মতামত

“কিউবার কমিউনিস্ট শাসন কি অবসানের পথে ?” 

– খোরশেদুল ইসলাম

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ- এর এই লেখাটির বিষয়ে প্রগ্রেসিভ ফোরাম ইউ এস এর সভাপতি খোরশেদুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। এর প্রতিউত্তরে ড. ইফতেখার তাঁর মন্তব্য করেছিলেন। ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ এই লেখা দুটোর উপর জনাব খোরশেদুল ইসলাম আর একটি প্রতিক্রিয়া আমাদের পাঠিয়েছেন, যা আজ প্রকাশিত হল।

কিউবায় কমিউনিষ্ট শাসন নিয়ে   ড. আহমেদ এর ১ ম ও ২ য় লেখা গুলোকে আলোচনার

সুবিধার্থে  কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে ভাগ করে আলোচনা কার যাক।

১। ড. আহমেদ লিখেছেনঃ “ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে এবং বিরুদ্ধ মতকে

রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি accommodate করতে না পারে তাহলে কেন এবং কিভাবে তার পতন হতে পারে”।

পয়েন্ট ১ এর উপর আলোচনাঃ

বাংলাদেশে বা আমেরিকায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে? বাংলাদেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল গুলো আওয়ামী লীগ,বি এনপি,জাতীয় পার্টি যারা স্বাধীনতার পর ঘুরে ফিরে বার বার ক্ষমতায় গিয়েছে তারা কীভাবে কাজ করে? বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর পার্লামেন্ট ইলেকশানে কিছু ত্যাগী,নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদদের পার্লামেন্টে দেখা গেলেও বর্তমানে এসব দলের পার্লামেন্টের এম পি দের মধ্যে এমন কোন মানুষ দেখা যায়না। কারণ ? নির্বাচনে যে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয় তা কোন নিবেদিত প্রাণ কর্মী বা নেতার কাছে থাকতে পারেনা। এম পি নয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতেও কোটি টাকা খরচ করতে হয়। একজন সৎ মেধাবী পেশাজীবি তিনি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,আইনজীবি হলেও কোটি কোটি টাকা রোজগার করে নির্বাচনের জন্য খরচ করা প্রায় অসম্ভব। তাই এ’যুগে সব দলের প্রার্থিদের ৯০ ভাগই থাকে ব্যবসায়ি। ইদানিং শোনা যাচ্ছে এসব রাজনীতিবিদদের  মধ্যে নাকি ঋণ খেলাপি,বিদেশে টাকা পাচারকারি,ট্যাক্স ফাঁকিবাজ এমনকি অনেক মামলার আসামিও নাকি আছে । বাংলাদেশের এই পূঁজিবাদি দল গুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি কোটি কোটি  দরিদ্রদের একোমোডেট করে? না করেনা। কারণ জাতিয়তাবাদি বা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদি দল গুলো ( আওয়ামী লীগ,বিএনপি,জাতীয় পার্টি,জামায়াত ইত্যাদি দল) শোষন মুক্তির কোন আদর্শে বিশ্বাসি নয়।  দারিদ্র বিমোচনের বা নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু,আদিবাসিদের সহ সব নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কোন আদর্শগত অঙ্গিকারও এসব দলের নেই । এসব দলের সমাজে বৈষম্য দূরিকরণের কোন কর্মসূচিও থাকেনা(থাকলেও তা  হলো জনগনকে বিভ্রান্ত ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে) কারণ তারা সমাজের শোষন ব্যবস্থা উচ্ছেদে বিশ্বাসি নয়। এই শোষণ-বৈষম্য ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চলছে হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বের সব দেশে,সব সমাজে। তাই সাধারন মানুষ,মনীষীরা,কবি সাহিত্যিকরা চিরকাল তাদের কাব্য সাহিত্যে শোষনহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন । তাই সামন্ত রাজা-বাদশাহরা মিলে শোষণ বিরোধি যেকোন উদ্যোগকে নির্মম ভাবে দমন করেছেন। যেমন,  ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের প্যারি কমিউনকে নির্মূল করে। এভাবেই সোভিয়েতের শ্রমিক কৃষকরা ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব করলে পূঁজিবাদি শাসকদের ১৪ টি দেশ রাশিয়াকে আক্রমন করে। শুধু শিশু সোভিয়েত দেশকে ধবংস করতে পূঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদিরা কিভাবে মরিয়া ভাবে চেষ্টা করেছিল তা সঠিক তথ্য সহ দেখুনঃ  সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আমেরিকা থেকে সৈন্য এলো ১৩ হাজার,

জাপান থেকে ৭০ হাজার,

কানাডা থেকে ৪৭০০,

বৃটেনের ১৮০০+৯৫০+১৪৩৭৮,

ফ্রান্সের ১৫০০০,

অষ্ট্রেলিয়ার ১৫০,

ইটালির ১৩০০+২৫০০,

রুমানিয়ার ৫০,০০০,

 গ্রিসের ২৩,৩৫১,

এস্টোনিয়ার ১১,৫০০,

এছাড়াও বৃটিশ ভারত থেকে,সার্বিয়া,পোলান্ড, আর চেকোশ্লোভাকিয়ার সৈন্যরা এলো বিশাল রাশিয়ায় কেউ পূবের সাইবেরিয়ায়, কেউ পশ্চিমের বাল্টিক থেকে,কেউ দক্ষিনের ইরানের কাছ থেকে আক্রমন করেছিল। কিন্তু সেই লেনিনের চাষা-ভূষার লাল ফৌজের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল পরাক্রমশালি মার্কিন,বৃটিশসহ ১৪ দেশের আক্রমনকারিরা ।  এরাই নাকি লেখক ড. আহমেদের মতে   “বহু মত এবং পথকে ধারণ করবার মত ব্যবস্থা গড়েছে “,এসব পূঁজিবাদি সাম্রাজ্যবাদি রাষ্ট্রেই নাকি  “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে” দেশে দেশে  আক্রমন করে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা কতটুকু ভিন্নমতকে সহ্য করে! দেখু্নসূত্রঃ(https://en.wikipedia.org/wiki/Allied_intervention_in_the_Russian_Civil_War)

অতীতের সেই ১৯১৭ সালের কথা বাদ দিন। এই পূঁজিবাদি শোষকদের  চরিত্রে কি এখন কোন পরিবর্তন কি এসেছে ? মোটেইনা। পূঁজিবাদি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দুই দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে। এসব দেশে মানুষরা একটির উপর আস্থা উঠে গেলে অন্যদলকে ভোট দেন। কিন্তু তারাতো আসলে একই শোষক ধনিক-বণিক-মালিকদের দল। যেই দলকেই ভোট দিক, সমাজে শোষন-নির্যাতন একবিন্দুও কমেনা।

বিরুদ্ধ মতকে,রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কিভাবে “একোমোডেট” করতে হয় নাহলে কীভাবে তার পতন হতে পারে(!) তা আমেরিকান বৃটিশ আর তাদের দোসররা ১৯১৭ থেকে হালের এই ২০২১ পর্যন্ত সারা বিশ্বে  আমাদের শিক্ষা দিয়েই যাচ্ছে! ড আহমেদ কি এসব আগ্রাসনকে এখনো বিরুদ্ধ মতকে একোমোডেট করা বলবেন ? সাম্প্রতিক ইরাক,সিরিয়া, ইয়েমেন,ইরান,আফগানিস্তানের যুদ্ধ,অস্ত্র বিক্রি,আগ্রাসন,ধবংস হত্যাকে তিনি  আজো সমর্থন করেন? তিনি কি তাদের পক্ষে?

২। ড আহমেদ লিখেছেন “এটি বোঝার জন্য David Easton এর “Political system theory” আজো প্রযোজ্য বলে আমার কাছে মনে হয়। আগ্রহীরা তাঁর তত্ত্ব পড়ে দেখতে পারেন”।

পয়েন্ট ২ এর উপর আলোচনাঃ

ড. আহমেদ এর এই স্বপ্নের বই খানা ইন্টারনেটে যে কেউ পড়তে পারেন।বইটি ফ্রি ডাউন লোড করা যাবে। কিন্তু  ডেভিড এস্টনের বইয়ে রাজনৈতিক  সিস্টেম এর বিভিন্ন পদ্ধতি, সমস্যা ও সমাধানের ব্যাখ্যা থাকলেও কোথাও নেই যে তাঁর এই ব্যবস্থা সমাজে কিভাবে বাস্তবায়িত হবে ? আর কোটি কোটি নাগরিকের নাগরিকেরা যেন শিক্ষিত সচেতন ও উদ্যোগি না হয় সেজন্য কোন পূঁজিবাদি  রাষ্ট্র সেরকম কোন উদ্যোগ নেয়না। শুধু শ্রমিক কৃষক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবিরাই এসব উদ্যোগ নেয়। (   রবীন্দ্রানাথের মত এশিয়ার প্রথম  নোবেল লরিয়েট যখন “রাশিয়ার চিঠি” তে লেখেন, “যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোন দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ,আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে

তুলছে।—এখানে এসে যেটা সবচেয়ে আমার চোখে ভালো লেগেছে সে হচ্ছে এই ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ তিরোভাব। কেবলমাত্র এই কারণেই এ দেশে জনসাধারণের আত্মমর্যাদা এক মুহূর্তে অবারিত হয়েছে। চাষাভূষো  সকলেই  আজ অসম্মানের বোঝা ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে”। —রাশিয়ায় এসেছি-না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত”। শুধু তিনি প্রশংসাই

করেননি,সমালোচনাও করেছেন।যেমন “শিক্ষা বিধি”র সমালোচনাসহ বিভিন্ন সমালোচনাও করেছেন বিশ্বকবি।) রাশিয়া,চীন,ভিয়েতনাম,কিউবা সব দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরই প্রথমেই আম জনতাকে শিক্ষিত করার জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হয় তা সাধারণ ভাবে পূঁজিবাদি দেশে তা  দেখা যায়না।

কোন দেশের  শোষকরা কি লেখক এসটনের কথা অনুযায়ী বিশ্বের কোন দেশে  শোষন নির্যাতন বন্ধ করে মানুষের মৌলিক খাদ্য,শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান,কর্মসংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে? উলটো কিউবার মতো কোন দেশের শ্রমিক মেহনতিরা শোষকদের উৎখাত করে সমাজ বিপ্লব করলে তাকে ধবংস করার জন্য এরা কি না করে। দেখা যাক ড. আহমেদের এই পলিটিক্যাল সিষ্টেম কোন লড়াই সংগ্রাম ছাড়াই  বিশ্বের কোন দেশে বাস্তবায়িত হয় কিনা। তাহলে কোন দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষদের আর কষ্ট করে কোন লড়াই সংগ্রাম করতে হবেনা! বিনা যুদ্ধেই মেহনতিরা পাবে সবকিছু !

৩। ড আহমেদ লিখেছেনঃ   “সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন এবং পতন পরবর্তী সঙ্কট বোঝার জন্য বামপন্থীরা এখনো যদি অফিসিয়াল সোভিয়েত এবং চাইনিজ মার্কসবাদের উপর নির্ভর করে থাকেন,তাহলে বুঝতে হবে যে বিশ্বে বামপন্থী আন্দোলনের আর কোন ভবিষ্যত নেই”

পয়েন্ট ৩ এর উপর আলোচনাঃ

সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপের পতনের পর সোভিয়েত ও চীনের ছাপানো মার্ক্সবাদের বই গুলো পরিত্যাগ করতে হবে,তাইনা ? কিন্তু কেন? সোভিয়েতের পতন হয়েছে বলে ? ড. আহমেদ তো বলছেন না যে   ভিয়েতনামের,কিউবার সংগ্রামের ইতিহাস বা অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের ইতিহাস পড়ুন বা  মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিনেরবই গুলো পড়ুন। সোভিয়েত বিপ্লবের ইতিহাস,কিভাবে বিপ্লব হলো,সত্তর বছর পর কেন তা ভেঙ্গে গেল ,তার ব্যর্থতার কারণগুলো কি কি,তা থেকে আমরা কি কি  শিক্ষা নেব তার কিছুই পর্যালোচনা না করলে আমরা ভবিষ্যতে এগুনোর শিক্ষা ও পাথেয় পাবো কোথায়? আর মার্ক্স নিজেইতো প্যরি কমিউনের পতনের পর তার পর্যালোচনা করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমরাও তাই সোভিয়েতের ও পূর্ব ইউরোপের পতন থেকে শিক্ষা  নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো। বিশ্বের সব দেশের বই মুক্ত মনে পড়বো। আর চীনের সরকার এখন যে মার্কিন ও অন্যান্য দেশের বাধার মুখে পড়ছে,সেগুলো তারা কিভাবে অতিক্রম করছে তা কি আমাদের ভবিষ্যতে কোন কাজে  লাগবে না, বিশ্ব প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য পাথেয় হবেনা?  ড. আহমেদ আমাদের এসব সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে না বলে কেন চমস্কি,তারিক আলী,ডেভিড এসটোনের চিন্তার দিকে  নিয়ে যেতে যাচ্ছেন?

৪। ড আহমেদ লিখেছেনঃ    “ তবে আশার কথা হচ্ছে,নোয়াম চমস্কি,তারেক আলীসহ অনেক বামপন্থীই সোভিয়েত, চীনের  “Officialbox” থেকে বের হয়ে এসে নানা আঙ্গিক থেকে বাম আন্দোলনের সঙ্কটগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন”। তিনি আরো লিখেছেন, (মার্ক্স)  কোন দল বা ব্যক্তির একনায়কত্বের কথা বলেননি। শ্রেণীর এবং দলের একনায়কত্ব এক বিষয় নয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ দুনিয়ার কোন দলই শুধুমাত্র একটি শ্রেণী থেকে আগত লোকজন নিয়ে গড়ে উঠে না। বাস্তব ক্ষেত্রে সামজতান্ত্রিক দাবীদার দেশগুলিতে সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের দাবী করে প্রথমে দল এবং পরে ব্যক্তির একনায়কত্ব কায়েম হয়েছিল। কিউবাও এর ব্যতিক্রম নয়।

 পয়েন্ট ৪ এর উপর আলোচনাঃ

তাহলে আমরা এসব বই না পড়ে শুধু ডেভিড এসটোন, চমস্কি(৯২),তারিক আলীর(৭৭) বই গুলো পড়লেই ভবিষ্যতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেহনতি মানুষের স্বপ্নের সমাজ কায়েম হবে। বিশ্ব থেকে শোষন উচ্ছেদ হয়ে যাবে,তাইনা?  কিন্তু কারা এসব নোয়াম চমস্কি,তারিক আলী? আমেরিকান পন্ডিত চমস্কি একজন ভাষা বিজ্ঞানি।তাঁর বয়স এখন ৯২ বছর। কিন্তু ৯২ বছরেও তিনি বুর্জোয়াদের উৎখাত করে শোষনহীন সমাজ করার জন্যে ( মার্ক্স,লেনিনের মতো) কোন বই লিখেন নি। আর তিনি তেমন আদর্শে বিশ্বাসও করেননা। তিনি একজন এনার্কিষ্ট বা নৈরাজ্যবাদি। এই নৈরাজ্যবাদিদের মধ্যে আবার একের সাথে অন্যের চিন্তায় অনেক তফাৎ। তিনি এর মধ্যে এনার্কো সিন্ডিক্যালিষ্ট ধারার চিন্তক। সাধারনভাবে নৈরাজ্যবাদিরা মানুষের বা প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার,ব্যক্তি স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং কোন সুশৃংখল সংগঠনে যোগ দেয়াকেও পছন্দ করেনা কারণ তাতে সদস্যদের ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকেনা,দলের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত থাকলেও তা বাইরে প্রকাশ করা যায়না। আর তারিক আলী(৭৭) পাকিস্তানের লাহোরে জন্ম নেয়া এক বিখ্যাত সাংবাদিকের মেধাবি পুত্র।  তাঁর মা একপর্যায়ে পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য হন এবং নিজের মূল্যবান সামগ্রী পার্টিকে আন্দোলন সংগ্রামের জন্য দান করেন। তার বাবা-মা পাকিস্তানি শাসক সামরিক জান্তার হাত থেকে পুত্রকে রক্ষার জন্য বিলেতে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই এই মেধাবির  জীবন কাটছে আজো । মাতৃভূমি পাকিস্তানকে  শোষন থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি আজো পাকি শাসকদের মুখোমুখি না হয়ে বিলেতেই বিখ্যাত বাম রাজনীতিবদ। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারি তারিক আলী দর্শন,অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর উচ্চ শিক্ষা নিয়ে অনেক জ্ঞানের অধিকারি,যুদ্ধের বিরুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারসহ অনেক উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে বিতর্ক করে তিনি তরুণ সমাজের কাছে অতি প্রিয় ও পরিচিত মুখ। তিনি দীর্ঘদিন অক্সফোর্ড ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন,মার্ক্সবাদের উপর তাঁর লেখা ও গবেষণা থাকলেও তিনি কখনো কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ নেননি। শোষণের সমাজ উৎখাতের জন্য কোন বিপ্লবি সংগঠনও তিনি গড়েন নি। তাঁকে জানলে পড়লে আমাদের জ্ঞান বাড়তে পারে কিন্তু সমাজ বদলের কাজটি কে করবে ? ড. আহমেদ যে লিখেছেন, মার্ক্স কোন দল বা ব্যক্তির( স্থায়িভাবে) একনায়কত্বের কথা বলেননি। শ্রেণীর এবং দলের একনায়কত্ব এক বিষয় নয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ দুনিয়ার কোন দলই শুধুমাত্র একটি শ্রেণী থেকে আগত লোকজন নিয়ে গড়ে উঠে না” তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু সুশৃংখল সংগঠন ছাড়া ধনিক বণিকদের নিপীড়ন মূলক আইন,বিচার,জেল,ফাঁসির হাত থেকে সমাজকে বের করে নতুন শোষণহীন সমাজ গড়া অসম্ভব। তা লেনিন প্রথম যৌবনেই বুঝেছিলেন,যখন তার বড় ভাইকে জার সম্রাট ফাঁসি দেয় সন্ত্রাসি হিসেবে। তিনি তখনই বলেছিলেন,”এই পথ আমাদের পথ নয়”। অর্থাৎ জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদ নয় মেহনতি মানুষের সচেতন বিপ্লবি সংগঠনই শুধু দেশের মানুষকে মুক্ত করতে পারে। তিনি ও রুশ পার্টির প্রায় নেতারাই সূদুর সাইবেরিয়ায় নির্বাসনসহ জেল,জুলুমে নির্যাতিত হলেও তাঁর সংগঠন কোন হঠকারি বা সন্ত্রাসি,নৈরাজ্যের পথে ধাবিত হয়নি। কিন্তু নৈরাজ্যবাদিরাতো এমন লৌহ কঠিন শৃংখলাতেই বিশ্বাস করেনা। সমাজ বদলের লড়াইর জন্য যে (সাময়িকভাবে) নিজেদের বিজয় ছিনিয়ে আনার স্বার্থে নেতা কর্মি ও সদস্যদের ব্যক্তিগত অনেক অধিকারই স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে হবে। যেমন লেনিন কোন সত্যিকার পিতৃদত্ত নাম নয়,এটা একটা ছদ্ম নাম । এরকম সব দেশের বিপ্লবি নেতারাই বার বার শোষক নির্যাতকদের হাত থেকে নিজেদের  রক্ষার জন্য ভিন্ন নাম, ছদ্ম নাম ধারণ  করেছেন। কিন্তু শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এনার্কিষ্টরা এমন কোন সংগঠন করাকে বা চরম পন্থা গ্রহন করা পছন্দ করেন না। কিন্তু তাঁরা নিজেদের বামপন্থি পরিচয় দিতে খুব আগ্রহি ! সমাজতন্ত্র অভিমুখি দেশগুলো নিজেদের লৌহ যবনিকার আড়াল থেকে বের হতে পারছেনা কেন তা কি ড. আহমেদ এখনো ভেবে দেখেন নি? প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশকে ধবংসের জন্য আমেরিকা,বৃটিশ,জাপান, জার্মান,ফ্রান্স,ইতালি,স্পেন ইত্যাদি পূঁজিবাদি,উপনিবেশবাদি, সাম্রাজ্যবাদি দেশ গুলি সক্রিয় ছিল,এখনো আছে। কিভাবে তারা লৌহ যবনিকা থেকে বের হবে? সারা দুনিয়ায় ৮০০ এর বেশি সামরিক ঘাঁটি গেড়ে আমেরিকা যে নিজের স্বাধীন গনতান্ত্রিক  আদর্শ শুধু কিউবায় নয়, বিশ্বের সব দেশের উপর চাপিয়ে দিতে আগ্রহি তা কি ড আহমেদের  জানা নেই ?

৫। ড আহমেদ লিখেছেনঃ  “রুশ বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৪৫ সালে জর্জ ওরয়েল লিখেছিলেন রাজনৈতিক স্যাটায়ার ধর্মী উপন্যাস Animal Farm। তিনি সেখানে সোভিয়েত ব্যবস্থায় মানুষকে খোঁয়াড়ের পশুতে রূপান্তরের সাথে তুলনা করেছেন। বস্তুত পশুর সাথে মানুষের পার্থক্যের জায়গাটা এখানেই। তাঁকে যত উন্নত জীবনের নিশ্চয়তাই দেওয়া হোক না কেন, মানুষ কোন খামার বা বন্দিশালায় বাস করতে চায়না। আবার সব মানুষ একই ভাবে ভাবতে বা চিন্তা করতেও চায় না। মানুষের চিন্তাভাবনার মাঝে রয়েছে বৈচিত্র্যতা এবং ভিন্নতা। দেখা গেছে যে রাষ্ট্র যত বেশী চিন্তার বৈচিত্র্যতা এবং ভিন্নতাকে ধারণ করতে পারে, সে রাষ্ট্র তত বেশী শক্তিশালী”। “বাস্তব ক্ষেত্রে সামজতান্ত্রিক দাবীদার দেশগুলিতে সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের দাবী করে প্রথমে দল এবং পরে ব্যক্তির একনায়কত্ব কায়েম হয়েছিল’’। সার্বিক ভাবে মার্কস কখনো একনায়কত্বের পক্ষে ছিলেন না, বরং “সবাই যাতে মুক্ত ভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলবার পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন”।

পয়েন্ট ৫ এর উপর আলোচনাঃ

ড.  আহমেদ এর এই বাক্যটি কি একেবারেই ভ্রান্ত নয় ? আদিম সাম্য সমাজ ভাঙ্গার পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কিসের সমাজ চলছে? দাস যুগ ,সামন্ত যুগ ও পূঁজিবাদের যুগ-সবগুলোই শোষন নির্যাতনের যুগ।কোন দেশে,কোন রাজার দেশে ভিন্নমত চালু ছিল ড. আহমেদ ? যীশুর জন্মের আগে না পরে? শাসক রাজা-বাদশা আর ধর্মের পান্ডারা মিলে সারা বিশ্বে শোষণ-নির্যাতনের ষ্টীমরোলার চালিয়েছে! ভিন্নমত ধারণ ও প্রচারের জন্য মহা জ্ঞানি সক্রেটিস সহ অনেক সত্য সন্ধানিকে হত্যা করেছিল কারা ? প্রথম দিকে রাজারা মিশরের পিরামিডের স্রষ্টা সম্রাটরাতো তারাই ভগবান বলে প্রজাদের বুঝাতো।  সম্রাট রাজাদের সাথে ধর্ম গুরুরা হাত মেলায় এবং মানুষকে বোঝায় যে শাসক রাজা-সম্রাটরাতো ঈশ্বেরের বংশ।পরের যুগে বলতো শাসকরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, ঈশ্বরই রাজাকে রাজবংশকে মানুষের কল্যানের জন্য ক্ষমতা দিয়েছেন। “চার্চের ও অন্যান্য ধর্মগুরুর কথা যে চির সত্য” একথাতো সে যুগের মুর্খরাও জানতো ! বিংশ শতাব্দিতে হিটলারও বলতো ভগবান জার্মান জাতিকে পাঠিয়েছেন,বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য,নিচু-নিকৃষ্ট জাতিগুলোকে আগাছার মতো পিষে,উপড়ে ফেলার জন্য ! রোমান সাম্রাজ্য টিকে ছিল দেড় হাজার বছর । যীশু খৃষ্টের জন্মের আগে থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত। এসব দাস ও সামন্ত যুগ ছিল নির্মম শোষন ও নির্যাতনের যুগ । । হলিউডের অনেক বিখ্যাত সিনেমা আছে রোমান সাম্রাজ্যের উপর,যীশুর জীবনের উপর। যিশুকে হত্যা করেছিল এসব রোমান সম্রাটরাই। সে সব ছবি দেখলে সে যুগের কিছু ধারণা পাওয়া যায়। দাসদের মধ্যে মল্ল যুদ্ধ হতো। বিজয়ী পরাজিতকে হত্যা না করা পর্যন্ত সম্রাট ও দর্শকরা তাকে হত্যা করার জন্য প্ররোচিত করতো। হত্যা করলে সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতো।  অর্থাৎ দাসদের হত্যা দেখলেই মালিক সম্রাটরা আনন্দিত, প্রফুল্ল হতো।

রুশ বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৪৫ সালে জর্জ ওরয়েল লিখেছিলেন রাজনৈতিক স্যাটায়ার ধর্মী উপন্যাস Animal Farm। তিনি সেখানে সোভিয়েত ব্যবস্থায় মানুষকে খোঁয়াড়ের পশুতে রূপান্তরের সাথে তুলনা করেছেন । লক্ষ করুন  এই লেখক জর্জ ওরয়েল কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে যে দাস-সামন্ত ও পূঁজিবাদি সমাজ চলছে, সমস্ত মেহনতি মানুষের উপর শোষন নির্যাতন আজো চলছে তাকে নিয়ে কি কোন উপন্যাস লিখেছেন ?  লিখেছেন,সোভিয়েত সমাজকে নিয়ে। অর্থাৎ এসব লেখক বুদ্ধিজীবিদের কাছে শোষণের সমাজ পশুর খোঁয়ার নয়,যেখানে শোষনের দাস সামন্ত ও পূঁজিবাদি সমাজটাকে শ্রমিক-কৃষকরা তাদের শ্রমে- ঘামে উৎপাদন করে সমাজটাকে চালু রাখে কিন্তু এই মেহনতিরা নিজেদের পেট পুরে খেতে পায়না,কোন মৌলিক অধিকারই পায়না, আর আমাদের জ্ঞানী

লেখক ড. আহমেদ সেই লেখক ওরয়েল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাদের বোঝাতে চাচ্ছেন যে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজ হলো একটা পশুর খামারের মতো। যেন বিশ্বের পূঁজিবাদি দেশগুলো হলো আদর্শ মানব খামার। যেখানে মানব শুধু দেহের খাদ্য নয় মনের খোরাক,ব্যক্তির চিন্তার,স্বাধীনতা, বৈচিত্র্যতা  এবং ভিন্নতা ধারণ করতে পারে। সব কিছুই পূঁজিবাদে পাওয়া যায় !

এটা কি সত্যি? মোটেই তা সত্য নয়। আমেরিকার রেডিও,টিভি,মিডিয়া,দৈনিক পত্রিকার অধিকাংশই মাত্র কয়েকটি পরিবারের হাতে। আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া হলো রুপার্ট মারডক আর নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন মেয়্রর ব্লুমবার্গ সহ কয়েকটি পরিবারের হাতে। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখুন বিশ্বের অধিকাংশ মিডিয়ার মালিকানা হচ্ছে মাত্র ৩০ জন মানুষের হাতে।

সারা পৃথিবীতে মিডিয়ার প্রচারের কল্যাণে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে, আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পূঁজিবাদি দেশগুলো হচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সুখ শান্তি আর স্বাধীনতার এক মহান স্বপ্নের দেশ। কিন্তু সেই স্বপ্নের আমেরিকার বাস্তব জীবনটা কেমন? এদেশের সব নাগরিকরা কি শুধু দুধ আর মধু খায়?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচাইতে ধনী ও সম্পদ শালী দেশের দরিদ্র নিঃস্ব অভাবী ৪কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষ খাদ্যের জন্য সরকারি সহায়তা ফুড ষ্ট্যাম্প কার্ডের উপর নির্ভরশিল। ১০% মানুষের অর্থাৎ ৩৩ কোটির মধ্যে ৩ কোটি ৩০ লক্ষের  কোন স্বাস্থ্য বীমা নেই।  কারণ দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের  নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের নয়। মুক্ত বাজারের মুনাফা শিকারি স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়েছে সরকার জনগনের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার দায়িত্ব। আমেরিকায় দারিদ্র সীমার নিচে আছে সাড়ে ১০ ভাগ মানুষ।্মুক্ত বিশ্ব ও স্বাধীনতার দেশ আমেরিকায় পৃথিবী মধ্যে প্রতি লাখে সবচেয়ে বেশি মানুষ জেলখানায় আছে। পুলিশের গুলিতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এর মধ্যে কালো ও হিস্পানিকরা মারা যায় সবচেয়ে বেশি। হাই স্কুলের পর কলেজ ভার্সিটিতে   উচ্চ শিক্ষা নিতে গেলে প্রায় লক্ষ ডলার শিক্ষা ঋণ নিতে হয় যা পরিশোধ করতে হয় ৫০ বা মধ্য বয়স পর্যন্ত। ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে একটি বাড়ি কিনলে ৩০ বছর ধরে তা পরিশোধ করতে আরেকটি বাড়ির দামের সমান অর্থ ব্যাঙ্ককে দিতে হয়। অর্থাৎ বিশ্বের সব চাইতে ধনী দেশের কোটি কোটি মানুষের খাদ্য,শিক্ষা,চিকিৎসা,বাসস্থান ইত্যাদির জন্য সরকারের বা বড় প্রাইভেট বড় বড় কোম্পানিগুলোর কাছে হাত পাততে হয়। এজন্য অনেকেই একটি নিয়মিত কাজের সাথে পার্ট টাইম আরেকটি কাজ করেন। কিন্তু  ড. আহমেদের মতো মানুষদের সে জন্য কোন সমালোচনা নেই। কম আয়ের দেশ কিউবা,ভিয়েতনামে বা চীনে বা কোন সমাজতন্ত্র অভিমুখি দেশে কি মানুষের এসব মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে এমন তীব্র বৈষম্য্ আছে ? নেই। কেউ শিক্ষা বা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়না। এসব মৌলিক শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান ইত্যাদি সবাইর সমান অধিকার।  রুশ বিপ্লবের পর ৮ কর্ম ঘন্টা,ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার,নায্য বেতন ও সুযোগ সুবিধা চালু হয়। কৃষকদের মধ্যে ভূমি বন্টন সহ সমবায় ব্যবস্থা চালু হয়। সার্বজনীন গন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। বিশ্বে সর্ব প্রথম নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃত

হয়। নারীদের মজুরি বৈষম্য্ বিলুপ্ত হয়। শিক্ষায় ও কর্মে নারীরা সর্ব ক্ষেত্রে সমানাধিকার পায়। বিশ্বে সর্ব প্রথম গর্ভবতি নারীদের সবেতন ছুটি ও সুযোগ সুবিধা চালু হয়। যেমন আজকের  কিউবার মাথাপিছু আয় আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। কিন্তু কিউবায় মানুষের এসব মৌলিক অধিকার সবার জন্য সমান। কেউ সেবার বাইরে নয়। কিউবায় প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এমনকি পি এচ ডি করাও ফ্রি। আর নাগরিকদের সুস্থ সবল কর্মঠ রাখা সরকারেরই দায়িত্ব তাই সব চিকিৎসাই ফ্রি। তারা জোর দেয় অসুস্থতার আগেই রোগ  প্রতিরোধের উপর। তাই তারা কম খরচে বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেবে বিশ্বের সব চাইতে উন্নত চিকিৎসা দেয় এবং গবেষনাও করে। কিউবার গড় আয়ু প্রায় ৭৯  বছর, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  ৭৮ বছর।অথচ আমেরিকায় মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় বছরে ৯৪০৩ ডলার আর কিউবায় জনপ্রতি চিকিৎসা ব্যয় মাত্র ৮১৩ ডলার। অর্থাৎ আমেরিকার দশ ভাগের একভাগেরও কম। অথচ কিউবার মাথাপিছু আয় ২০১৯ সালে ছিল ৮৫৪১ ডলার বা আমেরিকার ১০ ভাগের একভাগ।আর আমেরিকায় দারিদ্র সীমার নিচের একজন মানুষের ২০২১ সালের ফেডারেল দারিদ্র সীমার নিচের আয়ের সীমা হলো ১২,৮৮০ ডলার। অর্থাৎ আমেরিকার দরিদ্রদের আয়ও কিউবার গড় আয়ের চাইতে বেশি। কিউবায় বেকারত্বের হার  যা ১৯৯১ সালে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৯.৭শতাংশ এবং ২০১৯ সালে তা নেমে আসে ১.২০ শতাংশের সর্বনিম্ন রেকর্ডে। এর পর লেখক ড.  আহমেদ লিখেছেন “ বাস্তব ক্ষেত্রে সামজতান্ত্রিক দাবীদার দেশগুলিতে সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের দাবী করে প্রথমে দল এবং পরে ব্যক্তির একনায়কত্ব কায়েম

হয়েছিল”। ড আহমেদ বলুন বিশ্বে কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি এ পর্যন্ত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোন বিপ্লব হয়েছে? রাশিয়া,চীন,ভিয়েতনাম কোরিয়া,কিউবা ইত্যাদি কোন দেশেই বুর্জোয়া গনতন্ত্র ছিলনা, এসব সমাজে প্রায় ক্ষেত্রে ছিল রাজতন্ত্র ও সামন্ত সমাজ। আর শ্রমিক-কৃষক বিপ্লবিরা এসব রাজা,সম্রাট বা সামন্ত প্রভূদের হাতে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে। বিপ্লবের পরও প্রতিবেশি, বিদেশি শোষক শাসকরা সমাজতান্ত্রিক সরকার গুলোকে উৎখাতের জন্য সব সময় সচেষ্ট ছিল,এখনো আছে। যেমন ক্ষুদ্র দেশ কিউবায় বছরে লেখক যেমন লিখেছেন “ কিউবার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বছরে ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে” ,বিশ্বে যতক্ষণ সাম্রাজ্যবাদি দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলোকে ধবংসের জন্য ত্ৎপরতা বন্ধ করবেনা,ততক্ষণ সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলো নিজ নিজ দেশের ভিতরে,পার্টির ভেতরে, কোন মুক্ত স্বাধীন গনতান্ত্রিক  পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতেও ভয় পাবে। আর এতে ড. আহমেদের মতো জ্ঞানী লোকরাও যদি মনে করেন,এজন্যে আমেরিকা বা পূঁজিবাদিরা নয় কিউবান বা  সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোই দায়ি এবং এসব আগ্রাসি তৎপরতা বন্ধের জন্য ড. আহমেদের মতো জ্ঞানি কলাম লেখকরা যদি সোচ্চার হতেন,তাহলে হয়তো মার্কিন সরকার নিজ দেশে ও ভিন্ন দেশে তাদের ভিন্ন মতের প্রতি ষড়যন্ত্র বন্ধ করতো বা কমাতো। এখনতো এসব লেখকরা উল্টো আমেরিকাকে নয় কিউবাকেই দোষারোপ করছেন দেখছি!

পয়েন্ট ৬ এর উপর আলোচনাঃ

ড আহমেদ লিখেছেনঃ  (ক,খ,গ,ঘ,ঙ আমার দেয়া-খ)

ক। নানাবিধ মার্কিন এবং পশ্চিমা চাপের মাঝে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোটামুটি জনসমর্থন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় টিকে আছে, সে দেশটিতে হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, রাজধানী হাভানাসহ ১৪টি শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসল?

খ।এ সঙ্কটে নতুন মাত্রা যোগ করে গেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কিউবার উপর বহু ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন। এর একটি হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কিউবানদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠাবার পথ বন্ধ করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিউবানরা বছরে গড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। কিউবার ৬০ শতাংশ পরিবার এ রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এ বছর যুক্তরাষ্ট থেকে রেমিট্যান্স কিউবাতে যেতে পারেনি।সাথে যোগ হয়েছে কোভিড মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ।

গ।কোভিড সঙ্কট সমস্যা তৈরি করেছে পর্যটন শিল্পে। বিদেশী পর্যটক না আসবার ফলে দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে ১১ শতাংশ।  উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা পর্যটন খাত সহ আরো কিছু খাত উন্মুক্ত করে ফরেন কারেন্সি সংগ্রহ করবার জন্য। কেননা, ফরেন কারেন্সি না থাকলে তার পক্ষে খাদ্য সহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী করা সম্ভব নয়।

ঘ।ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার ফলে একদিকে রেমিট্যান্স বন্ধ হয়ে যাওয়া; অপরদিকে, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশী পর্যটক না আসবার ফলে কিউবা চরম কারেন্সি সঙ্কটে পড়েছে। এ সঙ্কটের ফলে তার পক্ষে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানী করা সম্ভব হয়নি, যেটি আজকের  সঙ্কটের মূল কারণ।খাদ্য সমস্যার পাশাপাশি ওষুধ, জ্বালানী তেল এবং বিদ্যুতের ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এর   সবকিছই জনমানসে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করেছে।

ঙ। আমেরিকা প্রবাসী কিউবানরা যাদের বেশির ভাগ মায়ামি থাকেন, তাঁরা মার্কিন সরকারের সহায়তায় নানাভাবে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয়। পাশাপাশি কাস্ত্রোকে বহুবার হত্যা প্রচেষ্টাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চেষ্টা করে এসেছে ঘরের পাশ থেকে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করবার।

দেখুন ড. আহমেদ উপরের ক থেকে ঙ পর্যন্ত লেখা গুলো তাঁর লেখাতেই লিখেছেন। তাঁর এই বস্তুনিষ্ঠ লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। কিউবার উপর আর কি নতুন করে লেখার কিছু  আছে? তিনি কিউবার সমস্যার মূল কারণ গুলো ( ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞায় কিউবায় রেমিটেন্স পাঠাতে না পারা, কিউবানরা  বছরে গড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। কিউবার ৬০ শতাংশ পরিবার এ রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল, করোনার কারণে পর্যটক না আসা,খাদ্য, ওষুধ, তেল,বিদ্যুতের সঙ্কট ইত্যাদি) লেখার পর আশ্চর্য্য হচ্ছি যে এসব সমস্যা ঘটিয়েছে যে মার্কিন শাসকরা, তিনি তাদেরকে একবারও দোষারোপ করেন নি। উল্টো তিনি তাদের পক্ষ নিয়ে কিউবার বিরুদ্ধ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের ও কিউবার রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লিখছেন কেন? তিনি নিজেই শুরুতে লিখেছেন “নানাবিধ মার্কিন এবং পশ্চিমা চাপের মাঝে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে দেশটিতে (কিউবায়) এখন পর্যন্ত মোটামুটি জনসমর্থন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় টিকে আছে” ।  এরপর তিনি কীভাবে,কোন মুখে বলছেন আমেরিকা বা পূঁজিবাদি দেশগুলো ভিন্নমত এবং চিন্তার বৈচিত্র্যতা প্রকাশের পথ তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধারণ করতে পারে আর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো তা করতে পারে না। ছোট্ট,দুর্বল ও গরিব কিউবার কমিউনিষ্ট সরকারকে উৎখাতের জন্য,কিউবার নেতা কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য চেষ্টা করেছে শতবারের বেশি। তখন তিনি কী করে তাদের সমালোচনা না করে কিউবার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলোর সমালোচনা করেন? যেখানে তিনি নিজেই লিখেছেন “আমেরিকা প্রবাসী কিউবানরা যাদের বেশির ভাগ মায়ামি থাকেন,তাঁরা মার্কিন সরকারের সহায়তায় নানাভাবে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয়। পাশাপাশি কাস্ত্রোকে বহুবার হত্যা প্রচেষ্টাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চেষ্টা করে এসেছে ঘরের পাশ থেকে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করবার জন্য”  সেটা লিখার পর তিনি কি চাচ্ছেন  এসব লোকদের কিউবার সরকার তাদের কিউবার ভেতরে ভিন্নমতের লোকদের ডেকে এনে রাজনীতি সহ সব অধিকার দিক  অর্থাৎ এসব মার্কিন রাজাকার আলবদরদের, সাম্রাজ্যবাদিদের পোষা এজেন্টদের কমিউনিষ্ট সরকারকে উৎখাতের পূর্ণ সুযোগ দেয়া হোক ?(আর বাংলাদেশেও স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার বন্ধ করে তাদের পুনর্বাসন করা হোক ?) ড আহমেদ আসলে কোন চিন্তার আর আদর্শের লোক? কী চাচ্ছেন আপনি? বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে নৈরাজ্যবাদিরা কি এভাবেই তাদের  কাজ সূক্ষ্ম ভাবে চালিয়ে যায় ? এ ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ধবংসের পথে নেয়ার ব্রতধারীদের সাথে কি কোন আলোচনা-বিতর্ক চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? নোম চমস্কি বা তারিক আলীদের মতো এনার্কিষ্ট হলে তিনি তাঁর পথে থাকুন, আমরা তাঁর সাথে কোন বিতর্কে জড়িত হতে আগ্রহি নই। শুধু এটুকুই  বলবো,  সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রিত করে কোন লক্ষ বাস্তবায়িত করা যায়না।শুধু কিছু সময়ের জন্য কিছু তরুনকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বিপ্লবি পার্টি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। তিনি নিজের দু’টি লেখা আবার ঠান্ডা মাথায়,নিরপেক্ষ মন নিয়ে পড়লেই তা  আশা করি বুঝতে পারবেন।

খোরশেদুল ইসলাম-লেখক, সভাপতি প্রগ্রেসিভ ফোরাম, ইউ, এস,এ।

এ প্রসঙ্গে আরও পড়ুনঃ

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ এর “কিউবার কমিউনিস্ট শাসন কি অবসানের পথে?

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ এর “কিউবার কমিউনিস্ট শাসন কি অবসানের পথে ?” লেখাটির বিষয়ে খোরশেদুল ইসলামের প্রতিক্রিয়ায় লেখকের বক্তব্য

খোরশেদুল ইসলামের কিউবার কমিউনিস্ট শাসন কি অবসানের পথে ?” লেখাটি সম্পর্কে কিছু কথা