্টা ৪৩০।

(১৭) মহিউদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকার: আমি পাঠককে ইতিহাসের গল্প বলেছি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান, ২৯ অক্টোবর ২০২১। প্রথম আলো।

(১৮)   মানব জমিন, ২২ মার্চ ২০২১ ।

(১৯) মহিউদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকার: আমি পাঠককে ইতিহাসের গল্প বলেছি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান, ২৯ অক্টোবর ২০২১। প্রথম আলো।

(২০) প্রতিনায়ক পৃষ্ঠা ১৯৯।

(২১) প্রথম আলো। ২৯ অক্টোবর ২০২১।

(২২) প্রথম আলো। ২০ ডিসেম্বর ২০২। “বদরুদ্দীন উমর এক অবিচ্যুত নক্ষত্র” লেখক ওমর তারেক চৌধুরী

(২৩) ২৯ অক্টোবর ২০২১। প্রথম আলো।

(২৪) পুর্বোক্ত

(২৫) প্রতিনায়ক – সিরাজুল আলম খান। পৃষ্টা ১৫ ।