মতামত

কিউবার কমিউনিস্ট শাসন কি অবসানের পথে? 

-সাঈদ ইফতেখার আহমেদ 

সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকে “সমাজতন্ত্র” যখন বিদায় নিল, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিল, আমেরিকার ঘরের পাশে থাকা কিউবার পক্ষে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফিদেল কাস্ত্রো এবং তাঁর সরকারকেও হয়ত অচিরেই বিদায় নিতে হবে।

 নানাবিধ মার্কিন এবং পশ্চিমা চাপের মাঝে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যে দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোটামুটি জনসমর্থন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় টিকে আছে, সে দেশটিতে হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, রাজধানী হাভানাসহ ১৪টি শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসল?

সোভিয়েত আমলে কিউবার অর্থনীতি নির্ভরশীল ছিল সোভিয়েত সাবসিডি এবং সাহায্যের উপর। ফলে, সোভিয়েত পতনের পর দেশটি নিমজ্জিত হয় কঠিন অর্থনৈতিক সঙ্কটে।

এ সঙ্কটে নতুন মাত্রা যোগ করে গেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কিউবার উপর বহু ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন। এর একটি হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কিউবানদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠাবার পথ বন্ধ করা।

বর্তমান বাইডেন প্রশাসন কিউবার উপর ট্রাম্পের সমস্ত নিষেধাজ্ঞাই বহাল রেখেছে। তাঁরা মুখে মুখে ট্রাম্প বিরোধিতা করলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে ইরাক, আফগানিস্থান, ইসরায়েলসহ সব জায়গায় কার্যত তাঁর দেখানো পথ ধরেই চলছেন।

 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিউবানরা বছরে গড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। কিউবার ৬০ শতাংশ পরিবার এ রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এ বছর যুক্তরাষ্ট থেকে রেমিট্যান্স কিউবাতে যেতে পারেনি।সাথে যোগ হয়েছে কোভিড মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ।

কোভিড সঙ্কট সমস্যা তৈরি করেছে পর্যটন শিল্পে। বিদেশী পর্যটক না আসবার ফলে দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে ১১ শতাংশ।  উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা পর্যটন খাত সহ আরো কিছু খাত উন্মুক্ত করে ফরেন কারেন্সি সংগ্রহ করবার জন্য। কেননা, ফরেন কারেন্সি না থাকলে তার পক্ষে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানী করা সম্ভব নয়।

ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার ফলে একদিকে রেমিট্যান্স বন্ধ হয়ে যাওয়া; অপরদিকে, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশী পর্যটক না আসবার ফলে কিউবা চরম কারেন্সি সঙ্কটে পড়েছে। এ সঙ্কটের ফলে তার পক্ষে খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানী করা সম্ভব হয়নি, যেটি আজকের  সঙ্কটের মূল কারণ।

খাদ্য সমস্যার পাশাপাশি ওষুধ, জ্বালানী তেল এবং বিদ্যুতের ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এর সবকিছই জনমানসে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে বিক্ষোভে পরিণত করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বছরে ২০ মিলিয়ন ডলার ব্যায় করছে। আমেরিকা প্রবাসী কিউবানরা যাদের বেশির ভাগ মায়ামি থাকেন, তাঁরা মার্কিন সরকারের সহায়তায় নানাভাবে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয়। পাশাপাশি কাস্ত্রোকে বহুবার হত্যা প্রচেষ্টাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চেষ্টা করে এসেছে ঘরের পাশ থেকে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করবার।

 এখন প্রশ্ন হল ভারত, আমেরিকাসহ পশ্চিমা নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু কোন সময়েই এতে কেউ আশঙ্কা করে নাই যে, এতে তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়বে। এর বিপরীতে কিউবা, গণচীনসহ সমাজতান্ত্রিক দাবীদার দেশগুলিতে বিক্ষোভ দেখা দিলে, তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বসে পড়বার আশঙ্কা তৈরি হয় কেন?

এর মূল কারণ হল, সমাজতান্ত্রিক দাবীদার দেশগুলি বহু মত এবং পথকে ধারণ করবার মত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। কার্ল মার্কসের “সর্বহারার একনায়কত্বের” ধারণাকে ভিত্তি করে এসব দেশ গড়ে তুলেছে একদলীয় শাসন। কিন্তু মানুষ কখনো একই মত এবং পথের অনুসারী হয় না। কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি ভিন্ন মতকে প্রকাশ করতে না দেয়, মানুষ সেখানে বিদ্রোহ করবেই।

অনেক তাত্ত্বিকই মনে করেন মার্কসের একনায়কত্বের বক্তব্যটি শুধুমাত্র প্যারি কমিউনের বিশেষ প্রেক্ষাপটেই প্রযোজ্য। সার্বিক ভাবে মার্কস কখনো একনায়কত্বের পক্ষে ছিলেন না, বরং সবাই যাতে মুক্ত ভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, এমন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলবার পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন।

প্যারি কমিউনের ক্ষেত্রেও তিনি সর্বহারা বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর একনায়কত্বের কথা বলেছেন, কোন দল বা ব্যক্তির একনায়কত্বের কথা বলেননি। শ্রেণীর এবং দলের একনায়কত্ব এক বিষয় নয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ দুনিয়ার কোন দলই শুধুমাত্র একটি শ্রেণী থেকে আগত লোকজন নিয়ে গড়ে উঠে না।

  বাস্তব ক্ষেত্রে সামজতান্ত্রিক দাবীদার দেশগুলিতে সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের দাবী করে প্রথমে দল এবং পরে ব্যক্তির একনায়কত্ব কায়েম হয়েছিল। কিউবাও এর ব্যতিক্রম নয়। কাস্ত্রো এবং গুয়েভারার নেতৃত্বে যখন গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে একনায়ক ফ্যাসিস্ট, বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করা হয়, তখন তাঁরা কেউ কমিউনিস্ট ছিলেন না।

এ গেরিলা যুদ্ধের সময় কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদেরকে সমর্থন করেনি। হাভানা নিয়ন্ত্রণে আসার পর কাস্ত্রো আমেরিকার সমর্থন চান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। কিন্তু মার্কিন মিত্র বাতিস্তার উৎখাতকে আমেরিকা ভালো চোখে দেখেনি। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রো সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এতে বাধ্য হয়ে তিনি সোভিয়েত সমর্থন চান।

সোভিয়েত ইউনিয়ন কাস্ত্রোকে সমর্থন করে কিন্তু একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে একীভূত হবার কথা বলে। সোভিয়েত দেখানো পথে তিনি শুধু পার্টির সাথেই একীভূত হননি ক্রমান্বয়ে সোভিয়েত নেতাদের মত একনায়কেও পরিণত হয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার কি কোন উন্নয়ন হয়নি? কমিউনিস্ট শাসনে কিউবাতে মানব উন্নয়ন, বিশেষতঃ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নশীল দুনিয়ার রোল মডেলে কিউবা পরিণত হয়েছে কাস্ত্রোর হাত ধরেই।

 কিন্তু একই সাথে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, একনায়ক এবং রাজতান্ত্রিক শাসকদের হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরো কিছু দেশে ব্যাপক অবকাঠামগত এবং মানব উন্নয়ন ঘটেছে।তবে যেটা ঘটেনি সেটা হল, অবাধ বাক এবং ব্যক্তি স্বধীনতার নিশ্চিতকরণ–যে স্বপ্নটা মার্কস দেখেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীতে বসে।

বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সবার অবাধ বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের মার্কস কল্পিত পথে না হেঁটে বিপ্লব পরবর্তী কিউবা হেঁটেছে কম বেশী বাতিস্তাসহ অন্য স্বৈরশাসকদের দেখান পথে। ফলে সেখানে বিরোধী মত এবং পথের অনুসারীদের শিকার হতে হয় নানা দমন-পীড়নের।

এ কারণে এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপ্লব পরবর্তী কিউবা থেকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ নৌকা যোগে দেশ ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছে ৯০ মাইল দূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ কিউবানরা আজকে ফ্লোরিডার রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ফ্যাক্টর। তাঁদের সমর্থণ ছাড়া কোন দলের পক্ষে সেখানে নির্বাচনে জিতে আসা কঠিন। আমেরিকাতে বসে মার্কিন সমর্থনে প্রতিনিয়ত তাঁরা চেষ্টা করে আসছে, কিউবার বর্তমান শাসন ব্যবস্থার অবসানের।

দেখা গেছে, যে সমস্ত রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে তার কোনটিতেই অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ, সামরিক অভ্যুত্থান বা বহিস্থ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান যায়নি। ফলে, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের যে সমস্ত রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সেখানে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন যেমন ঘটেনি, তেমনি ক্যু বা বহিস্থ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেও সরকার পরিবর্তন হয়নি।

 ইতালির মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনি গ্রামসীর মতে একটি রাষ্ট্র কাঠামোয় একটি মত যখন হেজিমনিক বা প্রাধান্যশীল হয়ে উঠে তখন তার বিপরীতে আরেকটি মতের জন্ম হয়, সে মতটিকে চ্যালেঞ্জ করে। একে তিনি কাউন্টার হেজেমনি বলেছেন। বস্তুত এর মধ্য দিয়েই সমাজের বিকাশ সাধিত হয়। এখন যে রাষ্ট্র কাঠামো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে এ বিপরীত মতকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে ধারণ করতে পারে না, সেটি এক সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।

রুশ বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৪৫ সালে জর্জ ওরয়েল লিখেছিলেন রাজনৈতিক স্যাটায়ার ধর্মী উপন্যাস Animal Farm। তিনি সেখানে সোভিয়েত ব্যবস্থায় মানুষকে খোঁয়াড়ের পশুতে রূপান্তরের সাথে তুলনা করেছেন।

 বস্তুত পশুর সাথে মানুষের পার্থক্যের জায়গাটা এখানেই। তাঁকে যত উন্নত জীবনের নিশ্চয়তাই দেওয়া হোক না কেন, মানুষ কোন খামার বা বন্দিশালায় বাস করতে চায়না। আবার সব মানুষ একই ভাবে ভাবতে বা চিন্তা করতেও চায় না। মানুষের চিন্তাভাবনার মাঝে রয়েছে বৈচিত্র্যতা এবং ভিন্নতা। দেখা গেছে যে রাষ্ট্র যত বেশী চিন্তার বৈচিত্র্যতা এবং ভিন্নতাকে ধারণ করতে পারে, সে রাষ্ট্র তত বেশী শক্তিশালী।

কিউবার বর্তমান বিক্ষোভে হয়ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে না। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দাবীদার রাষ্ট্রগুলি যদি ভিন্নমত এবং চিন্তার বৈচিত্র্যতা প্রকাশের পথ তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়  ধারণ  করতে না পারে, তাহলে আজ হোক আর কাল হোক কিউবাসহ, গণচীন, ভিয়েতনাম এ সমস্ত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

______________________

ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ, শিক্ষক, স্কুল অফ সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিস, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, পশ্চিম ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।