মতামত

রবি-অভিনাথের বেদনার্ত জীবনের পাঁচালী

-সুভাষ দে

সুভাষ দে (ফাইল ছবি)

রাজশাহীর বাগমারার আদিবাসী কৃষক রবি মারান্ডি ও অভিনাথ মারান্ডি (সম্পর্কে ওরা দুই ভাই) গভীর নলকূপের সামনে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেন। তাঁরা তাদের জমিতে বোরো ধান চাষের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকদিন যাবত পানির জন্য আবেদন করেও জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য পানি পাচ্ছিলেন না। পানি না পেলে ধান গাছ শুকিয়ে যাবে, তাদের কষ্টের রূপালী শস্য বিবর্ণ হয়ে যাবে- তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের পরিপূর্ণ শস্য ঘরে না ওঠলে মহাজন-এনজিও’র ঋণ শোধ করা যাবেনা, স্বজন-সন্তানদের মুখে অন্ন উঠবেনা – এসব ভয়াবহ আশঙ্কা তাদের জীবনকে অর্থহীন করে তুলেছিলো। যে পানির জন্য হাহাকার করেছে রবি আর অভিনাথ -পানির সেই উৎস গভীর নলকূপের সামনেই তারা কীটনাশক পান করে আত্মাহুতি দিয়েছে।
জীবনের এই যে করুণ পরিণতি তার দায়ভার কে নেবে? রবি অভিনাথের অকালে জীবন থেকে ঝরে যাওয়া যে ট্রাজেডির জন্ম দিলো তাতে কী আমাদের সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রের কিছু আসে যায়! প্রতিটি কৃষকের যে অবদান আমাদের কৃষিতে তাতে রবি অভিনাথের শ্রম আছে-আমরা তা ভুলি কেমন করে।
সরকার রবি-অভিনাথের আত্মহত্যার ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে। আমাদের দেশে নানা ঘটনায় শত শত তদন্ত কমিটি হয়, প্রতিবেদনও হয় কিন্তু দোষীরা শাস্তি পেয়েছে এমন দৃষ্টান্ত হাতে গোনা। একজন অপারেটরের মর্জির ওপর কৃষকদের ভাগ্য ঝুলবে-এতবড় মাথাভারি প্রতিষ্ঠান, তাদের কর্মকর্তাদের কোনো দায়িত্ব নেই?
আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, এই কৃষকেরাই জাতির মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। করোনা মহামারিকালে আমাদের জীবন-যাপনে খুব একটা শোচনীয় অবস্থা হয়নি, কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল বলেই। শুধু চাল উৎপাদন নয়, মাছ, ফল, মাংস, দুধ, সবজি, আলু প্রভৃতি উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ কয়েকটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ-আর এটি সম্ভব হয়েছে কৃষক ও চাষিদের কল্যাণে।
সরকার ধান চাল কেনে কৃষকদের কাছ থেকে তাও সময়ে নয়। মিল মালিকরা তার আগেই ওঁৎ পেতে থাকে। কৃষকরাও ঋণ পরিশোধের জন্য মাঠে থাকতেই ফসল বিক্রি করে দেয়। কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কৃষি উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কৃষক পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া করোনার সময় বন্ধ হয়ে গেছে, অসুখ বিসুখে খরচ মেটানো দায়। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের এক তথ্য অনুযায়ী দেশের কৃষক সমাজের মধ্যে ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি। তারা যে কীটনাশক ব্যবহার করেন জমিতে, সেই সময় তারা সুরক্ষা পোশাক পরেন না-তাদের নেইও, রাসায়নিক কীটনাশক ছিটানোর সময় কিছু অংশ তাদের চোখে মুখে শরীরে ঢুকে যায়। আস্তে আস্তে নানা রোগ তাদের দুর্বল করে তোলে। রাষ্ট্র কি তাদের এই দুরবস্থার খবর রাখে! সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ালে কৃষকরা বিপাকে পড়েন, চাষের খরচ বেড়ে যায়।
আমাদের দেশে কৃষকদের শক্তিশালী সংগঠন নেই, অভাব, অনটন, রোগ-শোক তাদের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে কৃষকরা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন যা বড় ব্যবসায়ীরা, বিত্তবানরা করেন না। শক্তিশালী সংগঠনের অভাবে তারা ফড়িয়াদের সাথে, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সাথে তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির ন্যায্য দাম পেতে দর কষাকষি করতে পারেন না। সমবায় সমিতি না থাকায় উৎপাদিত ফসল বিক্রিতে তারা সমস্যায় পড়েন। পানির দামে উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলি কৃষকদের এতসব বিষয়ে নিয়ে মাথা ঘামায় না। এক সময় বামদলগুলোর কিছু কৃষক সংগঠন ছিলো, এখন তেমন নেই। এখন এনজিও ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কৃষকদের চেপে ধরছে নানা কৌশলে।
অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারতে দেখুন, গত বছর পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের কৃষকরা হরিয়ানা থেকে দিল্লী পর্যন্ত জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দীর্ঘ ১ বছর আন্দোলন করেছে পার্লামেন্টে কৃষি ও কৃষকবিরোধী আইন পাশ হওয়ার প্রতিবাদে।
তারা তাঁবু খাটিয়ে জীবনযাপন করেছে। পরিবার, পরিজনসহ অনেক কৃষক রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে। কৃষক নেতারা তাদের সন্তানদের জন্য অস্থায়ী স্কুল খুলে লেখাপড়া চালিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী তাদের এই আন্দোলন সাড়া জাগিয়েছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে কৃষকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে পার্লামেন্টে পাশ হওয়া গণবিরোধী ৩টি আইন তুলে নিয়েছেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এ ঘটনা থেকে কোন শিক্ষা নিয়েছেন কী!
দুইজন কৃষক সেচের জন্য পানি না পেয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। কোনো প্রতিবাদ সমাবেশ, কৃষকদের প্রতি সহানুভুতি, সহমর্মিতা কিংবা এর প্রতিবাদে আন্দোলন দেখা গেছে কী! মতিয়া চৌধুরী যিনি কৃষিতে আমাদের সাফল্যের অন্যতম দিশারি তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারতেন বামপন্থি নেতারা দুই আদিবাসী পরিবারের পাশে, কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে কী!
স্থানীয়ভাবে কিছু প্রতিবাদ হয়েছে, জাতীয়ভাবে রাজনীতিতে কোনো আঁচড় লাগেনি। কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর কবিতার একটি বিখ্যাত লাইন ‘অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’-পারেনি। রবিও অভিনাথ রোদ্দুর থেকে তাপ পেতে চেয়েছিল, পায়নি; বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তির তীব্র আঁচে ঝলসে গেলো তাদের জীবন।