বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা(১২১): ধর্ম ও উৎসব

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত সপ্তাহে আমরা ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে বলেছিলাম। এবার আমরা বলব ধর্ম আর উৎসব নিয়ে।

আজকাল আমরা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের জাতীয় উৎসব পালন করি। এসব আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। তবে একটা সময় ছিল যখন মানুষের প্রায় সব উৎসবই ছিল ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত। তা সে পূজা পার্বণ হোক, নবান্ন বা অন্য কিছু হোক। অন্তত উপমহাদেশে তো বটেই। সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় উৎসব শুধু ধর্মের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেটা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। উৎসব মানেই টাকার ছড়াছড়ি। আগে মানুষের হাতে সেরকম টাকা পয়সা ছিল না। তবে এসব উৎসবে পাড়ার ছোট ব্যবসায়ী একটু বেশি মিষ্টি, খেলনা এসব বিক্রি করতে পারত আর দর্জিরা রাজ্যের জামাকাপড় সেলাই করে ফুলে ফেঁপে উঠত। কিন্তু এসব উৎসবে কখনই বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান সরাসরি জড়িত ছিল না, যদিও তারাই ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করত। সে অর্থে তাদের অংশগ্রহণ ছিল পরোক্ষ। অন্তত বর্তমান সময়ের মাপে। তাই বাণিজ্য হলেও তখন এসব অনুষ্ঠানকে বাণিজ্যিক বলা যেত না বা হত না। অথবা বলা চলে তখন ধর্ম আর বানিজ্যের দড়ি টানাটানি খেলায় ধর্মই বিজয়ী হত। পক্ষান্তরে, এখন মানুষের হাতে পয়সা থাকায় আর বিশাল বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান এতে সরাসরি অংশ নেয়ায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান এখন বাণিজ্যিক হয়েছে বললেও উত্যুক্তি হবে না।

১৯৮৩ সালে আমি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি তখন এখানে পূজার বালাই ছিল না। পূজা তো দূরের কথা ইস্টার, ক্রিস্টমাস এসব হতে প্রায় গোপনে। তবে পেরেস্ত্রইকার দমকা হাওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের অনেক কিছুর সাথে সাথে আমাদের এলাকার পূজাও এখানে আসে। প্রথম দিকে অনেকটা ঘরোয়া হলেও ধীরে ধীরে পূজা মস্কোর বাঙালি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে এটা আমাদের অনেককেই সুযোগ করে দেয় বছরে একবার হলেও বন্ধুদের সাথে দেখা করার। এটা ঠিক যে এর বাইরেও আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, নববর্ষ ইত্যাদি। তবে তা মূলত নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাছাড়া এসব অনুষ্ঠান হয় মাত্র একদিন। সেক্ষেত্রে চারদিন ব্যাপী মস্কোর পূজা আমাদের সুযোগ করে দেয় শুধু বাঙালি নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের, নেপাল, শ্রীলংকা ও অনেক রুশ বন্ধুদের সাথে দেখা করার।

বেশ কয়েক বছর করোনার করুণায় মস্কোয় এসব পাবলিক অনুষ্ঠান করা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তাই গত তিন বছর পূজা হয়েছে ঘরোয়া পরিবেশে। শেষ পর্যন্ত এবার আবার সবাইকে নিয়ে পূজা হয়েছে। আর এটা সুযোগ করে দিয়েছে পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা করার। আমি পূজায় গেলে আগে থেকেই কিছু কিছু লোকদের জানাই আর ওটাই ছিল ওদের সাথে দেখা করার একমাত্র জায়গা। করোনায় বেশ কিছু বন্ধুকে হারিয়েছি বলে দেখা না হওয়ার খাতায় আরও কিছু নতুন নাম যোগ হয়েছে এবার। ছোটবেলায় পূজা সহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতাম ভয় আর ভক্তি থেকে, আবার এক সময়ে অবজ্ঞা থেকে এসব এড়িয়ে চলেছি। এখন যাই। যাই বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। আড্ডাবাজ হিসেবে বাঙালির নাম আছে। সুযোগ পেলেই তারা উছিলা খোঁজে বন্ধুদের সাথে দেখা করার। ছাত্রজীবনে বা ছাত্রদের জন্য সেটা সহজ, কারণ তারা অনেকেই একসাথে থাকে। আমরা যারা কর্মজীবনে ব্যস্ত আর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের ভরসা এসব পাবলিক অনুষ্ঠান। যদি পূজা, ঈদ, বিশেষ করে রমজানের ইফতার পার্টি ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরস্পরের সাথে দেখা হবার সুযোগ করে দেয় সেটা দু’ হাতে লুফে নিতে সমস্যা কি?

