মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (শেষ পর্ব)

– অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

লেনিনের আমলে ‘মহান নেতার’ বিরোধিতা দণ্ডনীয় অপরাধ যেমন ছিল না, তেমনি লেনিনই ছিলেন বিপ্লবের একমাত্র পরিচালক ও রক্ষাকর্তা, সকল বিষয় ও ঘটনার নিয়ন্ত্রক দণ্ডমুণ্ডের কর্তা- এমন ধারণা লেনিন নিজেই নস্যাৎ করেছেন। বরং এপ্রিল থিসিস;  অক্টোবর বিপ্লবের দিনক্ষণ ও রণকৌশল; ব্রেস্টলিটভস্ক শান্তিচুক্তি নিয়ে পার্টির অর্ভন্তরে সকল বিতর্ককেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই খণ্ডন করা হয়েছিল ট্রটস্কি থেকে শুরু করে (দ্রঃ L. Trotsky, History of Russian Revolution, 1967; London এবং On Lenin, Bombay; 1974) বিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী মার্কিন সংগ্রামকে লেনিন পার্টি সদস্যের ন্যায়সঙ্গত অধিকার বলেই স্বীকার করেন (দ্রঃ V. I. Lenin, Collected Worked; Vol 27; Moscow, 1977)। সুতরাং অক্টোবর/নভেম্বর বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকা সম্পর্কিত মার্কিন ইতিহাসচর্চার এই ধারার মধ্যে কেউ যদি ‘উদারপন্থী পাশ্চাত্য ধর্মী দর্শনের’ মাধুরী খুঁজে পান (দ্রঃ সত্যজিৎ দাশগুপ্ত ও বাণীনাথ বসুর নিবন্ধ, ইতিহাস অনুসন্ধান-৭ ; পূর্বোক্ত; ১৯৯৩; পৃঃ ৭৩৭) তা তাঁদের শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক; কিন্তু পাইপসের রচনাবলি তাঁর সমালোচকদের কেউ কেউ যদি মনে করেন যে উগ্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষের বিষের সন্ধান পান (দ্রঃ Martin Malia, The Hunt for the True October, commentary, Vol. 92, No. 1991) যদি কেউ ভাবেন পাইপস রচিত ইতিবৃত্তে মার্কসবাদী ভাবাদর্শের গুরুত্ব যথোচিতভাবে স্বীকৃতি হয়নি (দ্রঃ V. Brovekin, The Dark Age of Russian History; Global Affairs, 1991) তাহলে পাইপসের রুশ ইতিহাস চর্চাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক অনুশীলন বলার মধ্যে কুণ্ঠা কোথায়। সোভিয়েত বিপ্লবের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যান নিয়ে হাজির অসংখ্য পাইপস। তাঁদের কারও নাম L. Schapiro (The Originals of Communist Autocracy, London, 1996); কারও নাম O. Anweiler (The Soviets : The Russian Workers, Peasants’ and Soldiers’ Councils 1905-1921; New York, 1974); কারও নাম Charles Bettelheim (Class Struggles in the USSR, First Period: 1917-1923, Hassocks, 1977; Second Period: 1924-29 and Third Period : 1930-41) আবার কেউ বা এঁদের ধবনি-প্রতিধ্বনি শ্রী পরেশ চট্টোপাধ্যায় (‘অক্টোবর রুশ বিপ্লবের কয়েকটি বিতর্কমূলক দিকঃ একটি মার্কসীয় উপস্থাপন; অনুষ্টুপ, শারদীয়, ১৯৯১)। এসবের মধ্যে আবার আরেক-ধরনের গবেষণা শুরু হয়েছে যারা এইসব কমিউনিস্টবিরোধী বিশব-পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তাদের ফাঁদে পা দেননি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, প্রলেতারীয় বিপ্লবে এঁদের অবস্থা অটুট, কিন্তু এঁদের তত্ত্বে লেনিন কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা গৌণ- মুখ্য শ্রমিকশ্রেণির স্বতঃস্ফর্ততা বা Autonomy-র প্রসঙ্গে (দ্রঃ D. Mandel, The Petrograd Workers and the Fall of the Old Regine; New York, 1984 এবং The Petrograd Workers and the Soviet Seizure of Power, New York, 1984 and D. H. Kaiser (ed). The Revolution in Russia, 1917; Cambridge, 1987 and D.H. Kaiser (ed.) The Workers’ Revolution in Russia, 1917; Cambridge, 1987 প্রভৃতি)। এই পণ্ডিতগণ তবুও মন্দের ভালো কিন্তু পার্টির – ভূমিকার গৌণতা প্রচারের ফলে কম বিপজ্জনক নয়।
উপরিউক্ত রুশচর্চাকারীদের মধ্যে ফরাসী ‘বিদ্বান’ Charles Bettelheim- এর প্রতিপাদ্য অবশ্য সবথেকে শিহরণ সৃষ্টিকারী (ড. কুণাল চট্টোপাধ্যায় ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত Society and Change, Calcutta- এর  Vol.  XI.  No.  3-4 সংখ্যায় তাঁর মতো করে একটি পর্যালোচনা Bettelhim সম্পর্কে করেছেন) বেটেলহেইমের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে পাইপসের মতো মার্কিনী ‘গবেষকদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। যেমন ১) অক্টোবর অভুত্থান সর্বহারা বিপ্লব নয়; ২) সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থা আসলে জারতান্ত্রিক শাসনেরই সামর্থক ইত্যাদি। এসব অভিযোগের মধ্যে নতুনত্ব তেমন কিছু নেই- প্রবাহমান কমিউনিস্ট বিরোধিতারই চর্বিত চর্বন। কিন্তু মজার (এবং অবশ্যই আপত্তিকর) দিক হলো চতুর্থ পয়েন্টে লেনিন ক বলশেভিকদের বেটেলহেইম চিহ্নিত করেছেন রাশিয়ার ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও রক্ষাকর্তা রূপে। এ সংক্রান্ত আলোচনা তিনি যে খুব বেশি গভীর তত্ত্ব ও প্রাথমিক তথ্যের উপর দাঁড় করিয়েছেন তা নয়- কিন্তু ঐ ফরাশি ‘রুশ বিশেষজ্ঞ’ দেখাতে এরকম মরিয়া যে সমাজতন্ত্র-টমাজতন্ত্র সব বাজে কথা, রাশিয়ার ওসব কস্মিনকালেও ছিল না- সোভিয়েত ইউনিয়নে চিরকাল ধনতন্ত্রেরই নতুন এক পরীক্ষা চলছিল। রাষ্ট্রীয় ও আমলতান্ত্রিক ধনতন্ত্রকে সকলে এতদিন সমাজতন্ত্র বলে ভুল করে এসেছে- এজাতীয় হাস্যকর ধরনের মন্তব্যও দেখা গেছে রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক পর্যালোচনায়!

পড়ুন রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকা- ৭ম পর্ব

-সমাপ্ত-

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।