বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১২৯): সম্মেলন

–বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

আজ ২৯ ডিসেম্বর। এ বছরের শেষ লেখা। বছর শেষ মানে সারা বছরের কাজকর্মের হিসাব নিকাশ করা। কী পেলাম, কী পেলাম না তার ফর্দ তৈরি করা। তবে যেহেতু পৃথিবীতে সবাই আসে খালি হাতে তাই যা পেয়েছি সেটাই একমাত্র সত্য, আর কী পেলাম না – সেটা শুধু সেই সম্ভাবনা বা সেই স্বপ্ন যা বাস্তবায়িত হয়নি বিভিন্ন কারণে। তাই না পাবার বেদনায় মনকে ভারী না করে কীভাবে আগামী দিনকে আরও বেশি ফলপ্রসূ করা যায় সেটা ভাবাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে যেহেতু আমাদের জীবন সমাজের ভালমন্দের বাইরে নয়, প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার যোগফল অনেকটাই সমাজের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ধারণ করে, তাই নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে কথা বললে মন্দ কী?

এ বছর বেশ কয়েকটি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করি। আর কনাফারেন্স মানেই পুরানো বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ, নতুন বন্ধু খুঁজে পাওয়া। যদিও কাজের মধ্য দিয়ে অনেকের সাথেই আগে আলাপ, তবে কনফারেন্সে সরাসরি দেখা হলে সেটা পোক্ত হয়। এটা অনেকটা ফেসবুক বন্ধুত্বের মত। বছরের পর বছর ধরে ফেসবুকে বন্ধুত্ব থাকার পরে যদি হঠাৎ করেই কারো সাথে মুখোমুখি দেখা হয় তার যে অনুভূতি এখানেও অনেকটা সেরকম। প্রথম দুটি কনফারেন্স ছিল মস্কোয় – একটা গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে, আরেকটা বাউমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর নভেম্বরের শেষে কাজানে আমাদের কনফারেন্স ছিল গ্র্যাভিটি, কসমোলজি ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের উপর।

কনফারেন্সের বাংলা সম্মেলন। সম্মেলন মানেই সমমনাদের একত্রিত হওয়া। সম্মেলন আমাকে মনে করিয়ে দেয় খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন বা বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের অল সোভিয়েত সম্মেলনের কথা। সেসব সম্মেলনে আমরা যেতাম বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। ট্রেনের পুরো এক বগি ভাড়া করে মস্কো থেকে সারা রাত গান গাইতে গাইতে আমরা যেতাম কয়েকটা দিন বাংলাদেশে ফিরে যেতে। তাই তার ছিল এক অন্য রকম আবেদন। কিন্তু সম্মেলন যখন কনফারেন্সের রূপ নিল, মানে যখন বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা পত্র পেশ করার জায়গা হল, তখন সম্মেলন আর আগের মত  রইল না। অন্তত প্রথম দিকে সেটাই মনে হত। কিভাবে নিজের গবেষণা আরও ফলপ্রসূ করা যায় সে বিষয়ে জানতেও কনফারেন্সে অংশ নেই। রুশরা বলে তর্কের মধ্য দিয়েই সত্য জন্ম নেয়। কনফারেন্স মানেই প্রশ্ন উত্তর, নিজের আইডিয়া বলা, অন্যদের আইডিয়া শোনা – যাকে বলে ভাবনার আদান-প্রদান। আজ এ নিয়েই আমাদের গল্প।

