বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩২): বিজ্ঞান ও বর্তমান যুগ

–বিজন সাহা

বেশ কিছুদিন হল প্রগতির যাত্রীতে বিজ্ঞান ভাবনার পাশাপাশি জ্বলদর্চি পত্রিকায় লিখছি ভোলগা ভ্রমণের কাহিনী। সেদিন কাজান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকের সম্মুখীন হলাম। এর বাংলা প্রতি আক্রমণ। তবে সংসদ সমার্থশব্দকোষে শব্দটি না পেয়ে ফোন করলাম এক বন্ধুকে। আসলে বানান নিয়ে সন্দেহ হলে আমি ওদের জিজ্ঞেস করি। শুনে বলল শব্দটি হবে প্রত্যাক্রমণ। প্রতি আক্রমণ – সন্ধির নিয়মে প্রত্যাক্রমণ হওয়াটা স্বাভাবিক। তারপরেও আবার সংসদ সমার্থশব্দকোষে এই শব্দটি খুঁজে না পেয়ে ভাবলাম – কাউন্টার অ্যাটাকের মত এত সুন্দর এক বাংলা শব্দ থাকতে আমি মাথা খুঁড়ে মরছি কেন। তাই ওভাবেই রেখে দিলাম। তবে গল্পটা সেখানে নয়।

আমি যখন আমার বন্ধুকে ধন্যবাদ দিয়ে টেলিফোন রাখব, ও বলল
– লিখিস ভালো কথা। তবে এমন কিছু লিখিস যা কোন কাজে লাগে।
– দেখ, ভোলগা নিয়ে আমার লেখা অনেকটা ভ্রমণ কাহিনী। তবে সেটা যেন অনেকটা গাইডের কাজ করে তাই যেসব শহর ভ্রমণ করেছি তাদের ইতিহাস কিছু লেখার চেষ্টা করছি। কিছুটা বই থেকে নিয়ে, কিছুটা বন্ধুদের মুখে শুনে। আর এটা তো গবেষণাপত্র নয়।
– তা ঠিক। তবে এমন যেন না হয় তুই অযথা সময় নষ্ট করছিস।
আমি কিছু বললাম না। আমার মনে পড়ে গেল আমার দুই কলিগের কথা। মনে হয় আগেও একবার বলেছিলাম। তাদের একজন প্রফেসর আসোস্কভ। ৯৩ বছর বয়স। একদিন বললেন
– বিজন, তুমি যদি ছবি না তুলে সময়টা গবেষণার কাজে দিতে আর এদেশে না থেকে বাইরে কোথাও চলে যেতে অনেক ভালো করতে পারতে। এখন তো আমাদের বিভিন্ন রকম সমস্যা হচ্ছে। কিছু ভাবছ?
– দেখুন, এই মুহূর্তে এ দেশ ছেড়ে চলে যাবার কথা মাথায় আসেনি। এটা এখন আমার দেশ। আমার সংসার এখানে। আমার যা কিছু অর্জন তা এই দেশেই। এই মুহূর্তে আমি সেটা ভাবি কি করে? তাছাড়া আমি ছবি তুলি বা লেখালেখি করি – সেটা তো পদার্থবিদ্যাকে কম্প্রোমাইজ করে নয়, বরং কাজ যাতে ভালো করতে পারি সেজন্যেই। এই যেমন আপনি সাঁতার কাটেন, অনেকে পিয়ানো বা বেহালা বাজায়।
আমি একথা মনে করলেও বন্ধুকে কিছু বললাম না। শুধু বললাম
– দেখ লেখালেখি করলে অনেক পড়তে হয়। অনেক পড়ি। আর লিখতে গেলে ভাবতে হয়, নিজের ভাবনাগুলো মানুষের বোধগম্য করে বলতে হয়, তাই আমি সেটাকে সময় নষ্ট ভাবি না। অন্যদের উপকার হচ্ছে কিনা সেটা জানি না, তবে নিজে যে উপকৃত হচ্ছি তা মানি।
– কিন্তু এই যে ফেসবুকে লিখিস, সেটা কি এদেশের নিয়ম ভাঙ্গা নয়? এদেশে ফেসবুক নিষিদ্ধ। তুই ভিপিএন দিয়ে ফেসবুকে ঢুকিস। এটা কি ঠিক?
– প্রথমত আমাদের নিষেধ করেনি। ভিপিএন ব্যবহার করে ফেসবুকে ঢোকা বেআইনি করেনি। সেটা কিন্তু আমাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের ইনস্টিটিউটে ভিপিএন ছাড়াই ফেসবুক কাজ করে। আজকাল বিজ্ঞানীরা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গবেষণার জন্য।
– সেটা তোর কথা। কিন্তু তুই যেহেতু রাশিয়ার নাগরিক কাজটা মনে হয় ঠিক নয়। আমি যদি রাশিয়ার নাগরিকত্ব নিতাম, এটা করতাম না।
– দেখ, রাশিয়া কিন্তু নিজেকে আইসোলেট করতে চাইছে না। অলিম্পিকে এরা জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা ছাড়া অংশ নিচ্ছে। এই নিয়ে সমাজে বিভিন্ন মত আছে। সরকার কিন্তু নিষেধ করেনি। আমি নিজে, আমরা গবেষকরা বিভিন্ন ধরণের বাধার সম্মুখীন হচ্ছি বাইরে পেপার পাবলিশ করতে গিয়ে। অনেকের কোলাবরেটররা এদের সাথে কাজ করতে অস্বীকার করছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের বলা হচ্ছে বাইরের ভালো পত্রিকায় পেপার পাবলিশ করার জন্য। এর উপর আমাদের প্রমোশন নির্ভর করে। তাই চাইলেই সব কিছু ছেড়ে দেয়া যায় না।
– তা মানলাম। কিন্তু তাই বলে এই ষাট বছর বয়সেও তোকে প্রমাণ করতে হবে যে তোর কাজ গুরুত্বপূর্ণ? তুই যদি ষাট বছরে সেটা প্রমাণ করতে না পারিস, এখনও হবে না।
– দেখ পাবলিকেশন গবেষণার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তুই যত ভালো কাজই করিস না কেন, সেটা যদি পাবলিস না করিস সেই গবেষণা মূল্যহীন। এটা অনেকটা নিজের তৈরি জিনিস বাজারে বিক্রি করার মত। যদি কেউ না কেনে তাহলে যেমন সেই সৃষ্টির মূল্য নেই, তেমনি বিশেষজ্ঞরা যদি গবেষণার মূল্যায়ন না করে তাহলে সেটাও মূল্যহীন। আর তারা কীভাবে মূল্যায়ন করবে যদি না দেখে?
– এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে হল। এক ভারতীয় তরুণ তাঁর একটা কাজ আইনস্টাইনকে পাঠিয়েছিলেন। আইনস্টাইন সেই কাজের মূল্য বুঝে নিজে একটা নোট লিখে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
এই সময় আমার ফোন এলো। লাইন কেটে গেল। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে আমার এই প্রচণ্ড প্রতিভাবান ও প্রতিষ্ঠিত বন্ধু কীভাবে খুব সাধারণ ব্যাপারগুলো মিস করে যায়।
ধরুন আইনস্টাইন কোন কারণে লেখাটি পড়লেন না বা বুঝলেন না। ভাবার কারণ নেই যে আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি যদি লেখাটি প্রকাশ করতে উদ্যোগ না নিতেন তাহলে সেটা চিরকালের জন্যই অজানা থেকে যেত। বর্তমানে বিজ্ঞান সেভাবে কাজ করে না। সব কিছুর মত এটাও এক ধরণের বাজার। এর সাথে জড়িত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। সবাই চায় নিজের কাজটা আগে প্রকাশ করতে। এটা ভালো বা মন্দ কিছু নয়, এটা যুগের দাবি। আমরা জগদীশ চন্দ্র বসুকে রেডিওর আবিষ্কর্তা মনে করি, রুশরা পপোভকে, আমেরিকানদের ধারণা রেডিওর জনক নিকোলা টেসলা আর সারা বিশ্ব মারকোনিকে সেই মর্যাদা দেয়। এক্ষেত্রে পল ডাইরাকের একটা ভালো লেখা আছে। তিনি স্মৃতি কথায় এ বিষয়ে লিখেছেন। এনরিকো ফারমি তাঁকে নিজের একটা লেখা পাঠান মতামত জানতে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় তিনি সেটা ভুলে যান। এর কিছুদিন পরে তিনি নিজে ইন্ডিপেন্ডেন্টলি মানে ফারমির সেই লেখা না পড়ে অনুরূপ সিদ্ধান্তে আসেন এবং সেই গবেষণা প্রকাশ করেন। কিছুদিন পরে ফারমির সাথে দেখা হলে তিনি নিজের গবেষণা সম্পর্কে দাইড়াকের মতামত জানতে চান। তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। জন্ম নেয় ফারমি-ডাইরাক স্ট্যাটিস্টিক্স। ধরা যাক আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর লেখাটা সেভাবে ভুলে গেলেন এবং পরে নিজেই সেটা আবিষ্কার করে প্রকাশ করলেন। সেক্ষেত্রে বোসের নামটা বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স, বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট এসবের ভেতর থাকত কি না এ নিয়ে সন্দেহ আছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাটলে এ ধরণের প্রচুর ঘটনা পাওয়া যায়। এখনও পর্যন্ত বিতর্ক চলছে – কে আপেক্ষিক তত্ত্বের আবিষ্কর্তা – ডেভিড হিলবার্ট নাকি আলবার্ট আইনস্টাইন? অথবা ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা কে – নিউটন নাকি লেইবনিৎস? নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার কে করেন – হুক নাকি নিউটন নিজে, যদিও সেই তত্ত্বের গাণিতিক ভিত্তি দেন নিউটন?

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩১): নির্বাচন নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনা - বিজন সাহা

বিজ্ঞানে একটা কথা প্রচলিত আছে – কোন তত্ত্ব প্রমাণ করা যায় না, সেটা শুধু ভুল প্রমাণ করা যায়।  একটা তত্ত্ব ততক্ষণই সঠিক বা সত্য যতক্ষণ না কেউ সেটা ভুল প্রমাণ করছে। তাই বিজ্ঞানী কোন একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করে সেখানেই থেমে থাকেন না, সেটাকে কীভাবে আরও নিখুঁত করা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যান। কারণ বিজ্ঞান ধর্ম নয়, এখানে শেষ কথা বলে কিছু নেই, আছে একটু একটু করে সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কারণ বিজ্ঞানীর কাজ সত্য সন্ধান করা, প্রকৃতির রহস্য উদ্ধার করা। আজ যেটা সঠিক মনে হচ্ছে নতুন কোন আবিষ্কারের ফলে কাল সেটা ভুল বলে প্রমানিত হতে পারে। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ ডার্ক এনার্জি। প্রতিটি নতুন আবিষ্কার আসলে দীর্ঘ চলার পথে একেকটি ধাপ মাত্র। কোন কোন ধাপে আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, এমনকি বিশ্বাস করতে পারি এটাই শেষ ধাপ। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের নতুন নতুন আজানার সন্ধান দেয়। এসব নিয়ে আমরা বলব পরবর্তী পর্বে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো