মতামত

করোনা ও শ্রমজীবী মানুষ

রাজেকুজ্জামান রতন

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ করোনা সংক্রমণ, মৃত্যু, কর্মহীনতা, ছাঁটাই, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের কারনে কারখানা বন্ধ করা এবং আবার খুলে দেয়া, কর্মসময় বৃদ্ধি করা, মজুরি কমানো, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সংকোচন করা ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এক ঝুঁকিপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে।

বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ চিহ্নিত হয় ৮ মার্চ ২০২০। চীনের উহানে ডিসেম্বর ২০১৯ এ করোনা সংক্রমণের পর বিশ্বব্যাপী তার বিস্তৃতি ও ভয়াবহতা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার কি প্রভাব পড়তে পারে এবং শ্রমজীবী মানুষ কতখানি দুর্দশায় পড়তে পারেন তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র বুঝতে পারা যায় নি। প্রথম ধাক্কাটা এলো তখনই যখন ফেব্রুয়ারিতে বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে  প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরে আসতে শুরু করেছিলো। একদিকে তাদেরকে যথাযথভাবে কয়ারিনটিন করতে না পারায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ও পরিধি বেড়ে যায় অন্যদিকে কর্মহীন প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ কি হবে তা এক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর যে দেশেই যাওয়ার সুযোগ আছে সেখানেই বাংলাদেশের যুবকরা পাড়ি জমিয়েছে কাজ এবং উন্নত জীবনের আশায়। পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন আর দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার এক নিয়মিত সরবরাহকারী এই প্রবাসী শ্রমিকেরা। ১৫৯ টি দেশে ১ কোটি ২২ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কাজ করে এই করোনাকালে ২২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন তাঁরা। প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে থেকে  ৬ লাখের বেশি ফিরে এসেছেন, আরও ফিরে আসার আশংকা রয়েছে। অন্যদিকে বিদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা ৪ লাখ কর্ম প্রত্যাশী যুবকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শ্রমশক্তির প্রধান বাজার তেলের উপর নির্ভরশীল মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছে ফলে তাদের দেশে কাজের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়বে। তাই করোনায় প্রবাসী শ্রমিকদের জীবিকা এবং ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। কাজের ধরন পালটে গেলে বর্তমান দক্ষতা দিয়ে কাজে যুক্ত থাকা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে বিদেশ যেতে হলে নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা ও দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য করনীয় পন্থা এবং তাদের কর্মসংস্থানের খাতসমুহ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রধানত গার্মেন্টস, পাট, চামড়া, চা, মৎস্য, ওষুধ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এ সবগুলো শিল্পই শ্রম ঘন এবং স্বল্প মজুরী ও দীর্ঘ কর্ম ঘণ্টা নির্ভর। করোনা পরিস্থিতি এসব খাতের শ্রমিকদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে সাথে সাথে চাকুরির নিশ্চয়তা কমিয়ে দিয়েছে প্রচণ্ড ভাবে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত, রপ্তানির ৮০ ভাগের বেশি জুড়ে আছে তৈরি পোশাক খাত। ৩০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হলেও এ খাতের জন্য আমদানিও বিপুল। প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। আমদানি রপ্তানির ব্যবধান ১৬ বিলিয়ন ডলার। শ্রমিকের মজুরী গড়ে ১০ হাজার টাকা ধরলে বার্ষিক মজুরী বাবদ ব্যয় দাঁড়ায় ৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বাবদ খরচ বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে সেটাই মালিকদের মুনাফা। এক্ষেত্রে কারখানা যত বড়, মুনাফা তত বেশি।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত প্রায় সম্পূর্ণটাই ইউরোপ ও আমেরিকা নির্ভর। করোনায় সে সব দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশ খানিকটা। বিশেষ করে সে অঞ্চলের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তার প্রভাব বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে পড়বে। এই অজুহাতে  মালিকরা পুরো দায় চাপিয়ে দিতে চাইছেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের উপর। মজুরী কেটে নেয়া, ছাঁটাই, কারখানা লে অফ করা তো চলছেই এরপর আক্রমণটা আসবে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের উপর। তাদেরকে শুধু চাকুরিচ্যুত করাই নয়, বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে শাস্তি দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে যা অতীতেও দেখা গেছে। এই খাতে কর্মরত ৪০ লাখ শ্রমিক যারা এতদিন মালিকের মুনাফা আর সরকারের রাজস্ব যোগাতে প্রধান ভুমিকা পালন করেছেন তাঁরা কাজ এবং মজুরী উভয়ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে পড়েছেন। পাট শিল্প ও শ্রমিকরা জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। একটি স্থায়ী শিল্প হিসেবে একে টিকিয়ে রাখা এবং শ্রমিকদের মজুরী পাওয়ার বিষয়টি না ভেবে ২৫ টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।  গত অর্থবছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে পাট শিল্প রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা, পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত কৃষক, পাট সম্পর্কিত কাজে যুক্ত মানুষ নিয়ে ভাবলে পাট শিল্প বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনো বিশ্ববাজারে পাট ও পাট জাত দ্রব্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রথম এবং এর বিস্তার ঘটানোর বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশ সম্মত পণ্য উৎপাদনে পাট  দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু পাট শ্রমিকরা দুঃসহ জীবন যাপন করছেন।

পরিবহণ খাতকে দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহের সাথে তুলনা করা যায়। প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। যাত্রী, কৃষি ও শিল্প পণ্য পরিবহণ, আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহণ সহ সেবা খাতের এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে পরিবহণ খাত যুক্ত নয়। কিন্তু এখাতের সঙ্গে যুক্ত ৬০ লাখ শ্রমিকের চাইতে ঝুঁকিপূর্ণ আর কেউ নয়। এই ঝুঁকি শুধু দুর্ঘটনার নয় তাদের জীবিকা ও চাকুরিও ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরাপত্তাহীন। এছাড়াও নির্মাণখাতের ৩০ লাখ, রি রোলিং, জাহাজ ভাঙ্গা, জাহাজ নির্মান, চা, তাঁত, রিক্সা, অটো রিক্সা, ইজি বাইক, ছোট দোকানদার, চা দোকানদার, হকার, পর্যটনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ, গৃহ কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সেলুন কর্মী, পাদুকা শ্রমিক সহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক যাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি এবং যারা অর্থনীতিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখে তাঁরা সব সময়ই উপেক্ষিত থাকে। কি বাজেটে, কি প্রণোদনা প্রাপ্তিতে তাদের অবস্থান নগন্য।

লেবার ফোরস সারভে অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমশক্তির সংখ্যা ৬ কোটি ৮০  লাখের বেশি। তাঁরা দেশকে কি দেন? উৎপাদনে, বিপণনে ভুমিকা রাখেন এটা তো সবাই দেখে কিন্তু নীরবে দেশের অর্থনীতিতে কত বড় ভুমিকা তাঁরা রাখেন তার উল্লেখ কোথাও থাকে না। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টাকা রোজগার করলে তাঁরা বছরে কমপক্ষে ৭ লক্ষ কোটি টাকা আয় করেন। এই টাকার পুরোটাই তাঁরা খরচ করেন খাদ্য, বাসা ভাড়া, পোশাক, চিকিৎসা, যাতায়াত করার জন্য। ফলে দেশের অর্থনীতিতে এ এক বিশাল সংযোজনা। এই শ্রমজীবীরা রাজস্ব প্রদানেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। শুধু ভ্যাট প্রদানের কথা বিবেচনা করলেও তো তাঁরা ১ লাখ কোটি টাকার বেশি প্রদান করেন। এরা বাংকের ঋণ খেলাপি হয় না, বিদেশে টাকা পাচার করে না, বরং দেশের উৎপাদিত পন্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবদান অনস্বীকার্য কিন্তু করোনায় তাঁরা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ।