মনে পড়ে দুবনায় আমার প্রথম কনফারেন্সগুলোর কথা। সেটা ১৯৯৪, ১৯৯৫ সাল। বিভিন্ন দেশ থেকে বিজ্ঞানীরা আসছেন, অনেকের সাথে আলাপ হচ্ছে। অনেকের সাথে সেই সময়ে গড়ে ওঠা সম্পর্ক এখনও বিদ্যমান। তখন একটা জিনিস খেয়াল করতাম। মানুষ শুধু নিজেদের কাজের কথা বলতেই আসে না, আসে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। বিশেষ করে সেটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর পর। অনেকেই পেটের দায়ে চলে গেছে ইউরোপ, আমেরিকা, ইসরাইল এসব জায়গায়। তবে তারা সুযোগ পেলেই ছুটে আসতেন মাটির টানে। আসতেন অন্যান্য দেশের নামকরা বিজ্ঞানীরাও। তাই এক সময় যখন অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হল, কনফারেন্স শুধু বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম রইলো না, এটা হল বন্ধুদের মিলন মেলা। তাছাড়া বিজ্ঞানের বাইরেও মানুষের একটা জীবন থাকে, সেটা নিয়ে কথা বলা, পুরানো কনফারেন্স গুলোর স্মৃতিচারণ করা। আর দেশ যখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এ নিয়েও বলার অনেক কিছুই থাকে। আমার নিজের কথাই বলি। ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতি বছর একটা অন লাইন প্ল্যাটফর্মে নিজের গবেষণাপত্র আপলোড করি। কখনোই কোন সমস্যা হয়নি। এবার একটা পেপার ঝুলিয়ে দিল। কারণ সার্ভারে প্রচুর পেপার জমা পড়ছে। জানি এটা অজুহাত, তারপরেও। অথবা একটা পেপার সাবমিট করার চার মাস পরে বলল এর কিছু রেজাল্ট আগে প্রকাশিত হয়েছে তাই ওরা প্রকাশ করবে না। অথচ যে পেপারে তা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা এই পেপার সাবমিট করার পরে লেখা। কারণ এক জার্নাল থেকে একটা রিভিউ লেখার অনুরোধ করলে আমি কিছু কিছু রেজাল্ট ব্যবহার করেছিলাম, আর ওদের জানিয়েছিলাম। তাই এটাও এক ধরণের সন্দেহ জাগায় যে ইচ্ছে করে করা হচ্ছে। এরপর আরেকটা জার্নালে পেপার সাবমিট করতে কিছু টেকনিক্যাল প্রবলেম হচ্ছিল। সাহায্য চাইলে বলল, আমি যেহেতু রাশিয়া থেকে আর সে দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে, ওরা সাহায্য করতে পারবে না। কনফারেন্সে বন্ধুদের সাথে আলাপ করে বুঝলাম আমি একা নই। যাদের বিদেশী কোল্যাবরেটর ছিল তাদের অনেকেই যৌথ ভাবে কাজ করবে না জানিয়েছে। এক কথায় ইউক্রেন যুদ্ধ বিজ্ঞানের উপর প্রভাব ফেলেছে, ফেলছে। সাধারণত কাজান কনফারেন্সে অনেক বিদেশী গবেষক আসেন, এবার তাদের কেউই ছিল না নানা অজুহাতে, যদিও কেউ কেউ অনলাইনে রিপোর্ট পেশ করেছে।

