বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩১): নির্বাচন নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনা

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত ০৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন হল। এ বছর ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা সহ বিশ্বের অনেক দেশেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে এ বছরের নির্বাচনের খাতা খুলল বলা যায়। নির্বাচন হবে কি হবে না বা নির্বাচন পরবর্তী দেশের অবস্থা কেমন হবে এ নিয়ে বিভিন্ন আশংকা ছিল। তবে এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত বলেই মনে হয়।

এবার প্রথম থেকেই নির্বাচন বয়কটের কথা বলে এসেছিল বিএনপি। শেষ পর্যন্ত তারা সে পথেই হেঁটেছে। সেটা দলের বা দেশের জন্য কতটুকু লাভজনক হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশে একটা কথা চালু ছিল – আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জেতে, কিন্তু আওয়ামী লীগ হারলে হারে বাংলাদেশ। কিন্তু এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলেও বাংলাদেশ যে হারেনি সেটা বুকে হাত দিয়ে বলা যাবে না। আর যদি এখনও না হেরে থাকে তাকে হারানোর জন্য সার্বিক চেষ্টা যে করা হবে তাতে সন্দেহ নেই। আসলে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে তাদের পালের গোদা আমেরিকা নাখোশ। রাশিয়া প্রশ্নে অর্ধশতাধিক উন্নত দেশকে আমেরিকা যেখানে মাদ্রাসা ছাত্রদের মত ওঠবস করাতে সমর্থ হয়েছে সেখানে বাংলাদেশের মত একটা দেশ নিজের স্বার্থ অনুযায়ী স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি পালন করবে সেটা আমেরিকার সহ্য হবে কেন? তাই পিটার হাস সহ মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছে এখানে আগুন লাগাতে। তবে এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি বলেই মনে হয়। আর বিরোধী দল জানগনের শক্তির উপর আস্থা হারিয়ে আমেরিকার মুখ পানে চেয়ে আছে। কোন কোন দল, বিশেষ করে বাম দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিহীন নির্বাচনের অজুহাতে নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছে। এক সময় এরাই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন দু’হাত তুলে সমর্থন করত। সে সময়ে যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলক নির্বাচনের কথা বলত এরা তার বিরোধিতা করত। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হলে কি হয় সেটা আমরা দেখেছি সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনে। আবার অন্ধভাবে গণতন্ত্র চাইলে কি হয় সেটা দেখেছি নব্বুইয়ের দশকের রাশিয়ায়। মানুষ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে পায় আমেরিকান গণতন্ত্র যার মূল কথা নিজ দেশের নয় আমেরিকার মানুষের (এলিট শ্রেণীর) স্বার্থে কাজ করা। আজ দেশের নির্বাচনে দু’ পক্ষই মনে হয় আমেরিকার জনগণের জন্য কাজ করছে – কেউ কম কেউ বেশি। আর রাজনৈতিক ভাবে সেদিনের সোভিয়েত সমর্থকরা উল্টো পথে হাঁটছে। যেকোন রাজনৈতিক দল ভোট বর্জনের আহ্বান জানাতেই পারে। তবে সেটা যদি দেশীয় রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত শক্তিশালী করে তবে এই খেলা বাম দলগুলোর জন্য কতটুকু আদর্শিক সেটা ভাবার বিষয়। তাছাড়া ভোট বয়কটকে কেন্দ্র করে যদি ট্রেনে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয় তবে এক্ষেত্রে যদি বাম দলগুলো দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নেয় তখন সেটা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি প্রশ্ন করার সুযোগ করে দেয়। ভোট বয়কটের চেয়েও ট্রেন-বাস পুড়িয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া আজ যেকোন দেশপ্রেমিক মানুষ ও দলের জন্য বেশি জরুরি।

এবার নির্বাচনের একটি বৈশিষ্ট্য হল আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করায় আওয়ামী লীগের যে সমস্ত মনোনয়ন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পায়নি তারা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। এদের অনেকেই অন্য প্রতীক নিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। শুধু তাই নয় এদের কাছে হেরে আওয়ামী লীগের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অর্ধেক ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। হেরে গেছে আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা বিভিন্ন পারমাণবিক দলের জাঁদরেল সব রথী মহারথীরা। তাই এখন এদের ভাবতে হবে পরের ধনে আর কত দিন? সময় এসেছে নিজেদের জনসমর্থন তৈরি করার, নিজেদের শক্তিতে নির্বাচিত হবার। তবে শুধু তারা নয় আওয়ামী লীগ নিজেও এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে পারে। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ানো, তাদের হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাংসদ হওয়া – সেটা দলীয় হাই কম্যান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না হলেও অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। আর এই সমস্যা সমাধানের একটাই উপায় – দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করা। একই কথা বলা যায় সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই। কেউই নিজ দলে গণতন্ত্রের চর্চা করে না অথচ গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিতে (উল্টা জীবন নিতে) প্রস্তুত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুবিধাবাদী দলের অভাব নেই। তবে ইদানিং কালে কিছু দলের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় এরা সে রকম নয়, এরা অসুবীধাবাদী দল। এরা সরকারের সাথে আঁতাত করে না বিধায় সুবিধাবাদীর কাতারে পড়ে না। তারা আসলে কারও সাথেই আঁতাত করে না, কিন্তু তাদের সব কর্মকাণ্ডের ফসল যায় আদর্শগত শত্রুর গুদামে। ফলে এরা শুধু নিজেদের জন্য নয় দেশের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করে।

কথিত আছে যে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার এক ইংরেজের কাছে কোন এক কাজে গেলে তিনি টেবিলের উপর পা তুলে বিদ্যাসাগরকে সম্বর্ধনা জানান। পরবর্তীতে সেই সাহেব বিদ্যাসাগরের কাছে এলে তিনিও একই ভাবে সাহেবকে সম্বর্ধনা জানান। এটা সাহেবের পছন্দ হয়নি। ওরা চায় না ওরা যা করে আমরা তাই করি কারণ এটা করতে পারে স্বাধীন মানুষ। ওরা চায় ওরা যা বলে আমরা তাই করি, ওদের অধীনস্থ থাকি। আমেরিকা এখনও ২০২১ সালের জানুয়ারির ঘটনার জন্য অনেককে গ্রেফতার করছে যদিও সেই ঘটনার অনেক কিছুই এখনও অস্পষ্ট। অন্যদিকে আমাদের দেশে যখন এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাড়ি পোড়ানো হয়, ট্রেনে আগুন দেয়া হয়, নির্বাচনের আগে ও পরে মানুষ হত্যা করা হয় তখন এই আমেরিকাই এটাকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে শোরগোল তোলে, ভয় দেখায়। শুধু কি তাই? তারা মানবাধিকারের নামে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চায়। আবার গাজার শিশুহত্যার বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। স্বাধীনতা – অন্যের দয়া নয়, নিজেদের মত করে চলার অধিকার – নিজের ও জাতি ধর্ম বর্ণ ও রাজনৈতিক আদর্শ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের। আমরা স্বাধীনতা বলতে প্রায়ই নিজের অধিকারের কথা বুঝি, অন্যের অধিকার রক্ষায় মোটেও সচেষ্ট হই না। সারা বিশ্বেই তাই। তবে উন্নত বিশ্বে চক্ষু লজ্জার খাতিরে হলেও সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা অন্ততঃ সংবিধানে লেখা আছে। আমাদের সেটাও নেই। আমরা হিন্দু মুসলমান প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। অথচ ধনী গরীবের দ্বন্দ্ব অনেক বেশি মৌলিক। বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তত সেটা বলা আছে। আমরা দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করি আবার পরে একে অন্যকে দোষারোপ করি। দেশ আমাদের। সমস্যাও আমাদের। সেটা আমাদেরই সমাধান করতে হবে সব নাগরিকের সমান অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে। আমেরিকা, চীন, ভারত সমাধান নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তারা সমস্যা। বলতে পারেন আমাদের সংবিধানে তো সবার সমান অধিকারের কথা বলা আছে। এর অর্থ বর্তমান সংবিধান কাজ করছে না, কোন কোন গ্রুপ বেশি সুযোগ পাচ্ছে, নিচ্ছে। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের চেয়ে দলকে বড় মনে করে, দল ও দলীয় কর্মীরা ক্ষমতায় আসতে চায় দেশের সেবা করতে নয়, নিজেদের ভাগ্য বদলাতে। রাজনীতি করা এখন ব্যবসা করার নামান্তর। এই সংস্কৃতি বদলাতে না পারলে ক্ষমতায় দল বদল হবে কিন্তু মানুষের ভাগ্য বদলাবে না।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩২): বিজ্ঞান ও বর্তমান যুগ –বিজন সাহা

সব কিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় দেশে গণতন্ত্র এখন অসুস্থ। রাশিয়ার কোন অঞ্চলে পশুদের মধ্যে সংক্রামক রোগ দেখা দিলে জন স্বাস্থ্য ও পশুদের সুস্থ ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই এলাকার সব পশুদের হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে সরকার ও ফার্মের মালিকরা সমান ভাবে অংশগ্রহণ করে। সরকার অবশ্য কৃষকদের ক্ষতি পূরণ দেয়। বাংলাদেশে সরকারি দল, বিরোধী দল, জনগণ সবাই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে। এবং সরকারি ও বিরোধী দলগুলো সমান উদ্দীপনায় অসুস্থ গণতন্ত্রকে হত্যা করে। দেশের গণতন্ত্র মনে হয় রাশিয়ার পশুদের চেয়েও অধম। তাই এখানে স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন ও সুস্থ পশুতে খামার ভরে গেলেও দেশে গণতন্ত্র প্রাণ ফিরে পায় না।

আমার আবারও মনে হয়েছে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে ভুল করেছে। যেহেতু আমাদের দেশে নির্বাচনে ন্যুনতম উপস্থিতির ব্যাপার নেই তাই এসব বয়কট শুধু বাইরের শক্তির কাছে দেশের সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমাতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবতা হল কোন সরকার অন্য দেশের সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না সেটা নির্ভর করে সেই দেশের সরকারের নিজের স্বার্থের উপর, ভোটের পরিমানের উপর নয়। নিজেদের স্বার্থে পশ্চিমা বিশ্ব স্বৈরাচারী সরকারকেও সমর্থন করে। তাই ভোট বয়কট করে তারা নিজেদের আরও জনবিচ্ছিন্ন করেছে, বিদেশের উপর নিজেদের আরও বেশি নির্ভরশীল করেছে, নিজেদের অন্যের হাতের ক্রীড়নক করেছে। আর সেক্ষেত্রে কি ঘটে সেটা আমরা দেখেছি বিশ্বের দেশে দেশে। এখন নিজেদের সমস্যা সমাধানে পশ্চিমা বিশ্বকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ডাকা হবে একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের অবমাননা।

আজ বাংলাদেশের রাজনীতির মূল কথা হল “তোমার কথা মানি না, খোটা আমার দেখানো জায়গায় গাড়।” কিন্তু সমস্যা হল এটা কী শক্তিশালী, কী দুর্বল সবাই বলছে আর এই বিতর্কে খোটা যেখানেই পোতা হোক না কেন সব পক্ষই নিজেদের বিজয়ী মনে করছে। যে দল জিতছে সে দল স্বাভাবিক ভাবেই নিজেকে বিজয়ী মনে করছে, আর যারা হারছে তারা ভাবছে হয় পশ্চিমা বিশ্ব এই বিজয়কে স্বীকৃতি না দিয়ে তৃতীয় পথ খুঁজবে আর যদি সেটা না হয় জনগণ বিপ্লব করে তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। কিন্তু জনগণ যদি তাদের জন্য বিপ্লবই করবে তাহলে ব্যালট বাক্সে কেন তারা করল না? এতে অর্থ ও রক্ত দুটোরই সাশ্রয় হত।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো