চলমান সংবাদ

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক চাকসুর প্রথম জিএস শহীদ আবদুর রবের নাম নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়, পরিবার পায়নি কোন সুযোগ-সুবিধা

এবার বেসরকারি হাসপাতালের নামে রবের উচ্ছেদের পাঁয়তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সংগঠক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর্দশের বীর সৈনিক যুদ্ধকালীন সময়ে চট্টগ্রামে ছাত্রদের সংগঠিত করার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন শহীদ আবদুর রব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ চাকসু’র প্রথম নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত শহীদ ছাত্র আবদুর রব ৭১’র ১৩ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতগামী একটি প্রশিক্ষণার্থী দলকে জিপে রামগড় পৌঁছে দেওয়ার পথে রাউজানের নোয়াপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও শহীদ আবদুর রবের পরিবারের খবর রাখেনি কেউ, পায়নি কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধাও। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়ও নাম নেই শহীদ আবদুর রব’র। চট্টগ্রামের সিআরবি’র রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শহীদ আবদুর রব। এখন হাসপাতাল নির্মাণের নামে সেই কবর অপসারণের অপচেষ্টা চলছে। শহীদের কবর উচ্ছেদ করে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের বিরোধীতা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রব’র পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, স্বাধীনতার এত বছরেও কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা, সম্মান পাননি আবদুর রব’র পরিবার। এখন এই শহীদের কবর উচ্ছেদ করার পাঁয়তারা চলছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবমাননা ও শহীদদের স্মৃতির প্রতি অসম্মান জানানোর শামিল। শহীদ রব’র পরিবার সূত্রে জানা যায়, পরিবারের অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করে ১৯৯৬ সালের ৩০ অক্টোবর শহীদ রব’র বাবা আবেদ আলী দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি লিখেন। নিজেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বহারা, সন্তানহারা হতভাগা পিতা উল্লেখ করে রব’র বাবা আবেদ আলী সন্তানদের নিয়ে বসবাসের জন্য একটি বাড়ির আবেদন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেন, ”জীবন সায়াহ্নে আপনার কাছে প্রথম ও শেষ বারের মতো অনুরোধ জানাই, মেহেরবানি পূর্বক ঢাকা বা চট্টগ্রামে একটি উপযুক্ত বাড়ি দানসরূপ দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। যেখানে ছেলেরা একটুখানি ঠিকানা/ঠাঁই খুঁজে পায় এবং আমি ও বাকি যে কয়েকটি দিন বাঁচি, আপনার মহৎ হৃদয়ের কাছে কৃতজ্ঞচিত্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।” ২০০৪ সালের ৩ জুন ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শহীদ রব’র বাবা আবেদ আলী। চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় শহীদ আবদুর রব’র নামে একটি কলোনি থাকলেও সেখানে শহীদ রব পরিবারের কোনও বাড়ি বা ঘর নেই। চট্টগ্রামে এমনকি দেশের কোথাও শহীদ রব পরিবারের কোন বাড়ি নেই। চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটা ইকবাল রোড এলাকায় স্বামীর বাসায় শহীদ আবদুর রব’র ছোট বোন শাহনাজ পারভিন পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। যোগাযোগ করা হলে স্বামী হারা শাহনাজ পারভিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, আমার ভাই দেশ স্বাধীনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা রেখেও আমার ভাইয়ের নাম আজ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেই ! আমার শহীদ হলেও আমরা সবাই এখনো চট্টগ্রামের বুকে ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে নিরবে-নিবৃতে টিকে আছি। আমাদের কথা কেউ মনে রাখেনি! আমরাও দূ:খে, ক্ষোভে-অপমানে কারো সাথে যোগাযোগ করিনি ! তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ গড়তে হলে মুক্তিযুদ্ধের সামষ্টিক ইাতহাস যেমন সংরক্ষণ করতে হবে, একই সাথে স্মৃতিবিজড়িত চিহ্নও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। শহীদ আবদুর রবের জন্ম ১৯৪৫ সালে গোপালগঞ্জ জেলায় কোটালী পাড়া উপজেলায় বান্ধাবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবা আবেদ আলী মিয়া, মা রহিমা বেগমের ২য় সন্তান তিনি। বাবা চাকরি করতেন ভারতীয় রেলওয়েতে। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে যোগদেন পাকিস্তান ইস্টার্ণ রেলওয়েতে। চাকরির সুবাদে সুুদুর কোটালীপাড়া উপজেলার বান্ধাবাড়ি গ্রামের ছেলে শহীদ আবদুর রব ৪ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে চট্টগ্রামে আসেন। সে সময়ে প্রাদেশিক রেলওয়ে সদর দপ্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ঘেষা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ সিআরবিতে বাস করা শুরু করেন। শহীদ আবদুর রবের বাবা অত্যন্ত রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি হলেও সরকারি চাকরির সুবাদে সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। তবে সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর আর্দশের রাজনীতির ভক্ত ও বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন আবদুর রব। মহান মুক্তিযুদ্ধের অংশ নিতে ৮ মার্চ থেকেই সংঘটিত করার কাজে নেমে পড়েন তিনি। ১০ মার্চ চাকসু জিএস আবদুর রব সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদেরকে অস্ত্র জমা না দেওয়ার আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের অংশ নিতে আগ্রহীদের ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন আবদুর রব। ৭১’র ১৩ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতগামী একটি প্রশিক্ষণার্থী দলকে জিপে রামগড় পৌঁছে দেওয়ার পথে রাউজানের নোয়াপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন রব। তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। শহীদ আবদুর রবের শিক্ষাজীবন ও রাজনীতি সক্রিয় হয়ে ওঠা- আবদুর রবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় নগরীর এনায়েত বাজারের বাটালি রোডের কলিমুল্লাহ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাইমারি স্কুল শেষে ১৯০৯ সালে ভর্তি হন সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। স্কুল জীবন থেকেই চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, মিছিল এবং আন্দোলন-সংগ্রামের পরিবেশে কিশোর রবের বেড়ে ওঠা। সেই স্কুলজীবন থেকেই কিশোর রবের মেধা ও রাজনৈতিক মনোভাব ক্রমান্বয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। ৫ম শ্রেণি থেকেই বয়স্কাউট আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন আবদুর রব। দক্ষতা, কর্মতৎপরতায় ১৯৬১-৬২ সালে তিনি নির্বাচিত হন শ্রেষ্ঠ স্কাউট। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে রব’র রাজনীতিতে সক্রিয় হয় ওঠা। তখন সবেমাত্র ৮ম শ্রেণির ছাত্র তিনি। ৯ম শ্রেণিতে ছাত্রদের সরাসরি ভোটে নিবাচিত স্কুল ক্যাপ্টেন। ১৯৬৫ সালে মেট্রিকুলেশনের পর ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। কলেজ জীবনে রবের সাংগঠনিক দক্ষতা-রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বুদ্বিদীপ্ত ও তেজস্বী বক্তৃতা, সংগঠনিক দক্ষতায় অল্পদিনের মধ্যে রব হয়ে উঠেন জনপ্রিয় নেতায়। প্রথমে কলেজ ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করেন তিনি। ১৯৬৮ সালে তখনকার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা আমেনা বেগম ও চট্টগ্রামের নেতা এম.এ আজিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় রব কলেজ ছাত্র সংসদের নিবার্চনে সহ-সভাপতি পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। আইয়ুর বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় তখনকার কলেজ অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান সেইবার রবকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে বি.এ. ফাইনাল নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য করা হয়। এরপর রবের বিরুদ্ধে দেয়া হয় একের পর এক মিথ্যা মামলা। ১৯৬৮-১৯৬৯ এর গণআন্দেলেন বিশেষ ভূমিকা রাখেন রব। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে সর্বপ্রথম ছাএলীগকে সুসংগঠিত করার কাজে নেমে পরেন আবদুর রব। রবের তত্ত্ববধানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত শহীদ মিনার। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চাকসু’র প্রথম নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুর রব।
# ০৩.০৯.২০২১ চট্টগ্রাম #