চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা (১২০): ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

কয়েকদিন আগে সিমিওনের সাথে আমি ভ্লাদিমির আর সুজদাল বেড়াতে গেছিলাম। সিমিওন আমার পরিচিত ফটোগ্রাফ। এক সময় আমাদের ক্লাবে আসত, ওখান থেকেই আলাপ। পরে জেনেছি ও আমার ছেলে আন্তনের ক্লাসমেট। তবে এটাও ভুল তথ্য। আন্তনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ও এক ক্লাস নীচে পড়ত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ায় বাচ্চারা স্কুলে যায় ৭ বছর বয়সে। স্কুল শুরু হয় পয়লা সেপ্টেম্বর। এই সময়ে যাদের বয়স পূর্ণ সাত বছর তারাই স্কুলে যেতে পারে। বাবা মার অনুরোধে সেপ্টেম্বরে জন্ম নেয়া অনেককেই ভর্তি করে, তবে আন্তনের জন্ম ২৬ অক্টোবর। তারপরেও আমরা ওকে বলে কয়ে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই। ফলে ও মেলামেশা করত ওর চেয়ে এক ক্লাস নীচে যারা পড়ত তাদের সাথে আর ক্লাসে যেত বড়দের সাথে। এটা ওর উপর ওভার অল  নেগেটিভ ছাপ রেখেছে। আমাদের দেশে সবাই চায় যত সম্ভব কম বয়সে ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে। আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে এরা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে দেখতে পারে। কারণ শৈশব ঠিক মত উপভোগ করার আগেই স্কুলের মত একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ মানসিক ভাবে নেগেটিভ এফেক্ট ফেলতে পারে। যাহোক, ফিরে আসি আমাদের ভ্রমণে। ভ্লাদিমির রাশিয়ার অন্যতম পুরাতন শহর। সুজদালকে বলা চলে মিউজিয়াম শহর। তবে সে গল্প পরে এক সময় করা যাবে। এই ছবি শিকারে গিয়ে সিমিওনের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প নিয়ে আজকের গল্প।

রাশিয়ার পুরাতন শহর মানেই দুর্গ আর গির্জা। আসলে এখানে দুর্গই গির্জা আর গির্জাই দুর্গ। কীভাবে? সেই সময় কেউ যখন কোন জায়গা বা রাজ্য দখল করত তখন প্রথমেই সেখানে উপাসনালয় গড়ে তুলত। কেন? ধর্ম প্রচারে? মনে হয় না। মানুষ যখন থেকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে বাস করতে শুরু করেছে তখন থেকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই তাকে বেছে নিতে হয়েছে একজন নেতা। সেটা শুধু মানুষ নয় অন্যান্য জীবজন্তুর মধ্যেও দেখা যায়। এটা মনে হয় বেঁচে থাকার অপরিহার্য শর্ত। এরপর এক সময় গড়ে ওঠে রাজ্য। তারও আগে মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে আকাশ থেকে কেউ একজন ভাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এক সময় রাজা নিজেকে  পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে। মানুষ সেটা মেনে নেয়। তখন ধর্ম রাজ্যের প্রজাদের বিনি সুতার মালায় গেঁথে রাখত। সে সময় প্রতিটি রাজ্যে নিজস্ব দেবতা ছিল এবং তাদের ঘিরে গড়ে উঠতো মন্দির বা উপাসনালয়। আর ধর্ম তো শুধু উপাসনা নয়, এটা জীবনযাপনের কিছু নিয়ম কানুন। তখন রাজ্যে কোন সংবিধান ছিল না, এই ধর্মীয় নিয়ম কানুনই ছিল রাজ্যের আইন। তাই একেবারে শুরু থেকেই ধর্ম ছিল ধর্মের চেয়ে বড় কিছু, ছিলরাজনৈতিকহাতিয়ার।

এরপর শুরু হল রাজ্য বিস্তারের যুগ। যুদ্ধ করে, সামরিক শক্তি বলে কোন দেশ দখল করা গেলেও, সেই রাজ্যের রাজা বা সেনাদের পরাজিত করে হত্যা বা বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা গেলেও প্রজাদের মন জয় করা যায় না। নবাগত যে কোন শক্তিকে সবাই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিজয়ী রাজ্যের প্রজারা ছিল শত্রুভাবাপন্ন। তাহলে কিভাবে নতুন রাজ্যে বন্ধু খুঁজে পাওয়া যায়? কিভাবে এমন কিছু লোক পাওয়া যায় যাদের সাথে কিছু কমন ব্যাপার স্যাপার থাকে? তখন দরকার এমন কোন আদর্শ যাতে সবাই না হলেও অনেকেই বিশ্বাস করবে। এ সমস্ত লোকদের যদি নতুন ধর্মে দীক্ষিত করা যায় তাহলে এই শত্রু দেশেও নিজেদের মিত্র পাওয়া যায়। কারণ ধর্ম তাদের এক করে। ধর্ম তাদের মধ্যে এক ধরণের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে। আর এ কারণেই সেই যুগে কোন দেশ দখল করে নতুন শাসকবৃন্দ সেখানে নিজেদের ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য সচেষ্ট হতেন। তাই যখন থেকেই উপনিবেশের ধারণা শুরু হয় তখন থেকেই ধর্মকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হতে থাকে, ধর্ম নিজের অজান্তেই অনেক রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে থাকে। এভাবেই ইউরোপীয় দেশগুলো এশিয়া, আমেরিকাআরআফ্রিকারদেশেদেশেনিয়েআসেখ্রিস্টানধর্মআরআরববিশ্বইসলাম।

