বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

– বিজন সাহা

(২)

বিজন সাহা

বিজ্ঞান ভাবনা নাম শুনে আপনাদের মনে হতে পারে এখানে শুধু বিজ্ঞান নিয়েই কথা হবে, মানে প্রথাগত বিজ্ঞান বলতে আমরা যা বুঝি সেটা নিয়েই কথা বলব। তবে এটাও বলেছি যে আমরা কথা বলব বিজ্ঞান নিয়ে নয়, বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে, মানে সব বিষয়েই প্রশ্ন করব, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব। আমরা বোঝার চেষ্টা করব যে সব কিছুই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়। আর শুধুমাত্র এভাবে দেখলেই আমরা সত্যে পৌঁছুতে পারি। আমাদের সব প্রশ্নই যে উত্তর বা বলা যায় সঠিক উত্তর এনে দেবে তার কোন মানে নেই। অনেক উত্তর আমাদের কানাগলিতে নিয়ে আসবে। এ এক গোলকধাঁধা। তবে যেটা সত্য তা হল এখান থেকে বেরুনোর পথ আছে। তাই আমাদের বিভিন্ন পথে যেতে হবে আর এভাবেই জানতে হবে আমরা সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছেছি কিনা। লক্ষ্যটা আমাদের জানা, তবে সেটাই কি সেই লক্ষ্য যেখানে আমরা পৌঁছেছি সেটা বোঝা অনেক কঠিন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। হ্যাঁ, একাত্তরে তিরিশ লাখ মানুষের প্রাণ আর তিন লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু যে স্লোগান সামনে রেখে আমরা এই যুদ্ধ করেছিলাম তা কি আমরা পেয়েছি?

আসলে সব কিছুর মতই লক্ষ্যও পরিবর্তনশীল। মানুষ সব সময়ই চায় তার অবস্থা উন্নত থেকে উন্নততর করতে। তাই লক্ষ্যও বদলায়। যদি আমরা আমাদের এই চলায় শুধু মানুষের অবস্থারই উন্নতি না করে প্রকৃতিরও কথাও ভাবি তবে বলা যায় আমরা সত্যিকার অর্থেই সামনের দিকে চলছি, সেটা না হলে আমাদের পথ হবে পেছনমুখী। এক্ষেত্রে বর্তমান কালের কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়।

আজ আমরা দিকে দিকে সমান অধিকারের কথা শুনি। এটা নিঃসন্দেহে সময়ের দাবী, প্রগতিশীল প্রস্তাব। তবে সেটা যেন যান্ত্রিকভাবে না হয়। যদি আজকের পৃথিবীর, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে দেখি এক্ষেত্রে অনেক হাস্যকর ঘটনা ঘটে। যেমন ধরুন বাবা আর মার মধ্যে পার্থক্য কমাতে কোন কোন দেশ অভিভাবক ১ ও অভিভাবক ২ সম্বোধনের প্রবর্তন করেছেন। কিন্তু সমস্যা হল কাউকে ১ আর কাউকে ২ হতেই হবে।  আর আমাদের ঠিক করতে হবে কে ১ আর কে ২। যদি প্রতিটি পরিবার নিজের মত করে ১ আর ২ নম্বর পিঠে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেটা অনবরত বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করবে। কে বাবা আর কে মা, সেটা ঠিক করা হয়েছিল কাউকে বড় বা ছোট করার জন্য নয়, সেটা করা হয়েছিল এলাকার সবাই যাতে বুঝতে পারে কার সম্পর্কে কথা হচ্ছে সেটা ঠিক করতে। এটা অনেকটা ভাতকে ভাত আর রুটিকে রুটি বলে ডাকার মত। আমরা যদি খেয়ালখুশি মত ভাতকে ভাত বা রুটি নামে ডাকতে শুরু করি ভাষার মূল কাজ, মনের ভাব আদান প্রদান করা, ব্যহত হবে।  অনেকটা সেই আমি বলি আগরতলা সে বোঝে চৌকির তলার মত। এটা অধিকারের প্রশ্ন নয়, ভাষার প্রশ্ন। এটা কন্ডিশনাল। তাই যেকোনো ব্যাপারে প্রশ্ন করার আগে আমরা যেন তার উৎসের কথা ভুলে না যাই। তাছাড়া সবার জন্য সমান অধিকার কায়েম করতে যদি সবাইকে এক নামে ডাকতে শুরু করি তাহলে কী দাঁড়াবে? পুঁজিবাদের অন্যতম মূল কথা সমষ্টি  নয়, ব্যক্তি মানুষ। আর যেহেতু প্রতিটি মানুষই অন্যের চেয়ে কোন না কোন ভাবে ভিন্ন তাই এভাবে সবাইকে সমান করার অর্থ ব্যক্তি মানুষকে মুছে ফেলা আর সেটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ।

এর অর্থ এই নয় যে আজ বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর সমান অধিকারের দাবী সঠিক নয়, কথা হচ্ছে মানুষের তৈরি আইনের চোখে সমান হতে গিয়ে আমরা যেন প্রকৃতির তৈরি বৈষম্যকে মাথায় রাখি। এখন শোনা যায় অনেক দেশেই একজন শিশু ছেলে না মেয়ে সেটা নিজেরা ঠিক করবে। কিন্তু সত্যটা হল একজন ছেলে না মেয়ে সেটা আমাদের কাছে জিজ্ঞেস না করে প্রকৃতিই অনেক আগে ঠিক করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে হয়তো সেটা পরিবর্তন করা যায়, তবে এর ভবিষ্যৎ কি সেটা নিয়ে আমরা কি ভাবি? আজ মানুষ এমনকি ভবিষ্যতে কি প্রতিক্রিয়া হবে সেটা ভেবে করোনার ভ্যাক্সিন পর্যন্ত নিতে চায় না, সেক্ষেত্রে গণ হারে লিঙ্গ পরিবর্তন কতটা নিরাপদ সেটা চিন্তার বিষয়। আমরা যেন বিজ্ঞানের কথা বলে বিজ্ঞানকে ফ্যাশনে পরিবর্তন না করি। বিজ্ঞান ফ্যাশন নয়, খুব সিরিয়াস একটা ব্যাপার। আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীর বয়স ৪৫০ কোটি বছর। প্রকৃতির শত কোটি। মানুষের আগে এখানে ডাইনোসারের রাজত্ব ছিল। এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রকৃতি ঠিকই আছে। মানুষ প্রকৃতির একটা অংশ মাত্র, অতি নগন্য একটা অংশ। মানব সমাজ ধ্বংস হলে প্রকৃতি টেরও পাবে না। করোনা কালীন সময়ে মানুষের সীমাবদ্ধ গতিবিধি আবারও প্রমাণ করেছে যে প্রকৃতি মানুষের এই অনুপস্থিতি নিয়ে এতটুকুও চিন্তিত নয়। কিন্তু প্রকৃতির বিপর্যয় মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর সেজন্যেই বিজ্ঞানকে হতে হবে প্রকৃতি বান্ধব। বিজ্ঞান আর প্রকৃতির মধ্যে হারমোনি অপরিহার্য। তাই আজ মানুষ নিয়ে, শিশুদের নিয়ে লিবারেলিজমের নামে যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে সেটাকে প্রশ্ন করতে হবে। ফ্যাশন নয় মানব কল্যাণই বিজ্ঞানমনস্কতার মূল কথা।

বিজ্ঞান ভাবনার ১ম পর্ব পড়তে নীচের লিংকে ক্লিক করুনঃ
বিজ্ঞান ভাবনা ১ম পর্ব

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া