 

ফেসবুক সহ অন্যান্য গণমাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পূজার যে ছবি দেখা যায়, যে খবর পাওয়া যায় সেটা থেকে বুঝি সবাই এটাকে যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি করে সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে নেয়। এ উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। অন্তত বিদেশের মাটিতে পূজা আসে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন বার্তা নিয়ে। এটা কয়েকদিনের জন্য হলেও আমাদের সুযোগ করে দেয় দেশীয় পরিবেশে ফিরে যেতে। অন্তত বিদেশের মাটিতে দেশীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে নববর্ষের মত পূজাও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে ঈদের কথা এজন্যেই বলছি না যে ঈদ সেই অর্থে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক আর পূজা, বিশেষ করে দুর্গা পূজা বাঙালির একান্তই নিজস্ব।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১২০): ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা -বিজন সাহা

যখন বন্ধুদের বা অপরিচিত অনেককেই দেখি ফেসবুকে ঈদ, পূজা এসব নিয়ে লিখতে – তাদের অধিকাংশই হয় ছোটবেলার স্মৃতিচারণ। শুনি হারিয়ে যাওয়া সেই আনন্দময় দিনগুলোর কথা। তাতে ফুটে ওঠে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ছবি। তাই প্রশ্ন জাগে এমন কি হল যে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে, অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বেশি উন্নত বাংলাদেশ থেকে সেই সমাজ, সেই পরিবেশ নাই হয়ে গেল? কারণ আজকাল পূজা তো বটেই এমনকি ঈদের মাথেও পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ আমাদের ছোট বেলায় পূজা বা ঈদ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই খুশি আমেজ বয়ে আনত।

আজকাল একটা স্লোগান প্রায়ই শোনা যায় – “ধর্ম যার যার উৎসব সবার।” বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে রেষারেষি দেখে আর বিভিন্ন ধর্মের ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন ধারণা দেখে এক সময় মনে হত এটা বাতুলতা। খ্রিষ্টান ধর্মে ঈশ্বর যদি স্নেহময় পিতা হন, ইহুদী ধর্মে তিনি প্রচণ্ড রাগী যিনি শাস্তি দেবার অপেক্ষায় বসে আছেন। হিন্দু ধর্মের দেবদেবীরা তো অনেকটা মর্ত্যের মানুষের মত যারা যখন তখন যেখানে সেখানে দেখা দিতে পারেন। ঈশ্বরের ধারণা যখন বিভিন্ন ধর্মে এত ভিন্ন সেখানে বিভিন্ন ধর্মপালনকারীরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য কোথায় খুঁজে পাবে? এমন কি পরস্পরের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন দুই ফুটবল বা ক্রিকেট টিমকে ফুটবল বা ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা এক করে, কিন্তু ধর্মে সে সুযোগই নেই। তাহলে?

আমরা যখন কোন ধর্মীয় উৎসবের কথা বলি তখন শুধু কোন একটা নির্দিষ্ট ধর্মের লোকদেরকেই এই অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত দেখি। সত্যি কি তাই? ঈদ হোক, পূজা হোক সব উৎসবেই তো কোন না কোন ভাবে সারা দেশের মানুষই জড়িয়ে পড়ে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে যখন পূজা হত তখন খালের উপর সাঁকো তৈরি থেকে শুরু করে প্রতিমার জন্য মাটি ও শন আনা, মন্ডপ তৈরি করা, কুমোরদের প্রতিমা তৈরিতে সাহায্য করা – এসবই করত বদু ভাই, নালু ভাই, হজরত ভাইরা। দুধ থেকে শুরু করে শাকসবজি আসত মুসলমান প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। আবার ঈদের সময় সবাই জামা কাপড় এসব কিনত হিন্দু তাঁতিদের কাছ থেকে। আর যেহেতু ঈদ, পূজা এসব ঘিরে আবর্তিত হয় কোটি কোটি টাকা, তাই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই চেষ্টা করে বাতাসে উড়তে থাকা সেই টাকার কিছুটা হলেও নিজের পকেটে ভরতে। আর বর্তমান যুগে, যেখানে টাকাই শেষ কথা, যেখানে মার্কেটিং সমাজের চালিকা শক্তি – সেখানে সবাই, বিশেষ করে বড় বড় কোম্পানিগুলো চেষ্টা করে বাজারে নতুন নতুন জিনিস আনতে। শুধু পূজা বা ঈদ নয়, এখন ইংরেজি ও বাংলা নববর্ষ, একুশ, বিজয় দিবস এসব উপলক্ষ্যেও বাজারে আসে নতুন ফ্যাশন। আর এখানেই মনে হয় ধর্ম যার যার উৎসব সবার স্লোগানের সার্থকতা। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমাদের দেশের সরকার অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে অনেক কথা বললেও, উন্নয়নের কথা বললেও এবং পূজা দেশের অর্থনীতিতে পজিটিভ রোল প্লে করলেও পূজা যাতে নির্বিঘ্নে হয় সেজন্য  যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রায়ই ব্যর্থ হয়। এর কারণ সরকার বা ব্যবসায়ীদের একটা অংশ পূজা বা ঈদকে ব্যবসায়িক দিক থেকে না দেখে শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই দেখে। একই কথা বলা যেতে পারে বাংলা নববর্ষের ক্ষেত্রেও। অথচ সরকার বা ব্যবসায়ীরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে, এসব অনুষ্ঠানকে শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অবস্থার পরিবর্তন হত বলেই আমার বিশ্বাস।

ফেসবুকে দেখলাম ইউনেস্কো দুর্গা পূজাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি স্বরূপ প্রকাশ করেছে একটি মুদ্রাও। এর আগেও ইউনেস্কো বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। এসব উৎসব আজ ধর্মীয় গণ্ডী পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে। সময়ের সাথে সাথে এর মার্কেট ভ্যালুও বাড়ছে। আশা করি দেশের মানুষ ও সামাজ এসব বিবেচনায় ভবিষ্যতে বাঙালির এসব উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, এদের উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো