বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১৫):পরিবর্তন

-বিজন সাহা

গত সপ্তাহে আমরা পাপ পুণ্য, ন্যায় অন্যায়, বৈধ অবৈধ – এসব নিয়ে কথা বলেছিলাম। তার মূল বিষয়টা ছিল আমরা যেন যেকোনো তত্ত্ব কোন সমাজে প্রয়োগ করতে গেলে সেই সমাজের বৈশিষ্ট্য মাথায় রাখি কারণ এই বিশেষত্বগুলো গণিতের ভাষায় যাকে বলে ইনিশিয়াল বা বাউন্ডারি কন্ডিশনের মত। তত্ত্ব অনুযায়ী কোন সমস্যার সাধারণ সমাধান থাকলেও সেই সমাধান যদি নির্দিষ্ট সমাজের বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে সেই সমাজে সেই তত্ত্ব ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাহলে কি আমাদের সমাজে, যেখানে ধর্ম মানুষের মনে খুব গভীর ভাবে প্রোথিত, কোন বিজ্ঞানমুখী পরিবর্তন মোটেই সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব যদি আমরা সমাজের বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে তত্ত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেসব বৈশিষ্ট্যও একটু একটু করে বদলাতে থাকি। অর্থাৎ এখানে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে যাতে সমাজ যেমন পরিবর্তন গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয় একই ভাবে তত্ত্বও সমাজের বিশেষত্বকে মেনে নিয়ে নিজেকে বদলাতে পারে। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তত্ত্বের পরিবর্তন হয় যেন সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে, উল্টোটা নয়।

রাশিয়ায় যখন বিপ্লব সংগঠিত হয় তখন এখানকার সমাজ আমাদের মতই পশ্চাৎপদ ছিল। সোভিয়েত ব্যবস্থা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে সার্বজনীন শিক্ষা ও নারীদের অধিকার বাস্তবায়িত করা ছাড়া সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো অবস্থায় আছি। আজকাল আমরা প্রায়ই অভিযোগ করি যে চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের দেশে হাতে গোনা কিছু মহিলা হিজাব ব্যবহার করত। এখন শিক্ষিত অশিক্ষিত, গ্রাম শহর সর্বত্রই হিজাবের ছড়াছড়ি। আমি নিজেও দেখেছি আমাদের গ্রামে শুধু মৌলভী স্যারের স্ত্রী বাইরে কোথাও গেলে বোরকা পরতেন। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে তখন গ্রামের খুব কম সংখ্যক মেয়েই লেখাপড়া করত। বাড়িতে অসম্ভব পরিশ্রম করলেও খুব কম মহিলাই বাইরে কাজ করত। আজ সারা দেশ জুড়েই তো মহিলারা কাজ করছে। গার্মেন্টসের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের চালিকা শক্তি তারা। আমাদের ছোটবেলায় নার্স থাকলেও মহিলা ডাক্তার খুব একটা দেখা যেত না। এখন শুধু গার্মেন্টস নয় অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল থেকে শুরু করে সর্বত্রই তাদের বিচরণ। এসব তো গেল কাজকর্ম। এখন ছেলেদের পাশাপাশি খেলাধুলাতেও মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন খেলায় জয়ী হয়ে দেশের জন্য সম্মান কুড়িয়ে আনছে। তার মানে শুধু বোরকা বা হিজাব বাড়ছে না সাথে সাথে বাড়ছে নারীদের অধিকার সচেতনতা, বাড়ছে দেশ গঠনে তাদের অংশগ্রহণ। দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সেই পরিমাণ অধিকার তারা ভোগ করতে পারছে না। আগে দেশের অধিকাংশ মহিলা শাড়ি ও পুরুষেরা লুঙ্গি পরত। এখন বেশির ভাগ মহিলা গাউন আর ছেলেরা প্যান্ট পরে। তার মানে হচ্ছে সমাজ শুধু ধর্মীয় পোশাকেই নিজেকে আচ্ছাদিত করছে না, পশ্চিমা পোশাকও পরছে। সমাজ বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন গ্রহণ করে নিচ্ছে। তাছাড়া শুধু মহিলাদের কথাই বলব কেন? কয়েক দশক আগেও বলা হত বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এখন তো শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। আর শ্রমিক বাড়া মানেই তো বিপ্লবের পরিবেশ তৈরি হওয়া। তবে আজকের শ্রমিক আর সর্বহারা হয়, সে এখন ঋণী। ব্যাংকের কাছে, মালিকের কাছে। কিছু না থাকা আর ঋণ থাকা এক কথা নয়। ঋণ থাকলে দায়িত্ব বেড়ে যায়, তাই এখনকার শ্রমিক আগের মত লড়াকু হয় না। তবে মূল কথা হল যে সমাজ অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে আর সেটা মাথায় রেখেই তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ কৌশল বদলাতে হবে। প্রশ্ন হল এক দিকে দেশ উন্নয়নের রথে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে সেই একই দেশ বিভিন্ন ধরণের গোঁড়ামির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে কেন? কারা এসব করছে? এর দায় মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর। ভোটের হিসেব নিকেশ করতে গিয়ে সব ধরণের রাজনৈতিক দলই ধর্মীয় উগ্রতা ও গোঁড়ামিকে পোষণ করছে। সর্বশেষ উদাহরণ সবেমাত্র ক্যারিয়ার শুরু করা এক ক্রিকেটার। প্রথম ম্যাচেই সে খেলা দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। কিন্তু একই সাথে সে অবাক করেছে হাজার হাজার মানুষকে তার নারী বিদ্বেষী স্ট্যাটাস দিয়ে। গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে যে দেশের রাজনীতির চাবিকাঠি নারীদের হাতে, যে দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী নিজের যোগ্যতা বলে বিশ্বের দরবারে নিজেকে একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন সে দেশেই প্রতিদিন প্রকাশ্যে নারীদের হয়রানি করা হচ্ছে, নারী সহ সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রকাশ্যে হেয় করা হচ্ছে, আক্রমণ করা হচ্ছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বললেই চলে। সেটা না করছে সরকার, না বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, না অন্য কেউ। যে বাংলাদেশের মানুষ কয়েক দশক আগেও যথেষ্ট সহনশীল ছিল তারা কিভাবে দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে সেটা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবা দরকার। একদিকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ব, আবার একই সাথে মদিনা সনদের কথা বলব – সেটা হয় না। সেটা এক সাথে করা যায় না, কেননা দুটোর পথ ভিন্ন, দিক ভিন্ন। দুটো একসাথে করতে গেলে আসলে নিজেদের ধোঁকা দেয়া হয়। ধোঁকা দিয়ে আর যাই হোক সচেতন সমাজ গড়া যায় না। মজার ব্যাপার হল ইসলামী দেশগুলোতে, তা সে কামালের তুরস্ক হোক, সৌদি আরব কিংবা মিশর হোক, যত সহজে আইন করে বিভিন্ন ধরণের পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করা যায়, আমাদের সব দেশ সেটা করা যায় না, করে না। কেন? আবার সেই ভোটের হিসাব, পরকালের হিসাব। যতদিন আমরা ধর্মকে  ধর্ম হিসেবে ব্যবহার না করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করব তত দিন এ সমস্যা থাকবেই। চন্দ্রায়ন – ৩ এর সফল অভিযানে মেয়েদের ভূমিকা, মুসলিম মহিলা বিজ্ঞানীর ভারতের সূর্য গবেষণা টীমের প্রধান হওয়া এসবের পেছনে কী আছে? সামাজিক পরিবেশ। উপমহাদেশের মেয়েরা – তা সে ভারতীয় হোক, বাংলাদেশী হোক বা পাকিস্তানীই হোক কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। আমাদের মেয়েরা ইউরোপ আমেরিকায় অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বিভিন্ন ধরণের গবেষণা করছে – তাহলে দেশে কেন পারবে না? পারে না, কারণ সমাজ তাদের সেই সুযোগ দেয় না, উৎসাহিত করে না। যদি করতই তবে যারা প্রতিনিয়ত নারীদের আক্ষরিক অর্থেই গৃহবন্দী করে রাখার ডাক দেয়, নারীদের উচ্চ শিক্ষা, চাকুরী এসব থেকে বঞ্চিত করার আহ্বান জানায়, তাদের আইনের আওতায় না এনে উল্টো তাদের সাথে রাজনৈতিক আঁতাত করত না। আসলে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমাজকে এসব মানসিক রোগ থেকে মুক্ত করতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত এসব চলতেই থাকবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১৪): পাপ পুণ্য-বিজন সাহা

ঠিক কি কারণে জানি না, তবে বিভিন্ন দেশে একটা বদ্ধমূল ধারণা যে সমাজতন্ত্র মানেই ধর্মবিরোধী। আর এর কারণ মার্ক্সের ধর্মকে অপিউমের সাথে তুলনা, যদিও সেটা এক বিশেষ কন্টেক্সটে বলা। তবে পুঁজিবাদ সেটাকে এত ভালো ভাবে বাজারজাত করেছে যে দেশ বিদেশের বামপন্থীরাও সেটা গিলেছে। রাশিয়ার ইতিহাসে রাশিয়ার চার্চ বার বার দেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেটা সেরগি রদনিঝ হোক আর সেরাফিম সারোভস্কি হোক। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ান চার্চ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে পিটার দ্য গ্রেটের আগে পর্যন্ত রুশ চার্চের প্রধান ছিলেন চার্চের পাট্রিয়ারখ। পিটার নিজেকে চার্চের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত সেভাবেই ছিল। বিপ্লবের পর চার্চের ক্ষমতা খর্ব করা হলেও যুদ্ধের সময় স্তালিন চার্চকে পুনপ্রতিষ্ঠা করেন, শুধু তাই নয় জারদের পথে না গিয়ে চার্চের দায়িত্ব পুরোপুরি চার্চের হাতেই ফিরিয়ে দেন। এটা ঠিক সে সময় চার্চ বা উপাসনালয় আগের মত বা বর্তমানের মত স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারত না, এমনকি বলা হয়ে থাকে যে উপাসনালয়ের কর্তাদের অনেকেই কেজিবির সাথে সরাসরি জড়িত ছিল, তারপরেও ফর্মালি একটা সমাধান তারা বের করতে পেরেছিল, ফলে কি সোভিয়েত ইউনিয়নে, কি বর্তমান রাশিয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে হানাহানি নেই যেটা আমাদের দেশে দেখা যায়। এর মানে হল তারা সমাজের পালস বুঝে সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। আর লেনিনের নেপ বা নিউ ইকোনমিক পলিসি তো সর্বজনবিদিত। এরা যদি প্রয়োজনে পরিবর্তনকে গ্রহণ করে নিতে পারেন আমরা পারি না কেন?  আপনি যখন পরিবর্তনকে নিজে গ্রহণ করেন তখন সেটা নিজের মত করেই করতে পারেন, কি কি নেবেন আর কি নেবেন না সেটা আপনি নিজেই ঠিক করতে পারেন। সঠিক সময়ে নিজে থেকে সেটা না করলে পরিস্থিত আপনাকে বাধ্য করে পরিবর্তনকে মেনে নিতে। তখন তাতে আর আপনার কোনই হাত থাকে না, যা দেয় সেটাই নিতে হয়। তাই সময়ের সাথে সাথে নিজেকে বদলানোর ক্ষমতা সেটাও সমাজ বদলের লড়াইয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ পরিবর্তনের লড়াইটা তাই শুরু করতে হবে নিজেকে বদলানোর মধ্য দিয়েই।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো