বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩০): প্যাশনারিটি

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

ইতিহাসের প্রতি আমার দুর্বলতা সেই ছোটবেলা থেকেই। তখন থেকেই বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পড়তে পছন্দ করি। এমনকি ইলিয়াড, ওডেসি, রামায়ণ, মহাভারতও অনেকটা ইতিহাস বলে মনে হত। আর ঐতিহাসিক উপন্যাস হলে তো কথাই নেই। এ কারণে জীবনী পড়তেও ভালো লাগে। কারণ এসবই সময়ের সাক্ষী। তবে আগে ইতিহাস পড়ে শুধু অতীতে কোন ঘটনা কীভাবে ঘটেছে সেটা জানার প্রতিই আগ্রহ জাগত। পরে যখন লেভ গুমিলেভের কিছু বই পড়ি তখন থেকে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে তাঁর প্যাসনারি তত্ত্ব। এথনোজেনেসিসের প্যাশনারি তত্ত্ব ব্যবহার করে লেভ গুমিলেভ বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে কোন জাতির উৎপত্তির ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে নির্দিষ্ট ল্যান্ডস্কেপ ও সেখানে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে সেই জাতির মিথস্ক্রিয়া। তাঁর তত্ত্ব এথনোসের ধারণার সংজ্ঞা দেয়, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় আবেগের গুরুত্বের ধারণা প্রবর্তন করে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার বর্ণনা দেয়। এ নিয়ে তাঁর অনেক মৌলিক কাজের পাশাপাশি রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার, বিশেষ করে চেঙ্গিস খান ও তাঁর উত্তরসূরিদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করে। মনে পড়ে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে আমাকে বলেছিল বন্ধু ফিওদর পেনকভ। এটা নব্বুইয়ের দশকের শেষের দিকে। তখনও বিনে পয়সায় বই ডাউনলোড করা যেত না, আমাদের বেতন ছিল যৎসামান্য। তবুও বেশ কয়েকটি বই বুকিং দিয়ে কিনেছিলাম আর মানুষ যেমন গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে সেভাবেই দ্রুত বইগুলো পড়ে শেষ করেছিলাম। এখনও মনে পড়ে তাঁর এথনোজেনেসিস ও পৃথিবীর জীবজগৎ, রুশ থেকে রাশিয়া, প্রাচীন রুশ ও মহান স্টেপ এসব বই পড়ে কী রকম আন্দোলিত হয়েছিলাম। এরপর আমাদের দেশের ইতিহাসের উপর এরকম বিশ্লেষণমূলক বই আছে কিনা সেটা অনেক দিন খুঁজেছি। লেভ গুমিলেভের তত্ত্ব সর্বজন গৃহীত নয়, অনেকেই যেমন তাঁর তত্ত্ব জাতি গঠনের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, অনেকে ঠিক তেমনি ভাবে এই তত্ত্ব বিভিন্ন জাতিগত সমস্যার জন্ম দিতে পারে বলে মনে করে। গুমিলেভের তত্ত্ব প্রচণ্ড সমালোচনার সম্মুখীন হয়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে তিনি ইচ্ছেমত বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা করেছেন। এমনকি তাঁর তত্ত্বকে অবৈজ্ঞানিক বলে অনেকেই আখ্যা দিয়েছে। ট্র্যাডিশনাল বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা থেকে ভিন্ন গুমিলেভের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসবিদ, নৃতাত্ত্বিক ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মাঝে তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। তাঁর তত্ত্ব না সোভিয়েত ইউনিয়ন, না বহির্বিশ্ব – কোথাও তেমন সমর্থন পায়নি। অনেক বিজ্ঞানী প্যাশনারি তত্ত্বকে অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলে মনে করেন। তবে আমার মনে হয় বর্তমানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এই তত্ত্বের আলোকে বিবেচনা করা যেতেই পারে।

তবে এ নিয়ে কথা বলার আগে চলুন প্যাশনারিটি কী সেটা জেনে নেয়া যাক। প্যাশনারিটি হল জীবের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট “জৈব রাসায়নিক শক্তি”র আধিক্য যা উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেকে বা পরিপার্শ্বের লোকজনকে আত্মত্যাগের জন্য উত্তেজিত বা আবেগপ্রবন করে তোলে। প্যাশনারিটি জীবন, পরিবেশ এবং সমাজে বিরাজমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার জন্য এক অপ্রতিরোধ্য আভ্যন্তরীণ বা আত্মিক আকাঙ্ক্ষা। কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্ধারিত কাজ, যেমন বিপ্লব, আবেগ তাড়িত কোন ব্যক্তির কাছে নিজের জীবনের চেয়েও মূল্যবান, সেটা অর্জন করতে সে শুধু নিজেকেই নয় তার সমসাময়িক সমাজ ও সগোত্রীয় সবকিছু উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত। এর সাথে নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। প্যাশনারিটি অবলীলায় বীরত্ব ও অপরাধ, সৃজনশীলতা ও ধ্বংস, ভালো ও মন্দ – সব কিছুরই জন্ম দিতে পারে। এখানে শুধু একটা জিনিসের স্থান নেই – তা হল উদাসীনতা। প্যাশনারিটি কাউকে সাধারণত জননেতা করে না, কারণ এদের বেশির ভাগ অনুসারীরা ভিড়ের বা বলা চলে উন্মত্ত জনতার অংশ। আর এই ক্ষুদ্র সমষ্টিই জাতি বিকাশের একটি নির্দিষ্ট যুগে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।

 

লেভ গুমিলেভ যাযাবর জাতিদের সম্মিলিত করে এক অভূতপূর্ব শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ার ক্ষেত্রে চেঙ্গিজ খানের ভূমিকার আলোকে তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। প্যাশনারিটি কাউকে জননেতা করে না এই বিশ্বাস হয়তো তাঁকে বিভিন্ন ব্যক্তি যারা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের এই গুনাবলীর ধারক বলতে বাঁধা দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা তাঁর তত্ত্বের আলোকে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনা করতেই পারি। এটা কোন তত্ত্ব নয়, বরং বলতে পারেন এক ধরণের কৌতূহল।

যদি আমরা শুধু জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে ধর্মীয় নেতাদের দিকে তাকাই তাহলে বুদ্ধ, যীশু বা অন্যান্যদের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখতে পাই। তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা এতটাই আবেশিত ছিলেন যে প্রথমে স্বল্প সংখ্যক অনুসারী নিয়ে শুরু করলেও কালক্রমে সারা বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মানুষকে নিজেদের ভাবনায় অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন। তাঁরা সবাই প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। অথবা যদি রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকাই তাহলেও একই ধরণের চিত্র আমরা দেখব। অনেকটা ভদ্রলোকদের ক্লাব থেকে ন্যাশনাল কংগ্রেসকে মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর ডাকে ভারত বন্দের মাধ্যমে দেশ অচল করে দিয়েছে। একই কথা বলা যায় নেতাজী সুভাষ, জিন্নাহ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে। খুব স্বল্প সংখ্যক অনুসারী নিয়ে লেনিন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের মত এক শক্তিশালী দেশ গড়তে পেরেছেন। অথবা হিটলার জার্মানির কোটি কোটি মানুষকে হ্যামিলিওনের বাঁশিওয়ালার মত নাৎসীবাদের মত এক বিধ্বংসী মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। আবার মারটিন লুথার কিং আফ্রো-আমেরিকানদের অনুপ্রাণিত করেছেন বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। এসব ঘটনা থেকে আমার মনে হয় প্যাশনারি তত্ত্ব কোন জাতির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বেশ সাফল্যের সাথেই ব্যাখ্যা করতে পারে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩১): নির্বাচন নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনা - বিজন সাহা

 

একটা সময় ছিল যখন অপছন্দের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আমেরিকা, ব্রিটেন বা অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটাত। বাংলাদেশ, চিলি, মিশর, কঙ্গো – এসব ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ। আগে এটা শুধুই অভিযোগ ছিল, এখন বোল্টন সহ বিভিন্ন মার্কিন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বেশ গর্বের সাথেই এসব কথা স্মরণ করেন। তবে যুগ বদেলেছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে যেখানে হাজার হাজার মানুষের চিন্তা ভাবনাকে ম্যানিপুলেট করা যায়, সেখানে কি দরকার নিজেদের হাতে রক্ত মাখার। প্রসঙ্গত বলে রাখি পশ্চিমা বিশ্বের অনেক রাজনীতিবিদ ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগকে খুবই ফলপ্রসূ মনে করে কেননা এতে করে একজন আমেরিকান, ব্রিটিশ বা জার্মান সেনা খরচ না করেও হাজার হাজার রুশ সেনা ও নাগরিকদের হত্যা করা যায়। এটা তাঁরা প্রকাশ্যেই বলেন। ইউক্রেনের মানুষ? তাঁরা এখন মুখে ইউক্রেন জাতিকে রুশদের থেকে আলাদা বললেও মনে মনে ঠিকই জানে এরাও রুশদের মতই স্লাভিক, তাই যত বেশি স্লাভিক, তা সে রুশ হোক, বেলারুশ হোক আর ইউক্রেনিয়ান হোক – মারা যাবে ততই তাদের জন্য ভালো। তাদের কাছে ভালো রুশ হল মৃত রুশ।

আজ যে দেশে দেশে আমরা বিভিন্ন রঙের বিপ্লবের দেখা পাই সেটা যে আমেরিকার সক্রিয় অংশগ্রহণে ঘটছে তা নিয়ে আর কোনই সন্দেহ নেই। আর এসব ঘটাচ্ছে স্বল্প সংখ্যক মানুষ। এমনকি তাদের নিজেদের দেশে এলজিবিটি, বিএলএম, মী টু – এসব আন্দোলনের পেছনেও আছে পশ্চিমা বিশ্বের ডীপ স্টেটের হাত। এরাই কি জনগণকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগাচ্ছে না? যখন কেউ বলে আজ সে ছেলে, কাল মেয়ে, পরশু অন্য কিছু, অথবা যখন কেউ বলে সে তার লিঙ্গ সম্পর্কে নিশ্চিত নয় – এটা আসলে তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। এটা সুকৌশলে মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা নিজেদের উপর আস্থা হারায়, যাতে করে ইচ্ছে মত তাদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করা হয়। আগে এসব কৌশল ব্যবহার করা হত ভিন দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য, এখন নিজ দেশেও এটা করা হচ্ছে। বিগত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিএলএমকে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আমার কথাটা অন্য জায়গায়। এসব ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে খুব অল্প সংখ্যক লোকের মাঝে বিভিন্ন আইডিয়া এমন ভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে তারা জীবন বাজি রেখে সেসব আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামে। সেটা করতে গিয়ে তারা নিজেদের, নিজ দেশ ও জাতির প্রভূত ক্ষতি সাধন করে, এমনকি ধ্বংস পর্যন্ত করতে পিছপা হয় না। তাই প্যাশনারি তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক হোক বা নাই হোক, সেটা ব্যবহার করে যে বিশ্ব রাজনীতিকে আজ কলুষিত করা হচ্ছে সেটা মনে হয় দিনের আলোর মতই সত্য। আজ যে পশ্চিমা বিশ্বের এলিট শ্রেণী রাশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক পরাজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে – সেটাও এক ধরণের প্যাশন। শুধু কি তাই? কিছুদিন আগে স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের লিঙ্গ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেবার কথা লিখেছিলাম। ধারণা করা যায় এটা সমাজের খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষের চয়েজ। তারপরেও এটাই আজ মেইন স্ট্রীম। এর আগেই বিভিন্ন সময় দেখেছি কীভাবে মারজিনাল কোন আইডিয়াকে সামনে নিয়ে আসা হয়। কীভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এলজিবিটি আদর্শের প্রচার করা হয়। আইস হকি খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের বাধ্য করা হয় রঙধনু প্রতীক ধারণ করতে। অথবা হাঁটু গেড়ে বসে বিএলএম-এর প্রতি সম্মান জানানোর কথা। অথচ মাত্র কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার ওসমান খাজা তার বুটে অল লাইভস ম্যাটার যার বাংলা করা যায় সবার উপরে মানুষ সত্য লিখে খেলতে নামতে চাইলে তাঁকে কিন্তু সেটা করতে দেয়া হয়নি। আজ কিছু লোক, প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী কিছু লোক মানবতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির নামে যা খুশি তাই করছে। ঈশ্বরের নামে ধর্ম ব্যবসায়ীরা যেমন মানুষ খুন করতে পিছপা হয় না, এরাও ঠিক তেমনি স্বাধীনতার নামে, মানবাধিকারের নামে লাখ লাখ মানুষকে বলি দিতে পিছপা হয় না। আমরা যদি এক্ষুনই এ ব্যাপারে সাবধান না হই তাহলে এক বিলিয়ন মানুষের পৃথিবী গড়ার তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সহায়ক শক্তি হব নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো