বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৫): গবেষণা ও নকল

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

 

আজকাল প্রায়ই নকল বা প্লাগিয়ারিজম বলে একটা কথা শোনা যায়। এর অর্থ হচ্ছে অন্যের গবেষণার কাজ নিজের নামে চালিয়ে দেয়া। এ ধরণের পরিস্থিতি যে হতে পারে সেটা প্রথম জানি নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে পিএইচডি করার সময়। সে সময় আমাদের ডিপার্টমেন্টে এক ছেলে পড়াশুনা করত, কাজ করত রিলেটিভিটির উপর। বেশ মেধাবী ছিল। আমাদের দুই বা তিন বছরের জুনিয়র ছিল ও। সে সময় রাশিয়া থেকে প্রচুর শিক্ষক বিভিন্ন দেশে সাময়িক বা দীর্ঘ মেয়াদী চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যান। এদের একজন ছিলেন ভ্লাদিমির মানকো। ও আমাদের কয়েক বছরের সিনিওর। পিএইচডি শেষ করে স্পেনে বেশ কয়েক বছর কাজ করে মস্কো ফেরে। আমি যে ছেলের কথা বলছি সে আর মানকোর সুপারভাইজার ছিলেন একই ব্যক্তি। সে সময় নেটে একটু একটু করে গবেষণার কাজ প্রকাশ পাচ্ছে। তবে আমরা তখনও নেটের সাথে তেমন পরিচিত নই। একদিন শুনলাম সেই ছেলে মানকোর বেশ কিছু কাজ নেট থেকে নামিয়ে প্রায় অপরিবর্তিত ভাবে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে অনেক হৈচৈ। শেষ পর্যন্ত ওকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর এ নিয়ে তেমন কথা আর শোনা যায়নি।

দেশে থাকতে নকল বলতে বুঝতাম পরীক্ষার সময় কারো খাতা দেখে লেখা বা আগে থেকে উত্তর লিখে নিয়ে গিয়ে সেটা থেকে পরীক্ষার খাতায় টোকা। এ বিষয়ে সেদিন ফেসবুকে বেশ সুন্দর এক স্ট্যাটাস দেখলাম। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা, যারা সাথে করে টুকে আনে তাদেরটা নকল আর যারা মুখস্ত করে হুবহু লেখে তাদেরটা নকল নয়। আগে কখনোই এভাবে ভেবে দেখিনি।

নতুন করে নকল বা প্লাগিয়াটের মুখোমুখি হলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে গিয়ে। ২০১৮। আমার কাছে বিএসসি ডিপ্লোমা লিখছে দুই বা তিন জন ছাত্রছাত্রী। একদিন বলল ওদের এখন প্লাগিয়াট টেস্ট করাতে হবে। আমি তো অবাক। পরে বুঝলাম ওরা যে থিসিস লিখেছে সেটা মেশিনে চেক করতে হবে দেখার জন্য যে কতটা ওরা নিজেরা লিখেছে, কতটা টুকেছে। মজার ব্যাপার হল আমাকে যখন ওরা থিসিস দেখিয়েছে আমি দেখেছি সেসব ঠিক আছে কিনা। তাছাড়া বাক্য বাক্য ধরে তো দেখা সম্ভব নয় যে সে সেটা নিজে লিখেছে, নাকি টুকেছে। দু’জন প্রথম চেষ্টাতেই পার পেয়ে গেল, একজনকে মনে হয় আবার নতুন করে লিখতে হয়েছিল। এরপর এসব ধীরে ধীরে রিসার্চ পেপারে চলে এলো। যারা একই বিষয়ের উপর দীর্ঘদিন কাজ করে যান, তারা মূলত কাজে সামান্য পরিবর্তন এনে দেখেন এর ফলে কি ধরণের পরিবর্তন আসে। সহজে বোঝানোর জন্য ছবির উদাহরণ দেয়া যায়। ধরুন আপনি কারো ছবি তুলছেন। আলোটা একটু এদিক সেদিক সরিয়ে আপনি বিভিন্ন রকমের ছবি পেতে পারেন। একই ফটোগ্রাফার, একই মডেল, কিন্তু আলো এদিক সেদিক ঘুরিয়ে, নিজে ঘুরে বা যার ছবি তুলছেন তাকে বিভিন্ন ভাবে পোজ দিতে বলে আপনি বিভিন্ন রকমের ছবি পেতে পারেন। একই ভাবে আপনি রান্নার সময় মশলার পরিমাণ এদিক সেদিক করে বিভিন্ন ধরণের স্বাদ পেতে পারেন। বা ধরুন পোশাকের ক্ষেত্রে। প্যান্ট প্যান্টই থাকবে, কিন্তু কাটিং এদিক সেদিক করে বিভিন্ন ফ্যাশন করতে পারেন। অর্থাৎ নতুন কোন ফলের জন্য সব সময়ই যুগান্তকারী পরিবর্তন দরকার নেই। তাছাড়া সেটা কেউ করে না। সবাই যাকে বলে স্টেপ বাই স্টেপ লক্ষ্যে পৌঁছে, লাফিয়ে চলে খুব কম লোক, তাও কালেভদ্রে। গবেষণার ক্ষেত্রেও তাই। যাহোক ইদানিং কালে কোন  পেপার সাবমিট করার সময় আপনাকে এসব বিষয় ঘোষণা করতে হয়। এমনকি নিজের আগের কাজের ৩০% এর বেশি যেন নতুন কাজে না থাকে সেটাও খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু কীভাবে আপনি এই ৩০% গননা করবেন? আমার সাথে এক মজার ব্যাপার ঘটলো গতবছর। আমি একটা নতুন কাজ একটা পত্রিকায় সাবমিট করি। এরপর অন্য এক পত্রিকা থেকে আমার কাছে বিশেষ সংখ্যার জন্য একটা লেখা চাইল। আমি ছোট একটা রিভিউ লেখার প্রস্তাব দিলাম আগের কয়েকটি কাজের উপর। সে সময় সবেমাত্র সাবমিট করা পেপারটির ডিটেইলস না দিয়ে তার কিছু কিছু ফল এই রিভিউয়ে ব্যবহার করি। ইতিমধ্যে আমার আগের কাজটা ফেরত দেয় এই বলে যে সেই পত্রিকার জন্য লেখাটি সুইটেবল নয়। সেই সাথে ওরা আরও কয়েকটা পত্রিকার নাম দেয় যেখানে এই কাজটি সুইটেবল হবে। তাই নতুন পত্রিকায় কাজটি সাবমিট করার সময় আমি উল্লেখ করলাম যে এর কিছু অংশ আরেকটি পত্রিকায় রিভিউ হিসেবে গেছে। ইতিমধ্যে সেই রিভিউ গৃহীত হল। যখন প্রুফ এলো, দেখি সেটা লাল কালি গিয়ে দাগানো। কী ব্যাপার। না, কাজ নিয়ে সমস্যা নেই, তবে প্রেজেন্টেশন নিয়ে আছে। লাইনে লাইনে বলা আছে এই বাক্য এই পেপার থেকে নেয়া, ঐ বাক্য ঐ পেপার থেকে নেয়া। আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম। পদার্থবিদ্যা সাহিত্য নয়, সেটা সাধারণত কোন কিছুর স্টেটমেন্ট। নিউটনের তত্ত্ব বা ঐ জাতীয় কিছু অন্যভাবে লেখার চেষ্টা করা কতখানি সুস্থতার পরিচয় সেটা ভাবনার বিষয়। তাছাড়া আমরা সব সময়ই চেষ্টা করি নিজেদের কাজের ফলাফল যতদূর সম্ভব পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরার জন্য। এর ছাড়া আছে প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব স্টাইল। এটা ঠিক, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব অনুযায়ী একটি কণা এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দু পর্যন্ত হাজার হাজার পথে যেতে পারে। সেই ভাবে একজন চাইলে ঢাকা থেকে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ঘুরেও চট্টগ্রাম যেতে পারে। মানে এখানেও হাজারটা পথ আছে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের চয়েজ সীমিত। হাতে গোনা কয়েকটি পথের একটাই আমরা বেছে নেই। আমি যখন এডিটোরিয়াল বোর্ডে এ ব্যাপারে জানতে চাইলাম, ওরা বলল কিছু শব্দ এদিক ওদিক করে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মানে কম্পিউটারকে ফাঁকি দিতে হবে। আমি বললাম, দেখুন তাতে অনেক ক্ষেত্রেই একবারে ভিন্ন অর্থ দাঁড়াবে কারণ সব শব্দ কম্যুটেটিভ নয়। পরে অবশ্য ওরা আর এ নিয়ে কথা বাড়ায়নি, লেখাটা সেভাবেই ছেপেছে। এখানে এটা বলার অর্থ একটাই, আমরা সব কিছু যান্ত্রিকভাবে করে যাই। কম্পিউটারের মেমরিতে একবার কিছু ঢুকে গেলে সেটা সেখানে থেকে যায়। মানুষ সব মনে রাখে না, রাখতে পারে না। এমনও হতে পারে এসব পেপারের অনেকগুলো আপনি পড়েননি। কিন্তু কম্পিউটার ঠিকই আপনাকে চোর বানাচ্ছে। আচ্ছা কম্পিউটার কি ক্রিয়েটিভ? সে কিন্তু প্লাগিয়াট চেক করছে তার মেমরিতে ঢুকিয়ে দেয়া পুরানো কাজের ভিত্তিতে। তবে এখানেই যদি এই গল্পের শেষ হত, তাহলে বলার কিছু ছিল না। যে অরিজিনাল কাজটি আমি প্রায় চার মাস আগে অন্য এক পত্রিকায় দিয়েছিলাম, সেটার রিভিউ এলো। রেজাল্টের অনেকটাই ইতিমধ্যে প্রকাশিত তাই আমরা প্রকাশ করতে পারব না। কিন্তু প্রশ্ন হল আমি যেখানে সাবমিট করার সময় সেটা বলেছি তারপরেও এতদিন বসে থাকার কী দরকার ছিল? এমনকি আমাকে প্লাগিয়াটের অভিযোগে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করল তারা। এর মানে হল আজকাল গবেষককে কোন পত্রিকায় নিজের কাজ সাবমিট করার আগে দশবার ভাবতে হয় সে আবার নকল করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবে কিনা। এর আগের এক পর্বে ডাইরাক আর ফারমির লেখার বিষয়ে বলেছিলাম। আগে অনেকেই স্বাধীন ভাবে একই ধরণের ফলাফল পেয়ে সেসব প্রকাশ করতেন। রেডিও আবিষ্কার তার বড় উদাহরণ। এখনও অনেক লোকজন একই ধরণের কাজ করে অন্যদের কাজ না জেনেই। কারণ সবাই কমবেশি একই ধরণের সমস্যা নিয়ে কাজ করে। যেমন কসমোলজিতে অনেকেই কাজ করে ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটারের উপর। তাইওনেকেই একই সাথে প্রায় একই ধরণের সিদ্ধান্তে আসতে পারে। তবে এখন যেহেতু প্রায় সব তথ্যই অনলাইনে চলে আসে, তাই এমনকি আপনি যদি অন্যের কাজ সম্পর্কে অবহিত নাও হন, কেউ এই অভিযোগ করতেই পারে আপনি ইচ্ছে করেই কারো গবেষণার ফলাফল চুরি করেছেন তাকে কোন ক্রেডিট না দিয়ে। এমন যে হয় না তা নয়। গল্পের শুরুতেই তার এক উদাহরণ দিয়েছি। ফেসবুকে বিভিন্ন সময় অনেক শিক্ষকের নাম এসেছে যারা এ ধরণের কাজ করেছেন। আসলে এ ধরণের কন্ট্রোল থাকা একান্তই প্রয়োজন, আর সেটা দরকার গবেষকদের স্বার্থেই। কিন্তু সেটা যদি যান্ত্রিক ভাবে করা হয় তখনই সমস্যা। বিশেষ করে গাণিতিক বিষয়ে না হয়ে সেটা যদি হয় ভাষা মানে প্রেজেন্টেশন নিয়ে। কারণ পদার্থবিদ্যার ভাষা ইংরেজি বা অন্য কিছু নয়, এর ভাষা গণিত। সোভিয়েত আমলে যখন ছুটিতে দেশে বেড়াতে গেছি কেউ কেউ বলেছেন রাশিয়ায় নাকি সবাইকে সমান করা হয়। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেখানে সমান নয়, সেখানে সব মানুষ কীভাবে সমান হবে। অনেকেই সেটাকে আক্ষরিক অর্থে নিয়েছেন, ভেবেছেন বিশেষ ব্যবস্থায় মানুষের দৈহিক আকার সমান করে। আমি হেসেছি। পরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যখন দেখলাম মেপে মেপে টম্যাটো, শসা এসব বোতল বন্দী করা হচ্ছে তখন বুঝলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন কোথায় ভুল করেছে। অনেক সময় মনে হয় সৃজনশীল মানুষ যন্ত্র আবিষ্কার করে, কিন্তু হনূমানের হাতে খন্তা যাবার মত আমলাদের হাতে এসব যন্ত্র পড়ে মানুষের সৃজনশীলতা খর্ব করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৪):বিজ্ঞান ও রেটিং-বিজন সাহা

এ প্রসঙ্গে অনেক বছর আগের এক গল্প মনে পড়ে গেল। এই শতকের শুরুতে মনে হয়। তখনও ডিজিটাল ক্যামেরা তত জনপ্রিয় হয়নি। তাছাড়া তার দাম ছিল আকাশচুম্বী। এমনি ক্যামেরাতেই ছবি তুলি। বিভিন্ন ফটোসাইট কাজ করতে শুরু করেছে। ছবি প্রিন্ট করে স্ক্যান করে এসব সাইটে আপলোড করি। আমি বরাবরই পছন্দ করি গাছে নীচে দাঁড়িয়ে উপরের ছবি তুলতে। একবার বনে ঘুরতে ঘুরতে এরকম একটা ছবি তুললাম। তখন আমার মনে পড়ছিল তলস্তোয়ের যুদ্ধ ও শান্তির উপন্যাসের কথা যখন যুবরাজ আন্দ্রেই আহত হয়ে বারাদিনোর মাঠে শুয়ে ছিলেন আর তার মাথার উপর আকাশ ঘুরছিল দুরন্ত বেগে। তবে সেই ছবিটা আপলোড করার পর অনেকেই লাইক দিল আর এক মেয়ে মন্তব্য করল এই ছবি অনেক আগেই বলাকারা উড়ে যায় সিনেমায় রিয়ালাইজ করা হয়েছে। সুতরাং এটা নকল। আমি বললাম, দেখ এই যে তুমি লিখছ বা আমি ছবি তুলছি, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি ছবি অনেক আগেই কেউ না কেউ বলেছে, কেউ না কেউ তুলেছে। আমরা অন্যদের নকল করেই হাঁটতে শিখি, কথা বলতে শিখি। অতীত থেকে মানে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া – সেটাও নকল। প্রশ্নটা নকলে নয়, প্রশ্ন হচ্ছে সেটা করে তুমি নতুন কিছু সৃষ্টি করছ কিনা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো