করোনা বৃত্তান্তশাহীন আকতার হামিদ
ভাইরাস জীবন্ত প্রাণী নয়।একটিঅনুজীব, যার আকার ১৫০ ন্যানো মিটার মাত্র। কভিড ১৯ নামক এ ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। ভাইরাসটি সাধারণত বায়ুবাহিত এবং হাঁচি, কাশি ও কথা বলার মাধ্যমে ছড়ায়। এটি প্রোটিনের অণু (ডিএনএ) যা লিপিডের (চর্বি) মোড়কে মোড়ানো। এটা আমাদের নাক-চোখ-মুখের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে গেলে নিজের জেনেটিক কোড বদলে ফেলে শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। করোনা হোস্ট বডি ছাড়া বাঁচতে পারেনা। প্রাণহীন মাধ্যমে দাপিয়ে মারা যায় কিন্তু রক্ত মাংসের শরীরে ঢুকে সে পেয়ে যায় তার বাসস্থানের মোক্ষম পরিবেশ, তারপর শুরু হয় তার নিজের চেহারা ও গুনাগুন সমৃদ্ধ হাজার হাজার অণুজীবে রূপান্তরিত হওয়া, এরপর একে একে পুরো শরীর আয়ত্ত্বে নিয়ে চলে তার রাজত্ত্ব। করোনা ভাইরাস মূলত ফুস্ফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এ সংক্রমণের ফলে সাধারণত যে সমস্যা গুলো দেখা দেয় তা হলঃ
- জ্বর
- দূর্বলতা
- শুকনা কাশি
- খাদ্যে অনীহা
- শ্লেষ্মা তৈরি হওয়া
- সারা শরীরে ব্যাথা
- শ্বাস ফেলতে কষ্ট হওয়া
- গলা ব্যাথা
- মাথা ব্যাথা
- শরীরে ঠান্ডা অনুভূত হওয়া
- স্বাদ ও গন্ধ চলে যাওয়া
- বুকে চাপ সৃষ্টি হওয়া ও নাক দিয়ে পানি পড়া
- বমি ভাব হওয়া
- ডাইরিয়া হওয়া
যেসব উপসর্গ দেখা দিলে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয় তাহলঃ
- শ্বাসকষ্ট হলে
- বুকে অনবরত ব্যাথা হলে
- ঠোট ও মুখ মন্ডল নীল হয়ে গেলে
- হঠাৎ করে মানুষ কথা বলার স্বাভাবিক তা হারিয়ে ফেললে
স্ট্রোক হওয়া আর একটি মারাত্মক উপসর্গ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটা বুঝতে পারার কতগুলো বিষয় হলঃ
- হাত উপরে তুলতে না পারা
- মুখমণ্ডলের স্বাভাবিক আকৃতি অসাড় হওয়া বা বেঁকে যাওয়া
- স্বাভাবিভাবে কথা বলতে নাপারা
আরও যেসমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে তাহলঃ
- চোখ লাল হয়ে যাওয়া
- চোখ ফুলে যাওয়া
- জ্ঞান হারিয়ে ফেলা
- নার্ভে সমস্যা দেখাদেয়া
- রক্ত বমি করা
- রক্ত জমাট বাধা
- খিঁচুনি হতে পারে
- হার্টে সমস্যা দেখা দেয়
- কিডনি সমস্যা দেখা দেয়
- লিভার সমস্যা দেখা দেয়
শরীরে অন্য কোন অসুখ থাকলে ও একই সাথে যদি করোনা ভাইরাসে আক্রমণ করে তখন সেই অসুখগুলোকে করোনা ভাইরাসের কো-মরবিডিটি বলাহয়। সে অসুখগুলো হলঃ
- ক্রনিক শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালীর অসুখ ও ব্রংকাইটিস
- ক্যান্সার
- ক্রনিক হৃদরোগ, যেমন হার্ট ফেইলিওর
- ক্রনিক কিডনি সমস্যা
- ক্রনিক লিভার সমস্যা
- ক্রনিক নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা যেমন পারকিন্সন্স, মোটর নিঊরন
- ডায়াবেটিস
- স্প্লিন সমস্যা
- এইচ আই ভি
- ওভার ওয়েট
- প্রেগন্যান্সি(তবেএটাঅসুখনয়)
করোনা ভাইরাস এক মানুষের শরীর থেকে হাজার মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে নানা ভাবে। যেমনঃ
- হাঁচি, কাশি, শ্বাস-প্রশ্বাস ও কফের মাধ্যমে।
- হাঁচি, কাশি বা কফের মাধ্যমে সারফেস ইনফেক্টেড হলে, সেখানে মানুষের হাত পড়লে ভাইরাসটি তার হাতে চলে আসে এবং সে হাত দিয়ে নাক মুখ, চোখ স্পর্শ করলে সে ইনফেক্টেড হয়, অন্যের সাথে হাত মিলালে তাতে অপর ব্যক্তিটি ভাইরাসটি পায় এবং সে যদি মুখ, চোখ, নাক স্পর্শ করলে সে পায়। এভাবেই ভাইরাসটি তার আধিপাত্য বিস্তার করে। এটি একটি চেইন রিএকশন।
- যেহেতু ভাইরাসটি এক থেকে দুই মিটারের মধ্যে বাতাসে ভেসে থাকে, সুতরাং কোন ব্যক্তি আক্রান্ত ব্যাক্তির কাছাকাছি ওই দুরত্বর মধ্যে থাকলে সে আক্রান্ত হয়।
ভাইরাস কতক্ষণে ধ্বংস বা ক্ষয় হবে তা নির্ভর করে এর থাকার স্থানটির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও স্থানটি কী উপাদানে তৈরি, তার উপরে। যেভাবে সাবধানতা গ্রহণ করতে হবে তা নিম্নরূপঃ
- করোনা ভাইরাস ভঙ্গুর কারণ সুরক্ষার জন্য তা কেবল একটি চর্বির স্তর দিয়ে মোড়ানো। এ কারণেই সাবান ও ডিটারজেন্ট ভাইরাসটি থেকে মুক্ত হবার সহজ উপায়।
- গরম তাপমাত্রা চর্বি গলাতে কার্যকর। এজন্যে হাত বা কাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে অন্তত ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করা উচিত।
- অ্যালকোহল কিংবা অন্তত ৬৫% অ্যালকোহলের মিশ্রণ যে কোনো ধরনের তেল অথবা চর্বি ভাঙার জন্য উপযুক্ত। ভাইরাসের শরীরের বাইরের চর্বির স্তর ভাঙতে অ্যালকোহলের মিশ্রণ অত্যন্ত কার্যকর একটি উপায়।
- সাবান, অ্যালকোহল এবং ক্লোরিন যদি অক্সিজেন চালনা করা পানির (অক্সিজেনেটেড ওয়াটার) সঙ্গে ব্যবহার করা হয় তবে তা অপেক্ষকৃত দীর্ঘ সময় ধরে ভাইরাসের কার্যক্ষমতা ঠেকাতে সাহায্য করে। এর কারণ অক্সিজেন চালনা করা পানিতে থাকা পারঅক্সাইড ভাইরাসের প্রোটিনকে গলিয়ে ফেলতে পারে।
- ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত পোশাক, কাপড় বা চাদর ঝাড়া দেয়া যাবে না। কাপড় ঝাড়লে তা থেকে নিসৃত ভাইরাস কোথাও পড়লে সেখানেই আটকে থাকে।
- কাপড় বা সমধর্মী জিনিসে ৩ ঘণ্টা, তামা বা কাঠে ৪ ঘণ্টা (যেহেতু তামা নিজেই জীবাণু ধ্বংস করতে পারে এবং কাঠ ক্রমাগত আর্দ্রতা হারাতে থাকে), হার্ডবোর্ডের উপরে ২৪ ঘণ্টা, ধাতব জিনিসে ৪২ ঘণ্টা এবং প্লাস্টিকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভাইরাসটি টিকে থাকতে পারে। ভাইরাস আছে এমন কিছুকে ঝাড়া দিলে বা তার উপরে পালকের ডাস্টার ব্যবহার করলে ভাইরাসের অণুগুলো বাতাসে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ভাসতে পারে।
- ভাইরাস অণুগুলো ঠান্ডা আবহাওয়ায়, এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি বা গাড়িতে অত্যন্ত ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। বেশি কার্যকর থাকার জন্য ভাইরাসটির আর্দ্রতা এবং অন্ধকারের উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে।
- ইউভি লাইট ভাইরাসটিকে তার প্রোটিন ভেঙে যে কোনো কিছুর উপর থেকে ধ্বংস করতে পারে। এভাবে একটি মাস্ককে ব্যবহারের পর ভাইরাসমুক্ত করে আবারো ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু ইউভি লাইট যেহেতু ত্বকের কোলাজেন ভেঙে দেয় তাই মুখে বলিরেখা থেকে শুরু করে ত্বকের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
- স্প্রিট বা ভোদকা ভাইরাসটি ধ্বংস করতে কার্যকর নয়। ভোদকায় অ্যালকোহলের সর্বোচ্চ মাত্রা হতে পারে ৪০% কিন্তু ভাইরাসটি ধ্বংস হতে কমপক্ষে ৬৫% অ্যালকোহল দরকার।
- করোনা ভাইরাসকে ধ্বংস করে, অ্যালকোহলসমৃদ্ধ এমন কিছুর কথা ভাবলে একমাত্র বলা যেতে পারে কোনো কোনো লিসটারিনের (মাউথ ওয়াশ) কথা যাতে ৬৫% অ্যালকোহল থাকে। তবে বেশিরভাগ লিসটারিনে থাকে ২০% থেকে ৩০% অ্যালকোহল যা ভাইরাসটি ধ্বংসে কার্যকর নয়।
- বদ্ধ স্থানে ভাইরাসটির প্রকোপ বেশি হবে। উলটোদিকে উন্মুক্ত এবং বাতাস চলাচল করে এমন স্থানে ভাইরাসের উপস্থিতি কম হবে।
- নাক, খাবার, দরজার লক, যে কোনো সুইচ, রিমোট কন্ট্রোলার, সেল ফোন, ঘড়ি, কম্পিউটার, টেবিল ও টেলিভিশন জাতীয় জিনিস ধরার আগে ও পরে হাত ধোয়া জরুরি। ওয়াশরুম ব্যবহার করলে হাত তো ধুতে হবেই।
- বারে বারে ধোয়া হাত ভালোমতো শুকাতেও হবে। কারণ ত্বকের যে কোনো ফাটলে ভাইরাস লুকিয়ে থাকতে পারে। ত্বক আর্দ্রতাকারী লোশন বা ক্রিম যত ভারি ও তৈলাক্ত হয় তত ভালো।
- হাতের নখ ছোটো করে কেটে রাখা উচিত যেন তাতে ভাইরাস ঢুকে থাকতে না পারে।
আপনি যদি আক্রান্ত হয়েই পড়েন তখন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি ঔষধ খাবেন ও নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলবেন, যেমনঃ
- আইসোলেশনে চলে যাবেন
- আইসোলেশনে যাবার ব্যবস্থা না থাকলে বাসায় মাস্ক পড়বেন
- কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধুবেন
- বাচ্চা ও বয়স্কদের থেকে দূরে থাকবেন
- মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকুন
- যে সকল মায়েরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়ান তারা মাস্ক পড়ে ও হাত ধুয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবেন।
- প্রয়োজনে হাতের কাছে প্রেসার মাপারযন্ত্র, পালস অক্সিমিটার, থার্মোমিটার, ইনহেলার সাথে রাখবেন। যদি আপনার অক্সিজেন ৯৩ এর নিচে নেমে যায় সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে ফুস্ফুসের সংক্রমণ পরীক্ষা করবেন ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলবেন।
করোনা ভাইরাস যখন ফুস্ফুসে আক্রমণ করে তখন শরীরের ইমুনিটি(Immunity) সক্রিয় হয় ও ফুস্ফুসের কোষে ভাইরাস ঢুকলেই ইন্টারফেরন্স (Interferons) নামের যে রাসায়নিকপদার্থ(সাইটকাইন) কোষে থাকে তা যেসব কোষে ভাইরাস বাসা বাঁধে তাদের মেরে ফেলে। বেশির ভাগ রোগীর উপসর্গগুলো এভাবেই ভাল হয়ে যায়। ইন্টারফেরন যখন ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রনে আনতে না পারে তখন শরীরের অন্যান্য ইমিউন কোষ থেকে সাইটোকাইন(cytokine) নামে এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়ে এলপাথারি ভাবে ফুস্ফুসের কোষকে আক্রমণ করে, ফলে যেসব কোষগুলো ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়নি তারাও সাইটোকাইন দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যায় ও ফুস্ফুসের কোষ গুলো থেকে পানি বের হয়ে ফুস্ফুসের কার্য্যকারিতা নস্ট করে ফেলে। সাটকাইনের এ আক্রমণকে বলা হয় সাইটোকা ইনস্ট্ররম বা সাইটকাইনঝড়।
ফুস্ফুসসহ শরীরের অন্যান্য কয়েকটি অঙ্গের কোষের বাইরের দিকে ACE2 নামে বিশেষ প্রোটিন গ্রাহকআছে। যদি আক্রান্তের immunity ফুসফুস কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তবে সারা অঙ্গে ও করোনা ছড়াতে পারে। আর সারা শরীরেরই প্রবল Cytokine Storm এ বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে যায় ও মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
এই ১৫০ ন্যানোমিটারের RNA ভাইরাসটি যখন জীবের শরীরে প্রবেশ করে অসংখ্য প্রতিলিপি (replication) তৈরি করে, সে প্রতিলিপির পদ্ধতি অর্থাৎ প্রোটিয়েজ (RNA থেকে তৈরিহয় বিভিন্ন প্রোটিন, বিভিন্ন প্রোটিন জুড়ে জুড়ে শিকল তৈরি হয় এটাকে বলে পলিপেপ্টাইড, এই পলিপেপ্টাইড ভেঙ্গে ভেঙ্গে আবার প্রোটিন তৈরি হয়, এটাই প্রোটিয়েজ বা প্রতিলিপি তৈরির পদ্ধতি।)কে যদি ভেঙ্গে ফেলা যায় তবেই এর ধ্বংস হবে। আমরা সে সুদিনের অপেক্ষায়।
সূত্রঃ
https://www.webmd.com/lung/covid-19-symptoms#1