মতামত

বিচার প্রার্থী শ্রমিকদের হয়রানী থেকে মুক্তি দেবে কে?

-ফজলুল কবির মিন্টু

কলিম উদ্দিন (ছদ্ম নাম) নামে একজন জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক ২০১৯ সালে আহত হন। আহত হওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন মালিকপক্ষ দেখাশুনা করলেও পরবর্তীতে আর কোন খোঁজ খবর নেননি। এমনকি তিনি চাকরিও হারান। অথচ শ্রম আইনে উল্লেখ আছে আহত শ্রমিক চিকিৎসা সুবিধা সহ ১ বছর পর্যন্ত সবেতন ছুটি পাবেন। এরপর আহত শ্রমিক যদি স্থায়ী পঙ্গু হয়ে যায় তাহলে তাকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এগুলি কিছুই পালন করা হয়নি। শ্রমিক বাধ্য হয়ে চট্টগ্রাম প্রথম শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেন। প্রায় ৩ বছর মামলা লড়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে শ্রমিক রায় পায়। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে শ্রমিককে ২ লক্ষ ১০ হাজার ৯ শত টাকার ক্ষতিপূরন প্রদানের জন্য আদালতের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। উক্ত রায়ের পর ভুক্তভোগী শ্রমিক রায়ের কপি মালিক পক্ষের নিকট হাতে হাতে পৌছে দেন কিন্তু মালিক পক্ষ কোন প্রাপ্তি স্বীকার না দেয়ায় পরবর্তীতে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে মালিক বরাবর মামলার রায়ের কপি প্রেরন করা হয়।

রায়ের কপি পেয়ে মালিক পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী শ্রমিককে প্রথমে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পরবর্তীতে ৮০ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ ১ লক্ষ টাকায় মিমাংসা করা প্রস্তাব দেয়া হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ প্রস্তাবগুলি এসেছে শ্রম আদালতকে ঘিরে একটি চক্রের মাধ্যমে। তারা  ১ লক্ষ টাকায় মিমাংসা করে নেয়ার জন্য শ্রমিক কলিমকে বিভিন্নভাবে প্রভোক করতে থাকে। ঐ চক্রটি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে এক লক্ষ টাকায় রাজি না হলে পরে ঐ এক লক্ষ টাকাও সে আর পাবেনা। পরে তার আম-ছালা দুই-ই যাবে। ইদানীং সবাই গরীবের বন্ধু সেজে বসে আছে। বলে তুমি বাপু গরীব মানুষ হয় আম নাও নয়তো ছালা। আম-ছালা দুইটা একসাথে চাইতে যেও না। পরে সবই হারাবে।

এ অবস্থায় কলিম উভয় সংকটে পড়ে যায়। সে বুঝতে পারেনা আম নিবে নাকি ছালা নিবে? সে মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করবে কি করবেনা তা নিয়ে দোটানায় পড়ে যায়। তাই রায় পাওয়ার প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলা করার সাহস করেনি।

উক্ত শ্রমিককে বুদ্ধি পরামর্শ-আইনী সহযোগিতা ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের একজন উচ্চ  পদস্থ একজন কর্মকর্তা। তিনি সম্প্রতি করনীয় নির্ধারনের জন্য ভুক্তভোগী শ্রমিককে আমার কাছে পাঠান। আমি চট্টগ্রামে ভুক্তভোগী শ্রমিকদেরকে আইনী সহায়তা দেয় এমন একটি বেসরকারী সংস্থায় তাকে নিয়ে যাই।

সাধারণত মামলার কাগজপত্র বুঝিয়ে দিলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ২/৩ দিনের মধ্যে আদালতে মামলা ফাইল করে দেন। কিন্তু এবার কেন জানি একটা গেড়াকলে আটকাই গেলাম। প্রায় একমাস হয়ে গেলেও এখনো মামলা ফাইল করাতে পারিনি।  আমাদের আইনজীবীর এক কথা এডি কপি ছাড়া ফৌজদারী মামলা করলে মামলা হাল্কা হয়ে যাবে। অথচ শ্রম আদালতে মামলা করেন এমন আইনজীবীর সাথে কথা বলে আমি নিশ্চিত হয়েছি –শুধুমাত্র ডাক বিভাগের স্লিপ দেখিয়ে ফৌজদারী মামলা করার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নাই। আমি এখন এক মহা সংকটে পড়েছি। ভুক্তভোগী শ্রমিক বার বার ফোন করে জানতে চায় কিন্তু কী জবাব দেব আমি বুঝতে পারছিনা। এতদিন মনে করতাম আদালতে মামলা দায়ের করার পর বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা কিংবা বিচারক শূন্যতা কিংবা বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের সময় ক্ষেপন ইত্যাদি কারণে বিচার প্রার্থী শ্রমিক হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু যার মাধ্যমে শ্রমিকেরা বিচার চাইবে, তিনিও যদি মামলা করতে সময় ক্ষেপন করেন, তাহলে অসহায় শ্রমিকগুলি কার কাছে  যাবে?  বিচার প্রার্থী শ্রমিকদের হয়রানী থেকে মুক্তি দেবে কে? আমি আসলেই খুব হতাশ। বাস্তবে আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি