মতামত

রাশিয়া-ইউক্রেন, দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের সম্পর্ক যেভাবে ধীরে ধীরে যুদ্ধের দিকে এগোতে থাকে (পর্ব-২)

— রবীন গুহ

কিয়েভে ২০০৪ সালে পাশ্চাত্যদের সমর্থনপুষ্ট অরেঞ্জ রিভ্যুলিউশন

২০০৪ সালে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে রাশিয়ানপন্থী প্রার্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু পশ্চিমা সমর্থকদের অংশগ্রহনে ঘটে যাওয়া ‘অরেঞ্জ রিভ্যুলেশন’ তাকে জালিয়াতির অভিযোগের মধ্যে জয়ী হতে বাধা দেয়। একপর্যায়ে পশ্চিমাপন্থী রাজনীতিবিদ ভিক্টর ইউশচেঙ্কো প্রেসিডেন্ট হন। তার বিজয় রাশিয়ান ফেডারেশনের ইউক্রেন বিষয়ক পররাস্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের সূচনা বিন্দু হয়ে ওঠে। মস্কো এই ‘অরেন্জ রিভ্যুলেশন’ বা  “রঙীন বিপ্লব” পশ্চিমা শক্তির মদদপুস্ট বলে তা প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। এই থেকে ভ্রাতৃপ্রতীম দু’দেশের মধ্যকার বিরোধ দৃশ্যমান হতে শুরু করে, যা পরবর্তিতে ক্রমশঃ অবনতির দিকেই এগোতে থাকে।

ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর শাসনকালীন সময়ে রাশিয়া দু’বার  ইউক্রেনের গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করেছিল )২০০৬ ও ২০০৯ সালে), যা ইউরোপে গ্যাস ট্রানজিট সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করেছিল। ফলশ্রুতিতে ইউক্রেন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচন্ড শীতে গ্যাসের অভাবে বাড়ী-ঘর গরম রাখাসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা চালু রাখা দায় হয়ে যায়। কারণ হিসেবে রাশিয়া গ্যাসের মূল্য বর্ধিত করে চুক্তি পুনঃবিবেচনার দাবী জানায়।

এরই মধ্যে দু’দেশের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের আগুনে ঘি ঢালতে শুরু করে আমেরিকা। মূল ঘটনাটি ঘটে ২০০৮ সালে বুখারেস্টে ন্যাটো সম্মেলনে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইউক্রেন এবং জর্জিয়াকে ন্যাটো অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালায়। এতে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে পুতিন। পুতিন তীব্রভাবে আপত্তি জানিয়ে বলেন, ইউক্রেন স্বাধীনতার অজুহাতে ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়া কিছুতেই মেনে নেবেনা। নিজের  সীমানার পাশে সামরিক জোট ন্যাটোর অবস্হান শীতল যুদ্ধকালীন সময়ের শক্তিধর দেশটি কিছুতেই মেনে নিতে রাজী নয়। এটা রাশিয়ার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের উপর বড় মাপের হুমকি বলে মনে করে দেশটি। জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যস্হতায় এ যাত্রায় বুশের পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। তবে, ইউক্রেন এবং জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্যপদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, যদিও কোন সময়সীমা নির্ধারিত করা হয়নি।

২০১৪ সালে রাশান সৈন্যদের ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ

ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে  দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় জেনে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পথ খুঁজতে থাকে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি  মস্কোকেও খুশী রাখতে চান। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে এক বিশাল বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলেন – যা প্রকারান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। পরিস্হতি অনুমান করতে পেরে ২০১৩ সালের গ্রীষ্মে রাশিয়া  কিয়েভের উপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে এবং রাশিয়া সীমান্তে ইউক্রেনীয় রপ্তানি প্রায় বন্ধ করে দেয়। ফলে তৎকালীন ইউক্রেনের ইয়ানুকোভিচ সরকার  ইউরোপীয়  ইউনিয়নের সাথে একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি স্থগিত করেতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদে শীঘ্রই ইউক্রেনে পশ্চিমা সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারি  মাসে রাস্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান।

এসময় ইউক্রেনে একটি রাজনৈতিক শক্তির শূন্যতা দেখা দেয়। রাশিয়া এই সুযোগে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে  ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং রুশ ফেডারেশনের সাথে সংযুক্ত করে। এটি ছিল দু’দেশের সম্পর্কের বড় রকমের একটি টার্নিং পয়েন্ট, একটি অঘোষিত যুদ্ধের সূচনা। পশ্চিমারা নানা রকমের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও, রাশিয়া সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি। উপরন্তু, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভর্তুকি-ভাতাসহ নানা রকমের সুযোগ সুবিধা দিয়ে রাশিয়া  ক্রিমিয়ার জনগণের মন জয়ও করে। সেখানকার অধিকাংশ জনগণও রাশিয়ার  নাগরিক হিসেবে নিজেদের মেনে নেয় অনেকটা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই। ক্রিমিয়া এখন রাশিয়ার অংশ-এটাই বাস্তবতা, ভেতরে ভেতরে এমনটা মনে করেন খোদ পশ্চিমাদেরই কেউ কেউ!

রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি পূর্ব ইউক্রেনের শহরগুলোতে জাতিগতভাবে রুশদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এই সময়ে রাশিয়ান এবং স্থানীয় আধাসামরিক বাহিনী ইউক্রেনের পূর্বের শহর  ডনবাসে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রাদুর্ভাবকে উস্কে দেয়॥ পাশ্ববর্তী অন্যান্য শহর দানেটস্ক এবং লুগানস্কে  “জনগণের প্রজাতন্ত্র” ঘোষণা করা হয়েছিল, যাদের নেতৃত্বে ছিল অচিহ্নিত ইউনিফর্মে রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে আসা লোকজন। কিয়েভ প্রতিক্রিয়া দেখায় তবে খুব ধীরে ধীরে, ২০১৪ সালের মে  মাসের শেষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে এবং শুধুমাত্র তখনই বৃহৎ আকারের শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়, যা দীর্ঘস্হায়ী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রূপ নেয়।

২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ব্যাপক হামলা চালিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পিছনে ঠেলে দিতে শুরু করে। পরে আগস্টের শেষে রুশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইলোভাইস্কের কাছে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পরাজিত করে। যদিও যুদ্ধে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহনের কিয়েভে অভিযোগ মস্কো অস্বীকার করে। সে বছরের সেপ্টেম্বরে বেলরুশিয়ার রাজধানী মিনস্কে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্মুখ যুদ্ধের শেষ হয়েছিল, যে চুক্তিটি পরবর্তিতে  দ্রুত ভেঙেও যায়।

থেমে থেমে যুদ্ধ চলতেই থাকে। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। কিয়েভ আবারও মস্কোকে একটি অচিহ্নিত সেনাবাহিনী ব্যবহার করার জন্য অভিযুক্ত করেছে, যদিও রাশিয়ান ফেডারেশন সবকিছু অস্বীকার করেছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী দেবল্টসেভ শহরের কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়। তারপরে, জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যস্থতায়, ‘মিনস্ক -২’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই  চুক্তিই এখনো বিরোধ সমাধানের জন্য প্রধান দলিল হিসাবে রয়ে গেছে। তবে চুক্তির কোনো  অংশই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

২০২১ সালে ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক রুশ সেনা সমাবেশ

নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই ২০২১ সালে শুরু হয় নতুন উত্তেজনা। এবছর রাশিয়া বসন্ত এবং শরৎকালে মোট দু’বার পশ্চিম সীমান্তে তার সৈন্য  সমাবেশ করে। পশ্চিমী দেশগুলির মতে, রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের পূর্ব দিকে এখন প্রায় ১ লক্ষ সৈন্যের জমায়েত হয়েছে। তাদের  আশঙ্কা, ২০১৪ সালের ক্রিমিয়ার মতোই রাশিয়া আবারও হানা চালাতে পারে। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলি ও মস্কোর মধ্যে বহু দফার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। ওই এলাকা থেকে রাশিয়া তার সৈন্য সরিয়ে আনতে রাজী নয়। যদিও রাশিয়া  আশ্বাস দিচ্ছে, যুদ্ধ শুরুর কোনও পরিকল্পনা নেই তাদের। আমেরিকা ও তার মিত্ররা এতে আশ্বস্ত হতে পারছেনা। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক ও নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার চিন্তা-ভাবনা করছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৮৫০০ সৈন্য প্রস্তুত রেখেছে দ্রুততার সাথে ইউরোপে মোতায়েনের জন্য। এরা ন্যাটোর বহুজাতিক ৪০,০০০ সৈন্যের যে ইউনিট আছে তার মার্কিনী অংশ, যারা সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেকোন আগ্রাসন ঠেকাতে সবসময় প্রস্তুত। এ ছাড়া পোল্যান্ডে রাখা বিমান বাহিনীর বিমান, এবং এয়ারবোর্ন ডিভিশনের আরও ৩০০০ সেনা আছে পাঠানোর মত।কিন্তু এগুলো সব একত্রিত করেও রাশিয়ার সামনে দাঁড়ানো সহজ হবে না বলেই ধারণা করছে খোদ পেন্টাগন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এরা কেউই সমপর্যায়ের কোন শক্তির সাথে আধুনিক লড়াই করার মতো প্রশিক্ষিত নয়। এবং  গত ২০ বছরে আমেরিকার সম্মুখ যুদ্ধে খুব বেশি সফলতা নেই। ২০০৮ সালে রাশিয়া- জর্জিয়া যুদ্ধে এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংকটের সময় ইউরোপে ৫০,০০০ সেনা ছিল আমেরিকার। কিন্তু স্থল যুদ্ধে রাশিয়াকে মোকাবেলা করার মতো ঝুঁকি নেয়নি। স্কট রিটারের ভাষায়, ‘আমেরিকা এখন এক ব্যর্থ সুপার পাওয়ার, আর ন্যাটো এক লক্ষ্যহীন সংস্থা।’ রাশিয়া যদি সত্যিই ইউক্রেন আক্রমন করে বসে, সেক্ষেত্রে ন্যাটো ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়াকে মোকাবেলা করবে বলে মনে করেননা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী করে রাশিয়ার অর্থনীতিতে পর্যুদস্ত করে তুলতে সক্ষম হবে।

পরিস্থিতি প্রশমিত করার জন্য দফায় দফায় পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলোচনা ফলপ্রসু হয়নি। কারণ, রাশিয়ার সাফ জবাব, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদান করবে না এমন নিশ্চয়তা না পেলে তারা সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজী নয়। কারণ ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য হয় তাহলে তা রাশিয়ার জন্য ভবিষ্যতে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।সদস্যদেশগুলোকে সবসময়ই সামরিক সহায়তা দেয় ন্যাটো। এগুলোতে সামরিক স্থাপনাও বসানো হয়। ইউক্রেনে ন্যাটোর সেনা, সামরিক স্থাপনা ও মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বসানোর মানে হচ্ছে রাশিয়া তখন ২৪ ঘণ্টাই তাদের নজরদারির আওতায় থাকবে। প্রয়োজনে  পুতিনকে হুমকি দিতে পারবে ন্যাটো, এমনকি সামরিক চাপ দিয়ে রাশিয়াকে বৈশ্বিক কর্তৃত্ব থেকে সরিয়েও দেওয়া হতে পারে, যা পৃথিবীর মোট স্হলভাগের এক ষষ্ঠাংশের দেশ রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আশার কথা হচ্ছে, জার্মানী, ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সাথে বড় রকমের ঝামেলায় জড়াতে। তারা চায় একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান। তুর্কির প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই দুই দেশের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মধ্যস্হতার প্রস্তাব দিয়েছে।

সমস্যা সমাধানের জন্য একদিকে যেমন আমেরিকাকে ন্যাটোর রাশিয়া সীমান্ত অভিমুখে সম্প্রসারণ নীতি থেকে সরে আসতে হবে, অন্যদিকে রাশিয়াকেও প্রতিবেশি রাস্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কথায় আছে, পাটা-পোতার ঘষাঘষি, মরিচের জান যায়! আমেরিকা-রাশিয়া দুই মোড়লের ঝগড়ায় যাতে রাশিয়া বা ইউক্রেনের শান্তিপ্রিয় মানুষের রক্ত না ঝরে সেদিকেই বিশ্বনেতৃত্বের নজর দেয়া জরুরী।যুদ্ধের ময়দানে নয়, আলোচনার টেবিলেই হোক সমস্যার সমাধান। সকলের আন্তরিকতা ও সুমতি থাকলে আলোচনার মাধ্যমেই সকল দ্বন্দ্বের অবসান সম্ভব।

পড়ুনঃ  রাশিয়া-ইউক্রেন, দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের সম্পর্ক যেভাবে ধীরে ধীরে যুদ্ধের দিকে এগোতে থাকে (পর্ব-১)