চলমান সংবাদ

২০২৩: ইউরোপের পথে বাংলাদেশিদের পাঁচ

বিগত বছরগুলোর মতো বিদায়ী বছরটিও ইউরোপে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য ঘটনাবহুল ছিল৷ তেমনই পাঁচটি সংবাদে ফিরে তাকানো যাক৷

ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসনের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছর ধরেই শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশিরা৷ বলকান, ভূমধ্যসাগর কিংবা ইরান-তুরস্ক হয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপমুখী যাত্রা অব্যাহত ছিল এ বছরও৷ অনেকে কাঙ্খিত দেশে পৌঁছালেও আটক, ডিপোর্টের শিকারও হয়েছেন অনেকে৷ ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও৷

রোমানিয়ায় আটক ও ডিপোর্ট

রোমানিয়ায় আসার পর অনিয়মিত উপায়ে দেশটির সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শেঙ্গেনভুক্ত দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন অনেক অভিবাসী৷ ২০২৩ সালে এ কারণে বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন বাংলাদেশিরা৷ গত ১২ নভেম্বর একটি মালবাহী লরিতে লুকিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় ২৪ বাংলাদেশিকে আটক করে রোমানিয়া পুলিশ৷

১২ নভেম্বর রাতে রোমানিয়ায় আটক হওয়া বাংলাদেশি অভিবাসীদের একাংশ। ছবি: রোমানিয়া সীমান্ত পুলিশ।
১২ নভেম্বর রাতে রোমানিয়ায় আটক হওয়া বাংলাদেশি অভিবাসীদের একাংশ। ছবি: রোমানিয়া সীমান্ত পুলিশ।

বিভিন্ন সময়ে এমন আটককৃতদের অনেককে পরবর্তীতে ডিপোর্ট বা দেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটি৷ শুধু জুলাইতেই ৫১ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ রোমানিয়ার জেনারেল ইনস্পেক্টরেট ফর ইমিগ্রেশনের (আইজিআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ইউরোপের দেশটিতে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন বিভিন্ন দেশের পাঁচ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী৷ তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৯৯ জন ছিলেন বাংলাদেশি৷

ভূমধ্যসাগর পাড়িতে ৪র্থ

২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভূমধ্যসগার পাড়ি দিয়ে ইটালিতে প্রবেশ করেছেন বিভিন্ন দেশের প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার অভিবাসী৷ শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছেন বাংলাদেশিরা৷

২৩ আগস্ট বেসরকারি সংস্থা এসওএস হিউম্যানি ভূমধ্যসাগর থেকে প্রায় ৬০ জনকে উদ্ধার করে, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন বাংলাদেশি৷ ছব: এসওএস হিউম্যানিটি
২৩ আগস্ট বেসরকারি সংস্থা এসওএস হিউম্যানি ভূমধ্যসাগর থেকে প্রায় ৬০ জনকে উদ্ধার করে, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন বাংলাদেশি৷ ছব: এসওএস হিউম্যানিটি

ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোট ১২ হাজার ১০০ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগরের বিপদ সংকুল পথ পেরিয়ে ইটালিতে আসতে সক্ষম হন৷

লিবিয়া থেকে প্রত্যাবাসন

ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে সবাই যে ইটালিতে পৌঁছাতে পারেন তা নয়৷ এই অভিবাসীদের বড় অংশ যাত্রা করেন লিবিয়া থেকে৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিতে এসে তারা নানা নির্যাতনের শিকার হন৷ মানবপাচারকারীদের নিষ্ঠুরতা ছাড়াও দেশটির বন্দিকেন্দ্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো৷ সেখানে আটক হওয়া বাংলাদেশিদের চলতি বছর ফেরাতে শুরু করেছে সরকার৷ ০৫ ডিসেম্বর এমন ২৬৩ জন অনিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিককে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন করা হয়৷

গত এক মাসে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন৷ ছবি: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
গত এক মাসে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন৷ ছবি: বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

