বিজ্ঞান প্রযুক্তি

পড়া মনে রাখার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি

– সামিরা তাসনিম বানু

এভিঙ্গাস নামে একজন জাপানী সাইকোলজিস্ট মানুষের স্মরণ শক্তি এবং ভুলে যাওয়া নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তার গবেষণার ফলাফলে জানা যায়, মানুষ যখন কিছু পড়ে তার এক ঘণ্টা পরে মাত্র ৪৪% মানুষের মনে থাকে এবং এক দিন পরে মাত্র ৩০% মনে থাকে আর এক সপ্তাহ পরে মাত্র ২০% মনে থাকে। তার মানে আমরা যা পড়ছি তার এক সপ্তাহ পরে ৮০% আমরা ভুলে যাই। তার পরে এভিঙ্গাস কে জিজ্ঞাসা করা হল কিভাবে পড়লে আমরা বেশিদিন পড়া মনে রাখতে পারবো এবং ভুলেও যাব না। এভিঙ্গাস যে সাজেশন দিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে – ধরা যাক, একজন ঠিক সকাল ৭টা থেকে পড়া শুরু করেছে। ৭টা থেকে ৭টা ২০ পর্যন্ত সে পড়েছে ইংরেজি। অতঃপর ৫ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে ৭টা ২৫ থেকে ৭টা ৪০ পর্যন্ত পড়ল বাংলা। এরপর ৭টা ৪৫ থেকে ৭টা ৫০ এই ৫ মিনিটে সে আগের ইংরেজি পড়াটা পুনঃস্মরণ করবে। তারপর সে ৭টা ৫৫ থেকে ৮টা ১০ পর্যন্ত যেকোনো একটি সাবজেক্ট পড়ল। তারপর ৮টা ১৫ থেকে ৮টা ২০ পর্যন্ত সে বাংলা পড়াটা পুনঃস্মরণ করলো। এভাবে পড়া শেষ করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়াটি পুনঃ স্মরণ করবে এবং পরের দিন সকালে আরেকবার পুনঃ স্মরণ করবে। এবং দুই সপ্তাহ পরে আরেকবার পুনঃ স্মরণ করবে। এভিঙ্গাস কয়েকটি সাজেশন এর মধ্যে এটি একটি। এভাবে পড়লে যে কারও পড়া মনে রাখার দক্ষতা অনেকগুন বেড়ে যাবে।

আরেকটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়,  সেটি ২০১৬ সালের ঘটনা। বেশ কিছু ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্মরণ শক্তি নিয়ে গবেষণা করেন এবং গবেষণা করে তারা বেশ কিছু মজার বিষয় উপস্থাপন করেন। তার মধ্যে প্রথম বিষয়টি হচ্ছে এরকম- ব্রিটিশ বিজ্ঞানী দল একজন মানুষের ৬০ মিনিট পড়ার সময়কে ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন। অর্থাৎ তারা প্রত্যেক ভাগে ১০ মিনিট করে বরাদ্দ করে দেখতে পেয়েছেন,  প্রথম ১০ মিনিট একজন শিখছে ২৭ লাইন। তার পরের ১০ মিনিটে শিখছে ২১ লাইন। তার পরের ১০ মিনিটে ১৩ লাইন। তার পরের ১০ মিনিটে ৮ লাইন। তার পরের ১০ মিনিটে ৬ লাইন এবং তার পরের ১০ মিনিটে শিখছে  ৪ লাইন। অর্থাৎ একটানা ৬০ মিনিটে একজন মোট ৭৯/৮০ এতটুকু লাইন শিখতে পারে। তার সাথে তারা আরেকটি গবেষণা করে দেখেন কেউ যদি ৬০ মিনিটের মধ্যে ১০ মিনিট পড়ে ৫ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার ১০ মিনিট পড়ে ৫ মিনিট বিশ্রাম নেয় এবং এইভাবে ৬০ মিনিট পড়লে দেখা যায় ১০৬ থেকে ১০৮ লাইন মনে রাখতে পারে। এখান থেকে তারা একটি পরামর্শ দেয় যে, আমরা যখন পড়ব তখন যাতে আমরা পড়ার মাঝখানে কিছু সময় গ্যাপ দিয়ে পড়ি। আমরা যখন পড়ি তখন মুলত আমরা পড়াটাকে ব্রেইন এ জমা রাখতে চাই। মোবাইল এর যেমন ইনবক্স থাকে তেমন আমাদের ব্রেইন এরও একটি ইনবক্স আছে। এর নাম হিপ্পক্যাম্পাস। এটি ৩টি ফ্যাক্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর মধ্যে প্রথম যে ফ্যাক্টর তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটি হচ্ছে ঘুম। আমরা যখন কোন পড়া পড়ি তখন পড়াটা প্রথমে শর্ট টার্ম মেমরিতে জমা হয়। সেই শর্ট টার্ম সেন্টার থেকে লং টার্ম সেন্টারে যেতে ঘুম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানীরা বলেন ৭ ঘণ্টা ঘুম আমাদের জন্য সবচেয়ে উপকারী। তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কোন সময় ঘুমাচ্ছে। আমাদের দেশ এর জন্য রাত সাড়ে ৯টা-১০ টা থেকে থেকে রাত ৩টা-সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঘুম এর জন্য সবচেয়ে আদর্শ সময়।অবশ্য এসময়টা আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা এবং অভ্যাসের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। তবে সেক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে রাত ১১টার আগে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে উত্তম।

আমাদের রাসুল (সঃ) বিতর নামাযের পর ঘুমিয়ে পরতেন। বিজ্ঞানীরা এখন কোটি কোটি ডলার ইনভেস্ট করে রিসার্চ করে দেখেছেন যে বিতর নামাযের পরের সময় থেকে রাত ৩টা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সময় ঘুমানোর জন্য সবচেয়ে আদর্শ সময় এবং মজার ব্যাপার কেউ যদি প্র্যাকটিস করে দেখে এশার নামাযের পর যতটা ঘুম আসবে রাত যত বাড়বে ঘুম আসাটা তত জটিল হয়ে যাবে। দ্বিতীয় যে ফ্যাক্টর টি হিপ্পক্যাম্পাস এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটি হচ্ছে খাদ্য। বিজ্ঞানীরা রিসার্চ করে দেখেছেন মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রে যে দুটি খাবার সবচেয়ে উপকারী সেগুলি হল মধু এবং লাউ। আমরা যদি খেয়াল করি রাসুল (সঃ) এই দুটি খাবার পছন্দ করতেন এবং মধু নিয়ে কুরআনেরও একটি আয়াত আছে। তাই মধু যদি কেউ নিয়মিত পান করে তাহলে মস্তিষ্কের সি.এস.এফ এর কার্যক্রম এটি বৃদ্ধি করে যা পড়া মনে রাখার জন্য উপকারী। তাই আমরা চেষ্টা করব মধু এবং লাউ জাতীয় খাবার খেতে। তৃতীয় যে ফ্যাক্টরটি কাজ করে সেটি হচ্ছে রক্ত সঞ্চালন। আমাদের মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহ যদি ঠিক থাকে তাহলে পড়াও সহজে রিজার্ভ হবে। নামায এবং ওযু রক্ত সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার কঠিন কোন পড়া মনে রাখার জন্য আমরা যখন পড়ব তখন কিছুক্ষন পড়ার পর ঘুমিয়ে থাকব বা চোখ বন্ধ করে থাকব। এর ফলে পড়া শর্ট টার্ম থেকে লং টার্ম সেন্টারে যাওয়ার রেট ৫০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। আর পড়া অনেকেই না বুঝে শুধু মুখস্থ করে। তবে যদি কেউ বুঝে মুখস্থ করে তার পড়া মনে রাখার গতি ৯ গুন বেড়ে যায়। আর আমরা যে কক্ষে পড়ি সেই কক্ষ থেকে যদি গাছপালা দেখা যায়, সুন্দর পরিবেশ দেখা যায় তাহলে পড়ার গতি আড়াই থেকে ৩ গুন বৃদ্ধি পায়। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় ছাত্রদের মধ্যে এক দল সবসময় হাশিখুশি থাকে আরেক দল সবসময় মনমরা থাকে। রেজাল্ট যখন বের হল তখন দেখা গেল হাশিখুশি স্টুডেন্টরাই ভাল রেজাল্ট করল। তাই আমরা সবসময় হাসিখুশি থাকব এবং ধর্মীয় বিধানগুলো মেনে চলব। তাহলে পড়ার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক কিছু নিয়ম মেনে চললে অল্প পড়ে অনেক বেশি জিনিস আমরা মস্তিষ্কে ধারন করতে পারব। এক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম কিংবা খ্রিষ্টান ধর্ম যে ধর্মেরই হোক …

সামিরা তাসনিম বানুঃ দশম শ্রেণির ছাত্রী, বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়