বর্তমান যুগে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি সেই ভূমিকা পালন করে। তাই তো আমরা দেখি বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রে বা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী লোকজন পরস্পরের প্রতি এক ধরণের আত্মীয়তা বোধ করে। যে সমস্ত দেশ গণতন্ত্রের কথা বলে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অমিল থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলোকে বন্ধু মনে করে। একসময় সারা বিশ্বের সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী লোকজন পরস্পরকে বন্ধু মনে করত, সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাত, এমনকি যুদ্ধে পর্যন্ত যেত। সেদিকে দেখতে গেলে এই সব আদর্শ আসলে সাম্রাজ্য বিস্তারের একটা হাতিয়ার। তবে বর্তমানে কী ধর্ম, কী গণতন্ত্র, কী সমাজতন্ত্র, কী মানবাধিকার, কী বাক স্বাধীনতা –  সবই ব্ল্যাকমেইল হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ব্যবহার করা হচ্ছে অল্প কিছু লোকের শাসন ও শোষণ অধিকাংশ মানুষের উপরে চাপিয়ে দেবার জন্য। তাই আমাদের লড়াই করতে হবে যতটা না কোন ধর্ম বা কোন আদর্শের বিরুদ্ধে তার চেয়ে বেশি যারা আদর্শকে বা ধর্মকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে তাদের বিরুদ্ধে।

একটা সময় সব ধর্মই খুব ছোট পরিসরে বিস্তৃত ছিল। তাই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা বড় ধর্মের চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি। বর্তমানে খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্মকে বিশ্বের প্রধান ধর্ম হিসেবে দেখা হয়। এটা মূলত এই সব ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যার কারণে অথবা কতগুলো দেশে এসব ধর্মের অনুসারী আছে বা এদের অনুসারীরা কতটা প্রভাবশালী তার উপর ভিত্তি করে। এসব ধর্মের মধ্যেও আবার প্রচুর ভাগ আছে। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজন এক অন্যের উপর  আক্রমণ করার খবর কিন্তু আমরা খুব একটা পাই না। যেমন কাদিয়ানীরা আহমদী সম্প্রদায়ের লোকজনদের উপর উপর আক্রমণ করছে বলে শোনা যায় না, কিন্তু বড় বড় ধর্মগুলো যেমন ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি – এরা তো ধর্মের নাম নিয়েই প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে, করছে। তাই রাজনীতি যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে,  একই ভাবে কোন ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা যখন বিশাল হয় তখন সেই ধর্মও অনেকটা সাম্রাজ্যের রূপ লাভ করে আর সাম্রাজ্যের মতই বিভিন্ন ধরণের যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হয়। অন্তত বিভিন্ন দেশে ধর্মকে ঘিরে হানাহানি আমাদের সেরকম ভাবতেই বাধ্য করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা(১২১): ধর্ম ও উৎসব - বিজন সাহা

আপনারা হয়তো ভাবছেন সিমিওন এখানে কোথায়? ভ্লাদিমির থেকে আমরা পার্শ্ববর্তী বগোলুবভে যাই সেখানকার বিখ্যাত ও দর্শনীয় গির্জার ছবি তুলতে। চারিদিকে ঘুরে ছবি তোলার পরে সিমিওন আমাকে বলল,
– বিজন তুমি চাইলে ভেতরে যেতে পার। আমি যাব না।

আমি কিছু না বলে গির্জার ভেতরে ঢুকে বেশ কিছু ছবি তুললাম। তারপর রওনা দিলাম কয়েক কিলমিটার দূরে আরেকটা গির্জার দিকে। পথে সিমিওন কথা তুলল
– এক সময় আমি গির্জায় যেতাম। এখন যেতে ইচ্ছে করে না।
– তাই? দেখ আমিও এক সময় দেব দেবতায় বিশ্বাস করতাম, মাঝখানে এসব এড়িয়ে চলতাম। এখন ওসব নিয়ে ভাবি না, যাই। আসলে জান বিশ্বাস আর অবিশ্বাস দুটোই বিশ্বাস। তাছাড়া মানুষ যায় কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। যেমন আমাদের ক্লাব – অনেকে এটাকে তলকুঠুরি বলে। তবে আমার কাছে এটা ক্লাব যেখানে ফটোগ্রাফি নিয়ে কথা হয়। আসলে কোন জায়গাটা কি সেটা নির্ভর করে কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। যারা ধার্মিক তারা এখানে আসে তাদের সৃষ্টিকর্তার খোঁজে, আমি আসি মানুষের তৈরি শিল্প দেখতে। এই যে স্থাপত্য, ফ্রেস্কো এসব কিন্তু মানুষের তৈরি। আসলে শিল্পের শুরু কিন্তু এসব উপাসনালয়কে ঘিরেই। যদি খেয়াল কর দেখবে আগে সব শিল্পী শুধু ঈশ্বর বা বাইবেল বা অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনাবলীর ছবি আঁকতেন। তারপর সেই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ধীরে ধীরে মানুষ, প্রকৃতি এসব হয় অঙ্কনের বিষয়। অথবা গান। একসময় তো মানুষ শুধু ঈশ্বর বন্দনা করত। রাশিয়ায় গির্জায় গান করে খালি গলায়। আমি ঠিক জানি না রাশিয়ার আধুনিক গানে এই সঙ্গীতের প্রভাব কতটুকু। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রার্থনা সঙ্গীত বিশেষ করে ভজন, কীর্তন, বাউল এসবের প্রভাব আমাদের আধুনিক গানে এখনও প্রবল। আর এসব সুরে প্রচুর জনপ্রিয় গান রচিত হয়েছে। আমরা কি পারব সেই সুর ত্যাগ করতে? কথা বদলালেও, এমনকি ধর্মবিরোধী কথা দিয়ে গান বানালেও সুরের মধ্য দিয়ে ধর্মের উত্তরাধিকার থেকেই যাবে। ইতিহাস নিয়ে চর্চা করলে দেখবে অতীতের অনেক কিছুই আমরা জানতে পারি ধর্ম শাস্ত্র থেকে। আচ্ছা মায়া বা ইনিকা সভ্যতার কথা কি আমাদের কাছে তাদের মন্দিরের মাধ্যমে আসেনি? অথবা মিশরের? সেখানকার পিরামিড যা আসলে সমাধি সেটাও তো ধর্মীয় রীতিনীতি থেকেই। রাশিয়ার সব চেয়ে প্রাচীন স্থাপনা তো গির্জা। ভারতবর্ষে মন্দির বা বৌদ্ধ স্তূপ। তাছাড়া এক সময় এমনকি শিক্ষার একমাত্র জায়গা ছিল ধর্মীয় আশ্রম। তাই শুধু গান বা শিল্প নয়, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই এসেছে ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে। সংক্ষেপে বললে আমাদের সংস্কৃতি এই ধর্ম থেকেই এসেছে, মানে ধর্মীয় আচার আচরণ, রীতিনীতি আমাদের সংস্কৃতিকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছে। আমরা তো চাইলেই আমাদের সংস্কৃতি ত্যাগ করতে পারব না। আর ত্যাগ করে দেবই বা কি? নতুন কিছু? কিন্তু সেটা হবে আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে – যে অভিজ্ঞতার ভিত্তি আবার সেই ধর্ম। এক অর্থে ধর্ম তাই বর্তমানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মত, আর ডোমগনেটিং ধর্ম হচ্ছে সরকারি দল। সেটা যে সবসময়ই সংখ্যাগুরুর ধর্ম হতে হবে এমন কথা নেই। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম যখন সমাজে ও রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য লাভ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই দেশ কার্যত হয় রিলিজিয়াস স্টেট। তবে রাজনীতিতে সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরকারি দল পরিবর্তিত হলেও ধর্মে সেই সুযোগ নেই। ধর্ম জন্মদাগের মত লেগে থাকে, চাইলেই এটা খোলনলচে সহ পাল্টানো যায় না।
তাহলে কী আমাদের সবাইকে উপাসনা করতে হবে?
না। সেটার দরকার নেই। কিছু জিনিসের বিরুদ্ধে লড়াই করা অর্থহীন। যদি কেউ ধর্মকে ব্যবহার করে অসামাজিক কিছু করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আর সেটা যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্যেই দরকার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এটা ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মের পক্ষেও নয়। এটা যে চায় তাকে ধর্ম পালন করার অধিকার দেয় আবার যে চায় না তাকে ধর্ম না পালন করার অধিকার দেয় আর প্রতিটি মানুষকে তার বিশ্বাস অনুযায়ী বেঁচে থাকার নিরাপত্তা দেয় যতক্ষণ না তার বিশ্বাস সমাজের অন্য সদস্যদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো