চলমান সংবাদ

সীতাকুন্ডে বিস্ফোরণ-আগুন নিখোঁজ প্রিয়জনের সন্ধানে স্বজনদের উৎকন্ঠা

কাভার্ডভ্যান চালক মো. আকতার হোসেন (২২)। সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন তিনিও। আগুনের ভয়াবহতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। ১১ মিনিট ভিডিও করার পর আর দেখা যায়নি তাকে। ঘটনার পর থেকে মুঠোফোনও বন্ধ রয়েছে এ যুবকের। ৩ দিনেও খোঁজ না পাওয়ায় দিশেহারা তার পরিবার। ঢাকা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও ছেলেকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন আকতারের ৭৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা নুরুল আমিন। মঙ্গলবার (৭ জুন) দুপুরে ছেলের খোঁজে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি। সঙ্গে ছিলেন আকতারের বড় বোন মুন্নি আক্তার রোকসানা। এসময় তারা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দেন নির্দিষ্ট বুথে। ছেলের শোকে হতভম্ব পিতা কথা বলতে পারছিলেন না। আকতার হোসেনের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলায়, তিনি বিএম ডিপোর গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আকতাররা ৩ ভাই, ১ বোন। মুন্নি আক্তার বলেন, অগুন লাগার দৃশ্যটি আমার ভাই ফেসবুকে লাইভ করছিল। লাইভটি ছিল ২০ মিনিটের। লাইভের ১১ মিনিটের মাথায় বিকট শব্দ এবং চারদিকে অন্ধকার। আর কোন কিছু দেখা যায়নি। আমার ভাইয়ের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি কিন্তু ভাইয়ের দেখা পাইনি। তাই মরদেহ শনাক্তে নমুনা দিলাম। মুন্নি বলেন, আমরা তিন ভাই হলেও আকতারই মা-বাবাকে দেখতো। বাবার ওষুধের খরচ হতে শুরু করে সবকিছু সে-ই করতো। তাকে ছাড়া আমাদের পরিবার কিভাবে চলবে? আমাদের কে দেখবে? শুধু আকতার হোসেন নন, সীতাকুন্ডের কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও খোঁজ নেই অনেকের। প্রিয় মানুষটি বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে- তাও জানেন না স্বজনেরা। প্রিয়জনের মরদেহ পেতে মঙ্গলবার (৭ জুন) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভিড় করেছেন স্বজনেরা। বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে শনাক্তবিহীন মরদেহ শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। নমুনা সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত বুথে গত দুইদিনে ৪০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ২২ জনের খোঁজে তারা নমুনা দিয়েছেন। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজটি করছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। গত শনিবার রাতে সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ-আগুনের ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরের দিকে আরো দুটি লাশের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়। পরে লাশ দুটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ নিয়ে উদ্ধার লাশের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৩। বিস্ফোরণে হতাহতের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান আহসান জানান, নিহত ব্যক্তিদের ২৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এসব মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি মরদেহগুলো বর্তমানে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। নিখোঁজদের একজন মো. আব্দুল মনির হোসেন(২৮)। বাড়ি সীতাকুন্ডের উত্তর ফকিরপাড়ায়। কাজ করতেন বিএম ডিপোর এফএলটি অপারেটর (ক্রেন চালক) হিসেবে। শনিবার (৪ জুন) সন্ধ্যায় রাত্রীকালীন ডিউটিতে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের আগে বাড়িতে জানিয়েছিলেন বেঁচে থাকলে পরে কথা হবে। সেটিই মনিরের শেষ কথা। এরপর থেকে পরিবার জানে না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী ও নিহতদের মধ্যে তাকে শনাক্ত করতে পারেনি স্বজনেরা। তবে শেষ বারের মতো একবার মনিরকে দেখতে চান তার পরিবার। মনিরের খোঁজ পেতে তার বড় ভাই মোহাম্মদ আলমগীর ব্যানার হাতে সকাল থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন চমেক হাসপাতালের সামনে। তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর রাতেই বাড়িতে জানিয়েছিল মনির। কথা বলার একপর্যায়ে বেঁচে থাকলে পরে কথা হবে বলে ফোন কেটে দেয়। এটাই তার সঙ্গে শেষ কথা। এরপর থেকে ফোন বন্ধ। মঙ্গলবার সকালে আলমগীর জানান, মনির হোসেন বিএম কনটেইনার ডিপোতে কাজ করতেন। শনিবার ঘটনার দিন ডিউটি ছিল মনিরের। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্ত্রী ও মায়ের কাছ থেকে প্রতিদিনের মতো বিদায় নিয়ে কর্মস্থলে যান তিনি। পরে রাতে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ডিপোতে আগুন লাগার খবর জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চান। এরপর থেকে বন্ধ মনিরের মোবাইল। ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলামের (২৬) খোঁজ নেই বিস্ফোরণের পর থেকে। সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোতে লাগা আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন শফিউল। ঘটনায় ৩ দিন পরও খোঁজ মেলেনি তার। এমনকি শনাক্তবিহীন লাশগুলোর সঙ্গেও মেলেনি তার ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল। তার খোঁজে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে এসেছেন তার স্বজনেরা। শফিউলের বৃদ্ধ বাবা আব্দুল মান্নান হোসেনও ছুটোছুটি করছেন ঢাকায়। কুমিরা ফায়ার স্টেশনে কাজ করতেন শফিউল, বাড়িতে তার ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রয়েছেন। গত বছরেই বিয়ে করেছিলেন শফিউল। তার স্ত্রী আঁখি খাতুন কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার স্বজনেরা জানান, পরিবারের দুই সন্তানের মধ্যে শফিউল ইসলাম বড়। তিনিই একমাত্র সংসারের হাল ধরেছিলেন। নিখোঁজ শফিউলকে অক্ষত পাওয়ার আশা একেবারেই ক্ষীণ জেনেও খোঁজ চালাচ্ছেন তার স্বজনরা। তাদের আশা স্বজনকে মৃত পেলেও মনকে বোঝাতে পারবেন। শফিউলের ছোট ভাই মামুন চট্টগ্রামে এসে ভাইয়ের লাশ শনাক্তে ডিএনএ টেস্ট করান। কিন্তু টেস্টের প্রাথমিক ফলাফল শনাক্তবিহীন লাশগুলোর সঙ্গে মেলেনি। এ কারণে শফিউলের পরিবার এখন চরম হতাশার অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে। শফিউলের বাবা আব্দুল মান্নান জানান, তার ছোট ছেলে মামুনের ডিএনএ টেস্টের ফলাফলের উপর তাদের অনেকটাই প্রত্যাশা ছিল ছেলের লাশ খুঁজে পাবার। কিন্তু সেটাও হলো না। এখন ছেলেটি কোথায় কী অবস্থা আছে এটা তারা বুঝতে পারছেন না। দু’দিন ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করে ছেলের খোঁজ না পাওয়ায় সোমবার রাতে বাড়ি ফিরেছি। ছোট ছেলে মামুন এখনও চট্টগ্রামে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালগুলো খুঁজে ফিরছেন। # ০৭.০৬.২০২২ চট্টগ্রাম #