করোনা মহামারী সারা বিশ্বের অর্থনীতির গতিপথ এবং ধরন পালটে দেবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। করোনা ভাইরাস জনিত কারনে ব্যবসা সংকুচিত হওয়া, উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, মানুষের চলাচল কমে যাওয়ায় অনেক ধরণের পেশার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। করোনা দেখিয়ে দিয়েছে আভ্যন্তরীণ খাত দুর্বল রেখে উন্নয়ন অনেকটা বালুচরে বালু দিয়ে সৌধ নির্মাণ করার মত। দুর্দশা আর বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে সস্তা শ্রমিক আর রপ্তানিমুখি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভর করা অর্থনীতি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। মুনাফার আগ্রাসী থাবায় বিপর্যস্ত শ্রমিক যদি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যই ব্যস্ত থাকে তাহলে তার উৎপাদনশীলতার বিকাশ ও দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি কোনটাই সম্ভব নয়।

জীবিকা বা অর্থনৈতিক সমস্যা শ্রমজীবীদের জীবনে অনেক তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। সিপিডি আর অক্সফামের গবেষণা দেখাচ্ছে যে, করোনার প্রথম ধাক্কায় ৬২ শতাংশ শ্রমজীবী কাজ হারিয়েছেন। নতুন করে কাজ খুঁজেছেন তাঁরা। এক মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত বেকার ছিলেন অনেকেই। যারা কাজ পেয়েছেন তাদের আবার আয় কমেছে। আয় না থাকলে বা কমে গেলে মানুষ যা করে তাই করেছে এরা। ফলে জরিপে দেখা যাচ্ছে ৫২ শতাংশ মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমেছে। এটা তো জানা কথাই যে খাবারের সংকট হলে সবচেয়ে কষ্টে থাকে নারীরা, উপেক্ষিত হয় বৃদ্ধরা এবং পুষ্টি বঞ্চিত হয় শিশুরা। ৫০ শতাংশ মানুষের সঞ্চয় কমেছে। জাতীয়ভাবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও শ্রমজীবীদের মাথা পিছু ঋণ বেড়েছে। তাদের জন্যসরকারি সহায়তা ছিল অপ্রতুল। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সরকারী সহায়তা পেয়েছে। করোনাকালে সাহায্য সহায়তার জন্য মানুষ ছুটেছে বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের কাছে। কিন্তু এই মহামারীর মহাআতংকের সময় কে আর কাকে সাহায্য করে ! এতো গেল শ্রমজীবীদের কথা। নিম্নমধ্যবিত্তদের চাপা কান্না তো আরও বেদনার।

গার্মেন্টস মালিকেরা ২% সুদে সহজ শর্তে প্রথমে ৫ হাজার কোটি টাকা, পরে আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা হিসেবে পেয়েছেন। বড় শিল্পের মালিকেরা প্রণোদনা পেয়েছেন ৩০ হাজার কোটি টাকা, মাঝারি শিল্পের মালিকেরা পেয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা, কৃষি ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরাও পেয়েছেন ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের অর্থ বিভাগের এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, করোনা কালে শ্রমিক ও দরিদ্রদের জন্য যা বরাদ্দ হয়েছিল তা পুরোপুরি বিতরণ করা হয় নি। যেমন

  • কর্মহীন দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা – বরাদ্দ ২৫০০ কোটি টাকা অথচ বিতরণ হয়েছে ১০৬৮ কোটি টাকা।
  • সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো- বরাদ্দ ৮১৫ কোটি টাকা, বিতরণ ২৩ কোটি টাকা।
  • গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর নির্মাণ- বরাদ্দ ২১৩০ কোটি টাকা আর বিতরণ ১৪৭৪ কোটি টাকা।
  • দরিদ্র বয়স্ক এবং বিধবা নারীর ভাতা- ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আর বিতরণ ২৬২ কোটি টাকা।
  • ক্ষতিগ্রস্থদের নগদ আড়াই হাজার টাকা প্রদান- বরাদ্দ ১২৫৮ কোটি , বিতরণ হয়েছে ৮৮০ কোটি টাকা।
  • কর্মহীন শ্রমিকদের নগদ সহায়তা – বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা অথচ বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা।
  • ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণের জন্য বরাদ্দ – ৭৭০ কোটি টাকা, এই একটি ক্ষেত্রে বরাদ্দের টাকার শতভাগ ব্যবহৃত হয়েছে।

অর্থাৎ করোনার প্রথম প্রবাহের সময় যে অর্থ শ্রমিক কিংবা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল তার অর্ধেকও বিতরণ করা হয় নি। সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য লক ডাউন ঘোষণা করেছেন। দেশের স্বার্থে এটা জরুরী। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি শ্রমিক তো সরকারি কর্মচারী নন যে বেতনটা ঠিকমত পাবেন। কাজ বন্ধ থাকলে  শ্রমিকদের বাড়ীর চুলা জ্বলে না সেই কথাটা তো ভাবা দরকার ছিল। আমরা একটা হিসাব করে দেখিয়েছিলাম, বিজ্ঞানসম্মতভাবে ১৫ দিন লক ডাউনে চলাকালীন সময়ে অন্তত ১৫ কেজি চাল, ৩ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল আর নগদ ৫০০ টাকা করে দিলে প্রতি শ্রমিকের জন্য খরচ হত ২৫০০ টাকা। শ্রমিকরা ভাবতো যে সরকার তাদের পাশে আছে। কত খরচ হতো এতে? কাজ হারানো ২ কোটি শ্রমিকের জন্য ৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেই শ্রমিকদের ন্যুনতম সহায়তা করা সম্ভব হত। বাজেটের অনেক খাতের টাকা খরচ হয় নি, করোনার জন্য বরাদ্দ টাকা পুরোপুরি বিতরণ হয় নি, অতএব টাকার তো অভাব নাই। উৎপাদনের চালিকাশক্তি বলে আদর করে যাদেরকে ডাকা হয় সেই শ্রমিকদের প্রতি মনোযোগের অভাব উৎকট রুপে দেখা গেল করোনাকালেও।

কোটি শ্রমজীবীর এই দুর্দশাকালেও কিন্তু থেমে থাকে নি কোটিপতি তৈরি এবং তাদের আয় বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব থেকে দেখা যায় এপ্রিল ২০২০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ এই ৬ মাসে ১ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা বা তারও বেশি আমানত আছে এমন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ১০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ৫০ কোটি ও তার চেয়ে বেশি টাকা আছে এমন আমানতকারীর সংখ্যা ৬ মাসে বেড়েছে ৬৯টি। বাংলাদেশের টাকাওয়ালাদের টাকা যে সব ব্যাংকের মাধ্যমেই লেনদেন হয় তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। মাটি ফুঁড়ে এবং ছাদ ফেটে যাদের টাকা আসে তাদের টাকা বাতাসে উড়ে। ফলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় কোটিপতি বৃদ্ধির এই সংখ্যা আরও বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে। ১৯৭২ সালে ৫ জন কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশে এখন দেড় লাখের বেশি কোটিপতি আর ৮ কোটি মানুষ দরিদ্র। বিশ্বে দ্রুত গতিতে ধনী হওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষে থামেনি তাদের গতি, কমেনি তাদের সংখ্যা বরং বেড়েছে দ্রুত। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। করোনা কোটিপতি এবং করোনা দরিদ্র দুটোই বেড়েছে করোনার প্রথম ধাক্কায়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দ্বিতীয় ধাক্কার পরে দরিদ্র শ্রমজীবীদের সংখ্যা ও দুর্দশা আরও বাড়বে।কিন্তু এই শ্রমজীবীদের পিছনে ফেলে দেশের সুষম অগ্রগতি কি সম্ভব?

(লেখকঃ সভাপতি সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট)