চলমান সংবাদ

তাজউদ্দীন আহমেদ: ইতিহাসের এক উপেক্ষিত নায়ক

বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমেদ

মুছে যাক আমার নাম, তবু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।’ দেশমাতৃকার পাদতলে এভাবেই তিনি নিজের জীবনকে নিবেদিত করেছিল। মেধা, দূরদর্শিতা, সততা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিরল সংমিশ্রণে এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ও এদেশের মুক্তিপাগল মানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে সেই প্রেরণাকে একটা সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হবার পর তাঁর অবর্তমানে তাজউদ্দীন তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার সমন্বয়ে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস প্রবাসী অস্হায়ী সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবিত অবস্থায় সম্মানজনক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তাঁর ভূমিকা ছিল অসাধারণ।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলের দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুননেসা খান। কোরআনে হাফেজ তাজউদ্দীন আহমদ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বাদশ ও চতুর্থ স্থান (ঢাকা বোর্ড ) লাভ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি. পরীক্ষা দেন পাস করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে বিজয় লাভ করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৬৬ সালে।

এম আর আখতার মুকুল এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচার দেয়া শুরু করলেন তখন একদিন রাজশাহীর এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবার আগে দেখি তাজউদ্দীন আহমদ তার হাতে ছোট একটি কাগজ গুঁজে দিলেন। ওই কাগজ দেখে আমার কৌতুহল হলো। আর এই কৌতুহল থেকে বগুড়ার জনসভায় যাবার পরে জানতে পারলাম প্রতিটি জনসভার আগে তাজউদ্দীন আহমদ যে ছোট কাগজটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গুজে দেন সেটা আর কিছু নয়, ওই এলাকায় কী কী প্রয়োজন তার একটি লিস্ট। বাংলাদেশের কোথায় কী দরকার, সেটা বঙ্গবন্ধুর নখদপর্নে ছিল। তারপরেও দলের সেক্রেটারি হিসেবে যে প্রতিটি জনসভার জন্যে এভাবে নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে যথাসময়ে নেতার হাতে দেওয়া একটা দায়িত্ব তা ওই প্রথম বুঝতে পারলাম।’
স্বাধীনতা লড়াই-সংগ্রামের প্রতিটির মুহূর্তে ছায়ার মতো বংগবন্ধুর পাশে থেকেছেন। নেতার ও দলের প্রয়োজনে নেপথ্যে থেকে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘আমি নিজে মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট নই তবে আমি কমিউনিজম থেকে নিজের জীবনাচরণে অনেকখানি গ্রহণ করি।’ রাজনীতির দর্শণগত দিক থেকে আপাদমস্তক জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও তিনি মার্কসীয় দর্শনের অনুকরণে বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নেতার প্রতি আনুগত্য, সর্বোপরি দল ও জনগণের স্বার্থে কাজ করার নীতি মেনে চলতেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই বংগবন্ধু গ্রেফতার হয়ে যাবার পর দল ও দেশ দুই-ই নেতৃত্বশূণ্য হয়ে পরে। নেতার অবর্তমানে হাল ধরেন তিনি। প্রজ্ঞা, সাহস, সততা ও দক্ষতার আলো ছড়িয়ে নয়টি মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময়ে প্রবাসী সরকার গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক-নির্দেশনা দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯৭২ সালে, বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে, দৈনিক বাংলার কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর দুর্যোগময় যাত্রাকালীন সময়ে গৃহীত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের (৩০ মার্চ, ১৯৭১) সৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন-“পালিয়ে যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা চেতনার যে উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টুঙ্গি (কুষ্টিয়া জেলায়) নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা হল একটি স্বাধীন বাংলা সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে কাজ শুরু করা।” ১৭ এপ্রিল মুজিবননগর সরকার গঠনের পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নবজাত বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি আদায় এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করবে এই শর্ত উল্লেখ ও বাস্তবায়ন করেন। শক্তিশালী ও আধুনিক পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যুগপৎ লড়াই বিজয়কে ত্বরাণ্বিত করেছিল। নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও বাংগালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বংগবন্ধুকে পাকিস্তানের কারগার থেকে জীবিত অবস্হায় ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বংগবন্ধু সরকারের অধীনে তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুন:গঠনে সততার সাথেই কাজ করে যান। ৭২ থেকে ৭৫ এর সময়কালে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি নানা বিষয়ে তাঁর নেতা বংগবন্ধুর সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন। বাকশাল গঠনেরও তিনি নীতিগতভাবে বিরোধী ছিলেন। ৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

কিন্তু তাঁর মধ্যে দল ও নেতার প্রতি আস্হা বা আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোন ঘাটতি দেখা যায়নি। নেতার সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়া সত্ত্বেও আজীবন বংগবন্ধু ও দলের প্রতি ছিলেন বিশ্বস্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বংগবন্ধু হত্যাকান্ডের পর উনি অন্য অনেকের মত ঘাতক মুশতাক বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেস্টা করেননি। ফলশ্রুতিতে, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন এবং সেখানে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর আততায়ীদের গুলিতে উনিসহ চার জাতীয় নেতা নিহত হলেন। জীবন দিয়েই নেতা ও দলের প্রতি বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের প্রমাণ দিলেন।

রামায়ণে বর্ণিত আছে, রাম যখন বনবাসে যান তখন তার ছোটভাই ভরত রামের চটিকা সিংহাসনে রেখে রামের নামেই নিষ্ঠার সাথে রাজ্যপরিচালনা করেছেন। রাম বনবাস থেকে ফিরে এলে রামকেই তার রাজ্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। সবসময় নেতার ছায়াসঙ্গী হিসেবে ছিলেন আর নেতার অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সময় বংগবন্ধুর নামেই তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্হায়ী সরকার পরিচালনা করেন, মুক্তিযুদ্ধের লড়াই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। তবুও, তাজউদ্দীন আহমেদ যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন উপেক্ষিত নায়ক। আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকেরই হয়তো জানা নেই ইতিহাসের পরতে পরতে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা! স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে তাজউদ্দীন আহমেদের জীবন পাঠ জরুরী। তাঁর কর্মকান্ডের সঠিক মূল্যায়ন ব্যতিত বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মোহ বিনির্মান সম্ভব নয়।

# ২৩ জুলাই ২০২১, প্রগতির যাত্রী ডেস্ক #