মতামত

রাশিয়া-ইউক্রেন, দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের সম্পর্ক যেভাবে ধীরে ধীরে যুদ্ধের দিকে এগোতে থাকে (পর্ব-১)

-রবীন গুহ

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই প্রতিবেশি দেশ রাশিয়া-ইউক্রেন

পশ্চিমা দেশগুলের আশঙ্কা , রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তের কাছে লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে এবং তারা  যে কোনো মুহুর্তে হামলা চালাতে পারে। এর মধ্যে নতুন তথ্য যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলছে, ইউক্রেনে পুরোমাত্রায় আগ্রাসনের জন্য সামরিক সক্ষমতার প্রায় ৭০ শতাংশই প্রস্তুত রেখেছে রাশিয়া। রবিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক অনলাইন প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে ৫০ হাজারের বেশি বেসামরিক লোকের মৃত্যু হতে পারে। হামলার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন ঘটবে। এতে দেশ ছেড়ে পালাবে লাখো মানুষ। শরণার্থী সংকট হবে ইউরোপে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে,ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে স্থলভাগ শক্ত হবে এতে রাশিয়া আরও ভারী সরঞ্জাম মোতায়েন করবে। তবে এসবই হচ্ছে অনুমান। এসব কথার প্রেক্ষিতে মার্কিন কর্মকর্তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।  তারা বলেছেন, এসব তথ্য গোয়েন্দা পর্যালোচনার ভিত্তিতে তারা পেয়েছেন, তবে স্পর্শকাতর হওয়ায় এর বিস্তারিত তারা বলতে পারছেন না। অপরদিকে রাশিয়া বলছে অন্যকথা। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই ল্যাভরভ সর্বশেষ যে কথা বলেছেন, এতে পরিষ্কার যে, আপাতত রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করছে না। তার কথা হল. ‘রাশিয়া যুদ্ধ চায় না, তবে তার স্বার্থে যে কোন ব্যবস্থা নিতে তৈরি।’

মানচিত্রে কের্চ, ক্রিমিয়া, লুগানস্ক, দানিয়েস্কসহ বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকা।

কিন্তু যুদ্ধ হোক বা না হোক দুটি দেশের সম্পর্ক একেবারেই তলানীতে এসে ঠেকেছে। কেনই বা অভিন্ন ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত মিল থাকা সত্ত্বেও  ভ্রাতৃপ্রতীম দুটি দেশের সম্পর্ক আজ যুদ্ধোন্মুখ পরিস্হিতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে?  পরিস্হিতি পর্যালোচনার জন্য বিগত তিন দশকের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে।

রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন, ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক ও বেলরুশিয়ার প্রেসিডেন্ট স্টানিসলাভ শুচকেভিচ ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে  সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন  নথিভুক্ত করে। সেই সাথে সিআইএস নামে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলির জোট তৈরী করে। তবে পশ্চিমামুখী বাল্টিক প্রজাতন্ত্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া এতে যোগ দেয়নি। মস্কো দৃশ্যত সিআইএস জোট এবং সস্তা গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলিতে নিজের প্রভাব বজায় রাখার আশা করেছিল। কিন্তু ইতিহাস সেভাবে আগায়নি। রাশিয়ান ফেডারেশন এবং বেলারুশ একটি ইউনিয়ন রাষ্ট্র তৈরির চেস্টা করেছে, আর ইউক্রেন ক্রমবর্ধমানভাবে পশ্চিমের দিকে ধাবিত হয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের রুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা বাদে গোটা ইউক্রেন জুড়ে জনগনের মাঝে রাশিয়া বিরোধী মনোভাবই দিন দিন  বাড়তে থাকে।

কাজাকস্তানের আলমাতিতে সোভিয়েত পতনের পরে সিআইএস গঠনের সময়ে রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলরুশিয়া ও কাজাকস্তানের সেসময়কার রাস্ট্রপ্রধানেরা। Robin

ইউক্রেন সোভিয়েত পতনের পরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় প্রায় এক মিলিয়ন শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রাগার। তবে কিয়েভ ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী অর্থনৈতিক সহায়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার  বিনিময়ে ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাখ্যান করে সেগুলি রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। যতদিন না পশ্চিমা দেশগুলো কিয়েভকে  নিজেদের সাথে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বা ন্যাটো জোটের  দিকে টানার চেস্টা না চালায়, ততদিন পর্যন্ত রাশিয়ার আচরন যথেস্ট বন্ধুত্বমূলকই ছিল। প্রতিদান হিসেবে তারা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইউক্রেনকে সামরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে  ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনেক কমে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাসও সরবরাহ করে। ভর্তুকির পরিমান ছিল বাৎসরিক প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার।

ইউক্রেনের তুজলা দ্বীপ অভিমুখে কের্চ এ রাশিয়ার বাঁধ নির্মাণের চেস্টা

সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে দুদেশের মধ্যে প্রথম বন্ধুত্বে ফাটল দেখা দেয় যখন পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া  ২০০৩ সালের হঠাৎ করে ইউক্রেনীয় দ্বীপ তুজলার দিকে কের্চ প্রণালীতে একটি বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। কিয়েভ এটিকে সীমানা পুনর্বন্টন করার একটি প্রচেষ্টা বলে মনে করেছে। দুদেশের রাস্ট্রপ্রধানদের  ব্যক্তিগত বৈঠকের পর বিরোধ মিটে যায়। বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে একটা মোটা দাগের আঁচড় পড়ে।