২৮ নভেম্বর একই প্রক্রিয়ায় ত্রিপোলির আইনজেরা ডিটেনশন সেন্টারে আটক ১৪৩ জন অনিয়মিত বাংলাদেশি নাগরিককে ফেরত আনা হয়৷ ৩০ নভেম্বর আনা হয়েছে ১১০ জনকে৷ চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত আইওএম এর হিসাব বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২১ হাজার ৬৫৩ জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় ছিলেন৷ সে বছর চার হাজার ৪৪৮ বাংলাদেশিকে সমুদ্রযাত্রায় বাধা দেয়া হয়৷ দুই হাজার বাংলাদেশি দেশটির বিভিন্ন আটককেন্দ্রে বন্দি ছিলেন৷

অব্যাহত ছিল মৃত্যুযাত্রাও

২০২২ সালে ইটালি পৌঁছাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ঠাণ্ডায় সাত বাংলাদেশির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়৷ ২০২৩ সালেও ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টায় বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর ছিল গণমাধ্যমে৷ আগস্টে গ্রিস থেকে ফ্রান্সে যাওয়ার সময় বাংলাদেশি যুবক তাপস সরকার প্রাণ হারান৷ তীব্র গরমের মাঝে আলবেনিয়া সীমান্ত থেকে উঁচু পাহাড় বেয়ে মন্টিনিগ্রো প্রবেশের সময় পাহাড়ের মাঝে লুটে পড়েন তাপস৷ তার মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে দালালসহ অন্যরা তাকে রেখেই চলে যান৷ ভিডিও পাঠিয়ে স্বজনদের কাছে ঘটনাটি জানান তার সাথে থাকা দুই বন্ধু৷

সুনামগঞ্জের তানিল আহমেদ তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে ঠাণ্ডায় মারা যান৷ ছবি: পরিবারের কাছ থেকে সংগৃহীত
সুনামগঞ্জের তানিল আহমেদ তুরস্ক-গ্রিস সীমান্তে ঠাণ্ডায় মারা যান৷ ছবি: পরিবারের কাছ থেকে সংগৃহীত

বছরের শুরুতে ইরান থেকে তুরস্ক যাওয়ার পথে সীমান্তে মৃত্যুবরণ করেন তানিল নামের আরেক বাংলাদেশি তরুণ৷ পরিবারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ইরানে গিয়ে স্থায়ী চাকরী পেতে ব্যর্থ হয়ে বন্ধুরাসহ গ্রিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি৷ কিন্তু পথেই তার মৃত্যু হয় বলে খবর পান তারা৷

এই দুইজনের মৃত্যুর খবর পরিবারের কাছে পৌঁছালেও অনেকের ক্ষেত্রেও তা-ও সম্ভব হয় না৷ কারণ সমুদ্রে মৃত্যুবরণকারী বা নিখোঁজদের পরিচয় বেশিরভাগক্ষেত্রেই জানা যায় না৷

গ্রিসে বাংলাদেশিদের নিয়মিতকরণ

অনিয়মিতভাবে থাকা বাংলাদেশিদের চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি থেকে নিয়মিত হওয়ার সুযোগ দেয় গ্রিস৷ এই আবেদনের শেষ সময় ছিল ৩০ নভেম্বর৷ এর মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদি গ্রিক রেসিডেন্স পারমিটের সুযোগ দেয়ে গ্রিক কর্তৃপক্ষ৷

২০২২ সালে গ্রিসের নেয়া মানোলাদায় পাসপোর্ট হালনাগাদ আবেদনের জন্য বাংলাদেশিদের অপেক্ষা৷ ছবি: আরাফাতুল ইসলাম
২০২২ সালে গ্রিসের নেয়া মানোলাদায় পাসপোর্ট হালনাগাদ আবেদনের জন্য বাংলাদেশিদের অপেক্ষা৷ ছবি: আরাফাতুল ইসলাম

দেশটিতে অনিয়মিতভাবে বসবাসরত বাংলাদেশিদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুত করা এবং নিয়মিত অভিবাসনের দরজা খুলে দিতে ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশের সরকার৷ তার ধারাবাহিকতায় নিয়মিতকরণের এই উদ্যোগ নিয়েছে এথেন্স৷ ২ অক্টোবর বাংলাদেশ দূতাবাসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক নিবন্ধনকারীদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজারেরও বেশি৷ এর মধ্যে অন্তত ছয় হাজার দ্বিতীয় ধাপ শেষে গ্রিক কর্তৃপক্ষ থেকে বৈধতার সত্যয়ন পেয়েছেন৷