সাধারণ মানুষের কাছে সবাই ডাক্তার হলেও যেমন বিভিন্ন প্রোফাইলের ডাক্তার আছে, মানে কেউ ডেন্টিস্ট, কেউ কারডিওলজিস্ট, কেউ আই স্পেশালিষ্ট – আর তাদের সবাই নিজ নিজ ফিল্ডে সম্যক জ্ঞান রাখেন, পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রেও তাই। কোয়ান্টাম ফিজিক্স, গ্র্যাভিটি, সলিড স্টেট ফিজিক্স, প্লাজমা ফিজিক্স – এসব বাদ দিলাম, এমনকি গ্র্যাভিটির মধ্যেও এত ভাগ যে সেখানেও অনেকেই একা একা কাজ করে। সব কিছুর মত বিজ্ঞানেও ফ্যাশনেবল ফিল্ড আছে। যেমন এক সময় সবাই সুপার সিমেট্রি বা সুপার স্ট্রিং নিয়ে কাজ করতে চাইত। আবার একই ভাবে আছে সেসব ফিল্ড যেখানে খুব বেশি লোকজন কাজ করে না। আমি নিজেও কসমোলজির সমস্যা যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি খুব কম লোকই সেভাবে করে। তাই বিভিন্ন বিষয়ে নতুন অনেক কিছু জানলেও নিজের কাজ নিয়ে খুব বেশি মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ থাকে না। দুয়েক জন যারা আছে, তাদের একজন আলেক্সান্দর বালাকিন। ও কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কনফারেন্সের প্রথম দিনই দেখা। অনেক আগেই পরিচয়। আমি যে বিষয়ে কাজ করি সে বিষয়ে তারও কিছু কাজ আছে। ফলে আমরা একে অন্যের কাজ ফলো করি। কয়েকদিন আগে ওর একটি পেপার আমার হাতে এসেছিল রিভিউএর জন্য। আমাকে দেখেই বললেন
– আমি বুঝেছি রিভিউটা আপনি লিখেছেন। তবে আপনি ভাববেন না যে আমি ফর্মালি আপনার কয়েকটা পেপার রেফার করেছি। আপনার রেজাল্ট আমাদের বেশ সাহায্য করেছে।
আসলে আজকাল আমরা নিজের কাজের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে অনেক পেপার রেফার করি যেটা এসব কাজের সাথে পরোক্ষ ভাবে সম্পর্কিত। অনেকেই আবার মাঝেমধ্যে নিজেদের পেপার মেইল করে রেফারেন্স বাড়ানোর জন্য। সেদিক থেকে গবেষণাও আজ আর দশটা পণ্যের মতই। তাই প্রফেসর বালাকিনের কথা শুনে ভালোই লাগল। হয়তোবা তার গবেষণার কিছু কিছু নিজের কাজেও ব্যবহার করা যাবে। অন্ততঃ এবার কনফারেন্স থেকে সেরকম কিছু আইডিয়া নিয়ে ফিরেছি।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩০): প্যাশনারিটি – বিজন সাহা

কথা হল দ্মিত্রি গালৎসভের সাথে। আমার শিক্ষকদের বন্ধু, তাঁদের সমবয়সী প্রায়, ১৯৪২ সালে জন্ম। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। বিভিন্ন কথা বললেন বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত। নামকরা বিজ্ঞানী। প্রচুর কাজ। প্রায়ই বাইরে যেতেন। সমাদর পেতেন পশ্চিমা বিশ্বেও। এখন মনে হয় আগের মত অবস্থা নেই। বললেন
– যা ই বলনা কেন, সোভিয়েত ইউনিয়নেই ভালো ছিল। নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারতাম। বর্তমানে বিশ্ব, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের মতই অনমনীয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ওদের অনমনীয়তা আসলে গোঁড়ামি, গোঁয়ার্তুমি।

সব দেখে মনে হল বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে সবাই উত্তেজিত, সবাই চিন্তিত।

এবার কনফারেন্সে শতাধিক গবেষক অংশগ্রহণ করেন যাদের একটা বিরাট অংশ মাস্টার্স বা পিএইচডি স্টুডেন্ট। এতদিন আমরা শুধু বিদেশী জার্নালে পাব্লিকেশনের কথা বলতাম। এখন দেখছি স্থানীয় জার্নালের প্রতিও গুরুত্ব দিচ্ছে অনেকেই। এক সময় সোভিয়েত জার্নালগুলো বেশ মানসম্পন্ন ছিল, এসব জার্নাল পশ্চিমারা নিজেদের উদ্যোগে অনুবাদ করত, এখনও করে। তবে আমরা বিদেশী জার্নালে পাবলিশ করতেই বেশী আগ্রহী। সেটা শুধু আমরাই নই, ভারসিটির কর্তৃপক্ষও। কারণ ইদানীং জার্নালের বিভিন্ন রেটিং তৈরি হয়েছে, এসবের উপর নির্ভর করে চাকরির প্রোমোশন। তবে অনেকেই বাইরে পাব্লিকেশনের ক্ষেত্রে ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হচ্ছে। হয়তো এটা শাপে বর হবে। কারণ কয়েক বছর আগেও স্থানীয় উদ্যোক্তারা হালে পানি পেত না, বিদেশী কোম্পানি চলে যাবার ফলে এদের শিল্প দাঁড়াচ্ছে এবং সেটা কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করে নয়। আসল কথা হচ্ছে বিপদকে আপনি কীভাবে মোকাবেলা করবেন তার উপর নির্ভর করে আপনার ভবিষ্যৎ।

অনেক অনেক ভালো খবরের মধ্যে খারাপ খবর আসে গত ২১ ডিসেম্বর। আলেক্সেই আলেক্সান্দ্রোভিচ স্তারবিনস্কি মারা যান। তিনি ছিলেন আধুনিক কসমোলজির অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর ও সহপাঠী আন্দ্রেই লিন্দের হাত ধরে আসে ইনফ্ল্যাশন তত্ত্ব, যদিও পশ্চিমে আলান গুথকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ওনার কাজের সাথে পরিচয় ওনাকে দেখার অনেক আগেই। প্রথম দেখি দুবনায় এক সেমিনারে। ওনার রিপোর্ট শোনার জন্য গেছিলাম অন্য এক ল্যাবরেটরিতে। একটু হতাশ হয়েছিলাম। কারণ উনি কথা বলেন একটু তোতলিয়ে, ফলে অনেক কিছুই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। পরে অবশ্য অসুবিধা হয়নি। প্রথম সরাসরি কথা হয় ২০০৭ সালে ইয়ালচিক কনফারেন্সে। আজি যে বিষয় নিয়ে কাজ করি উনি প্রথমে সেটাকে খুব একটা পাত্তা দেননি। কারণ কোয়ান্টাম পারটিকেল আমি ক্ল্যাসিকাল আন্যালজিতে ব্যবহার করছি বলে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে। তবে কখনোই অনুৎসাহিত করেননি। কখনও কখনও অন্য কোন পেপার দেখতে বলেছে যা আমাকে সাহায্য করতে পারে। তবে শেষ কয়েক বছর তিনি আগের মত ক্যাটাগরিক্যাল ছিলেন না। ২০১৯ সালে বললেন

– এখন কসমোলজির উপর অনেক ভালো ভালো তত্ত্ব আছে, তোমারটাও তাদের একটা। তবে এর মধ্য থেকে শুধু একটাই সঠিক।

– প্রশিক্ষকের হাতে একাধিক খেলোয়াড় থাকা অনেক ভালো, কারণ তাতে তিনি বেছে নেবার সুযোগ পান। তাছাড়া একদিন তো মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে। এরপর যদি আবার সে জন্ম নিতে চায় নিশ্চয়ই যে তত্ত্ব তাকে ধ্বংস করেছে সে সে পথে যাবে না, তার এখন অপশন আছে অন্য কিছু বেছে নেবার। – বললাম আমি।

আমরা এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসলাম সেদিন। সেটাও ছিল কাজানে। এবারও দেখা হল কাজানেই। শেষ দেখা ১ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন রাশিয়ান গ্র্যাভিটেশনাল সোসাইটির প্রাণ পুরুষ। শুধু নামকরা বিজ্ঞানী নন, ভালো শিক্ষক। শেষের দিকে মূলত মডিফাইড গ্র্যাভিটি নিয়ে কাজ করতেন। ওনার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি তা হল নিজের থিয়োরির পেছনে লেগে থাকা, সেটা ডেভেলপ করা। অনেক তরুণ তরুণী তাঁর সাথে কাজ করত। তিনি সব সময় তাদের খোঁজ খবর রাখতেন। অন্তত বিভিন্ন কনফারেন্সে তাঁকে দেখে আমার সেটাই মনে হয়েছে। আশা করি না থেকেও তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো