বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজন সাহার কলাম

-বিজ্ঞান ভাবনা

-বিজন সাহা

(১)

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

আমাদের ছোটবেলায় দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আমদানি ঘটে। একাত্তরে যারা আওয়ামী লীগের হয়ে লড়াই করেছে তাদেরই একাংশ পরে সমাজতন্ত্রের সৈনিক হয়। সে সময় রুশপন্থী সিপিবি আর চীনপন্থী বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দল থাকায় তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে সামনে নিয়ে আসে। বড় হয়ে নিজে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হই। আমাদের শেখানো হয় সমাজতন্ত্র মানেই বৈজ্ঞানিক। এর মূলে রয়েছে হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ আর ফয়েরবাখের বস্তুবাদ, আছে অ্যাডাম স্মীথের অর্থনীতি, আছে শিল্প বিপ্লবের বৈজ্ঞানিক ধারণা। এক কথায়  মার্ক্সবাদ নিজেই একটা বৈজ্ঞানিক মতবাদ। এখনও পর্যন্ত প্রচুর লোক সেটাই বিশ্বাস করে। তবে সমস্যা ঠিক এখানেই – ঠিক যে মুহূর্তে কেউ মার্ক্সবাদ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এটা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে, ঠিক সেই মুহূর্তেই সেই ব্যক্তির জন্য মার্ক্সবাদ তার বৈজ্ঞানিক গুনাবলী হারিয়ে ডগমায় পরিণত হয়। আর যেখানেই ডগমা মানুষের ঘাড়ে ভূতের মত ভর করে সেখান থেকেই বিজ্ঞান পালায়। তাই আমরা যখন বিজ্ঞানের কথা বলব, বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়ার কথা বলব আমরা যেন ভুলে না যাই এমনকি বিজ্ঞানও যখন অন্ধবিশ্বাসে পরিণত হয় সে আর বিজ্ঞান থাকে না। বিজ্ঞান চলমান, প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল। এখানে স্থবিরতার কোন স্থান নেই, স্থান নেই অন্ধবিশ্বাসের। আর এটা যদি আমরা মনে রাখি, পথচলা হয়তো কঠিন হবে, তবে সবকিছুর পরেও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছুব আর ভুলে গেলে আমরা লক্ষ্যচ্যুত হব।  আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে বাদেই আমরা বিশ্বাস করি না কেন, মানুষ যতদিন না বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে ততদিন পর্যন্ত মানব মুক্তি অনেকটা সোনার হরিণের মতই রয়ে যাবে। তাই ছোট ছোট বিভিন্ন পর্বে আমার লেখার মূল কথা হবে বিজ্ঞানমনস্কতা। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ আমি তাদেরই বলব যারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশ্ন করেন, সত্যের সন্ধান করেন। তার জন্য সত্যটা হবে যাকে বলে অব্জেক্টিভ রিয়ালিটি, লাভ-লোকসানের হিসাব নয়।

বিজ্ঞানমনস্কতার কথা বলতে গেলে আমাদের প্রথমেই বলতে হবে বিজ্ঞান কী। আমাদের অনেকেরই ধারণা বিজ্ঞান মানেই খুব কঠিন কিছু যা নিয়ে শুধু নিউটন, আইনস্টাইন, হকিং, পাউলি, ডাইরাক, ফাইনম্যানদের মত লোকজনরা ভাবতে পারে। বিজ্ঞান মানেই কঠিন কঠিন সব সমীকরণ, বিজ্ঞান মানেই জটিল যন্ত্রপাতি।  বর্তমানের দিকে তাকালে এসব মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে সব সময় তো এসব ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞান ছিল। আসলে বিজ্ঞানের জন্ম সেদিন যেদিন মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করে আর যুক্তি দিয়ে তার উত্তর খুঁজতে শুরু করে । তাই বলা যায় বিজ্ঞান মানব সভ্যতার মতই পুরাতন। যদিও প্রশ্ন করাটা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রধান কথা, তবে সেটা সত্যি সত্যিই বিজ্ঞানমনস্কতা কিনা সেটা নির্ভর করে উত্তর খোঁজার পদ্ধতির উপর। সেটা কেমন?

সভ্যতার ঊষা লগ্নে মানুষ যখন বার বার প্রকৃতির কাছে পরাজিত হয়েছে তখন সে প্রশ্ন করেছে। সে প্রশ্ন করেছে তার জীবনে সূর্য বা অন্য গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব নিয়ে। অথবা সে প্রশ্ন করেছে ঝড়ের তান্ডব দেখে, জোয়ারভাটা বা সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ দেখে। কিন্তু এই প্রশ্নের কী উত্তর সে খুঁজেছে, কী উত্তর সে গ্রহণ করেছে তার উপরই নির্ভর করছে সে কে। যদি সে এসব প্রশ্নের উত্তর কোন অলৌকিক শক্তির মধ্যে খোঁজে আর বিশ্বাস করে সেই অলৌকিক শক্তি তাকে সমস্ত বিপদ থেকে আগলে রাখবে, তাহলে সে আর বিজ্ঞানমনস্ক থাকবে না। বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে তাকে প্রকৃতিকে জানার চেষ্টা করতে হবে, প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে আর সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে যৌক্তিক উপসংহারে আসতে হবে। একমাত্র তখনই সেটাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে মেনে নেওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে আমরা হরিপদ কাপালীর কথা উল্লেখ করতে পারি। তিনি ছিলেন সমাজের অবহেলিত শ্রেণী থেকে উঠে আসা একজন মানুষ। ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিলও না স্কুল-কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করার। আজীবন সংগ্রাম করেছেন বেঁচে থাকার জন্য। তবে যেটা অনেক ডিগ্রিধারী লোকের মধ্যেও থাকে না সেটা তাঁর মধ্যে ছিল – জানার উৎসাহ আর পর্যবেক্ষণের চোখ। আর সে কারণেই আমরা পেয়েছি হরিধান। এটা আবারও প্রমাণ করে বিজ্ঞান কোন বিশেষ শ্রেণীর নিজস্ব সম্পদ নয়।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন কারা সবচেয়ে উৎসুক, কারা সবসময় প্রশ্ন করে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন – শিশুরা। কিন্তু আমরা কী করি? মনে আছে সুকুমার রায়ের সেই বিষম চিন্তা?

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার –
সবাই বলে, মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার

হ্যাঁ, আমরাই পারি শিশু মনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে, আবার আমরাই পারি বকাঝকা করে তার জানার ইচ্ছাটা চিরতরে ধ্বংস করতে।

চলবে………

লেখকঃ গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া