মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৭ম পর্ব) – অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

তৃতীয়ত, সমকালীন ঐতিহাসিক নথিপত্র সাক্ষ্য দেয় নিজের অভিমতকে কখনোই, কোনো অবস্থাতেই লেনিন কোনো একনায়কের মতন দল বা জনগণের উপর চাপিয়ে দেননি। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ প্রকাশিত ‘ইতিহাস অনুসন্ধান-৭’ গ্রন্থে (১৯৯৩) সোমা মারিকের আলচনা উল্ল্যেখযোগ্য। রিচার্ড পাইপস সম্পাদিত Revolutionary Russia (Harvard, 1967) গ্রন্থে জে এল এই কিপ ‘October in the Provinces’ শীর্ষক যে নিবন্ধটি লিখেছেন তাতেই বিবৃত হয়েছে যে পেত্রোগ্রাদ, মস্কো সোভিয়েতগুলির সঙ্গে সঙ্গে সারাতভ, সামারা, মিনস্ক, খারকভ, কিয়েভ প্রভৃতি প্রাদেশিক সোভিয়েতগুলি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বলশেভিক নেতৃত্ব মেনে নেয়। ফ্যাক্টরি সোভিয়েত, কৃষক সোভিয়েত, সৈনিক বা নাবিক সোভিয়েত (একমাত্র কশাকদের সমর্থন লাভেই বলশেভিকদের বেগ পেতে হয়েছিল) গুলিতে বলশেভিক প্রাধান্য প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ যে ১৯১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল- তা কোনো বল প্রয়োগের দ্বারা হতে পারে না। পাইপসের নিজের লেখাতেই উল্ল্যেখ আছে ( তাঁর মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে এটা অবশ্যই কিছুটা সববিরোধী) যে রুশ মুঝিকদের (কৃষিজীবী) জমি জমা ও ধনসম্পত্তির বিচিত্র অধিকারবোধেই নিহিত ছিল বলশেভিক আদর্শের প্রসার। জমির অধিকার ছিল তাদের কাছে আলো বাতাসের মতো সর্বজনীন ; তাই হয়তো কমিউনিস্টদের দেওয়া জমি বিলির প্রতিশ্রুতি কিংবদন্তীর মতন বহু দশক আবিষ্ট থেকেছে তাদের মনে। অর্থাৎ নেতিবাচক অর্থে হলেও পাইপস পক্ষান্তরে স্বীকার করেছেন কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তা উৎস কোথায়।

বস্তুত এখানেই বাতিল হয়ে যায় অক্টোবর বিপ্লবের কোনো গণভিত্ত ছিল না’ জাতীয় সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কার্যত বলশেভিক নেতৃত্বে গঠিত সোভিয়েত সরকারের সমর্থন ও বৈধতা এসেছিল শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক পরিষদগুলির (সোভিয়েত) সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছ থেকেই। অক্টোবর বিপ্লবের পরেও বলশেভিকরা একদলিয় ক্ষমতা চালু করার চেষ্টা করেনি। সারা রুশ সোভিয়েতে শক্তির অনুপাতে বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতিতে স্থান দেবার প্রস্তাবও ওঠে। সংযুক্ত সমাজতন্ত্রী সরকার গঠনের মার্তভ অনীত প্রস্তাবেও বলশেভকরা সাড়া দিয়েছিলেন কিন্তু প্রধান মেনশেভিক ও সোস্যাল রেভ্যুলিউশনারি দক্ষিনপন্থী অংশের আপত্তিতেই এই প্রস্তাব কার্যকর হতে পারেনি। যাই হোক লেনিনের সভাপতিত্বে নতুন সরকারের বৈধতা স্বীকৃত হয় প্রধানত সোভিয়েতগুলির অনুমোদনের মাধ্যমেই, আর এই সোভিয়েতগুলির গণতন্ত্র সম্পর্কে এমনকি বুর্জোয়া ইতিহাসবিদরাক ছিলেন অধিকাংশ নিংসন্দিহান। এ প্রসঙ্গে মার্ক ফেরোর মন্তব্য উদ্ধৃত করা চলতে পারে। তিনি লিখেছিলেনঃ “The October rising was thus not …….. the art of the political party acting under cover of an institution… it was a test of strength between a government without a state and a state without a government.” (M. Ferro, The October Revoulution, London; 1980), বুর্জোয়া ইতিহাসবিদরা অবশ্য ‘গণতন্ত্র-বিপন্নতার’ আঙুল তুলেছেন ‘সংবিধান সভা’ (যাতে বলশেভিকরা সংখ্যালঘিষ্ট হয়েছিল) ভেঙে দেবার দিকে। এর জবাবে বলতে হয় প্রথমত বলশেভিকরা এককভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি তাদের সঙ্গে ছিল বামপন্থী সোস্যাল রেভ্যুলিউশনারিরা; দ্বিতীয়ত সংবিধানসভা সোভিয়েত সরকারকে অস্বীকার করার পথে চলছিল এবং তৃতীয়ত প্রলেতারীয় বিপ্লবের যুগে বিপ্লব-বিরধী একটি সংবিধান সভার অস্তিত্ব বজায় রাখার অর্থই ছিল বিপ্লবকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যাওয়া, সময়ের চাকাকে পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া- রাশিয়ার বপ্লবী নেতৃত্বের পক্ষে তা হত শ্রমজীবী সর্বহারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি (‘বুর্জোয়া   গণতন্ত্রে’র মোহে পড়ে) বিশ্বাসঘাতকতা করা। সংবিধান সভা বাতিলের যৌক্তিকতা বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল এটাই – যা রোজা লুক্সেমবার্গকেও পরবর্তীকালে স্বীকার করতে হয়েছিল (দ্রঃ M. A. Waters (ed) Rosa Luxemburg Speaks. New York, 1980 এবংJ. Nettl, Rosa Luxemburg, Vol 2; London 1966) । সব থেকে বড় বিষয় বলশেভিক পার্টিতে বিপ্লবের আগে পরে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও পরমত সহিষ্ণুতা সযত্নে রক্ষিত হত। তা না হলে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেও জিনোভিয়েভ, কামেনভরা বেঁচে থাকতে বা পুণরায় পার্টিতে ফিরে আসতে পারতেন না; বলশেভিক বিরোধী সোস্যাল রেভ্যুলেশনারী নেতারাও সেই বিপ্লবী যুগে জেলের বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারতেন না।

পড়ুনঃ  রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৬ষ্ঠ পর্ব)

চলবে …

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।