বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১৪): পাপ পুণ্য

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত ২৬ আগস্ট জুমে একটা আলোচনার আয়োজন করা হয়। উদ্দেশ্য গত দুই বছরে আমার শতাধিক লেখার পর আমার ও পাঠকদের মধ্যে মত বিনিময়। সেখানে যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছিল সেসব নিয়েই কিছু আলোচনা আমরা করব। কারণ সময়ের কারণে অনেক কিছুর উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি আবার এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে অনেক নতুন কথাও মাথায় এসেছে। আবার ঐ আলোচনার পরে অনেকেই ব্যক্তিগত আলাপে বেশ কিছু ব্যাপার নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফলে মনে হয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে নতুন করে কথা বললে ক্ষতির কিছু নেই। যে বিষয়টা নিয়ে কয়েক জন বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সেটা হল পাপ পুণ্য, ন্যায় অন্যায় আর বৈধ অবৈধ। অনেক আগে একবার এ নিয়ে লিখেছিলাম। তবে রুশীরা বলে রিপিট বা পুনরাবৃত্তি হল শিক্ষার জননী – মানে যদি কিছু শিখতে চাও তবে সেটা বার বার রিপিট কর। তাই যদি আমরা সে বিষয়গুলো আরেকবার দেখি তাতে লাভ বই ক্ষতি হবে না।

তবে মূল বিষয়ে যাবার আগে কিছু আনুসঙ্গিক কথা বলা প্রয়োজন। আজকাল আমরা প্রায়ই অভিযোগ করি যে রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে অর্থাৎ রাজনীতিও এক ধরণের ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে। আর এ জন্যে আমরা ঢালাও ভাবে রাজনীতিবিদদের লোভকে দোষ দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। মানে বলতে চাইছি আজকাল কেউ আর সমাজ সেবার জন্য, দেশের জন্য রাজনীতি করে না, রাজনীতি করে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা ফেরানোর জন্য। কিন্তু কেন এমন হল সেটা আমরা প্রায়ই বোঝার চেষ্টা করি না। কারণটা মনে হয় রাজনীতিবিদদের সমাজকে ঠিকভাবে না বোঝা অর্থাৎ সামাজিক সাইকোলজি ঠিকমত না বোঝা। ব্যবসায়ীরা কিন্তু অনেক আগেই সেটা বুঝে গেছে। এই যে আজ বাজার অর্থনীতির রমরমা অবস্থা সেটা ব্যাবসায়ীদের সামাজিক সাইকোলজি নিয়ন্ত্রণ করার ফল। তবে কোন কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে সেটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। আর ব্যবসায়ীরা আমাদের সাইকোলজি বুঝে বলেই আমরা দিন দিন ভোগবাদের ফাঁদে পা দিচ্ছি, ভোগবাদী সমাজে পরিণত হয়েছি। ব্যবসায়ের যে সামাজিক বিজ্ঞাপন সেটা অনেক বেশি কার্যকর। একই টোপ ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা শুধু সাধারণ মানুষকে নয়, রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, দল সবই কিনে ফেলছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই সামাজিক সাইকোলজি না বোঝার কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। আজ যে সর্বস্তরে রাজনীতির প্রতি অনীহা, অবিশ্বাস সেটাও রাজনীতিবিদদের সামাজিক সাইকোলজি না বোঝার ফল। ফলে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলো দখল করে নিচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে, হয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমাদের কথা বাদই দিলাম, পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র, দলগুলোর রাজনৈতিক এজেন্ডা দেখলেই সেসব জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়।

এবার আসা যাক পাপ পুণ্য ইত্যাদির কথায়। প্রতিটি সমাজের কিছু কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে। এটা এক দিনে গড়ে ওঠে না। আমার জীবনের প্রথম ১৯ বছর কেটেছে বাংলাদেশে, পরবর্তী ৪০ বছর রাশিয়ায়। আমি কোথাও তেমন যাইনি। তাই আমার চেয়ে আপনাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, তবে পড়াশুনা করে আর দেখে যেটা বুঝেছি তা হল ভারতীয় উপমাহাদেশ, রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বে  তিনটে ভিন্ন ধরণের প্যারাডাইম কাজ করে। আমাদের দেশে যদি প্রথমে চলে আসে পাপ – পুণ্য, রাশিয়ায় ন্যায় – অন্যায় আর পশ্চিমা বিশ্বে বৈধ – অবৈধ। এবং এটা মনে হয় আমাদের ডিএনের মধ্যে। আমাদের সেই ছোটবেলা থেকেই বলা হয় এটা করা পাপ বা গুনাহ। আমরা পাপকে ভয় পাই। আবার যেহেতু পাপ – পুন্যের বিচার করেন ঈশ্বর, তাই নির্দ্বিধায় ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে উপাসনালয়ে গিয়ে পাপমোচন করে পরিষ্কার মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসি। আমার মনে হয় আমাদের এই মানসিকতা অনেক দুর্নীতির কারণ। অনেকে বলতে পারেন পাপ পুণ্য তো নৈতিকতা থেকে আলাদা নয়। আমি একমত নই। যেমন ধরেন যে কাজটাকে এমনকি আপনি নিজেও অন্যায় মনে করেন সেটাকেই আবার অবলীলায় পুণ্য বলে চালিয়ে দেন। কীভাবে? ধরুন আমরা সবাই বলি জীব হত্যা অন্যায়, অন্যের জানমালের ক্ষতি করা অন্যায় ইত্যাদি। কিন্তু আবার এই আমরাই ধর্মের দোহাই দিয়ে বিধর্মীদের হত্যা বা তাদের জানমালের ক্ষতি করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ করি না। আর পাপ পুণ্য বোধ যেহেতু মূলত ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হয় তাই এটা অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বিচারে যা ন্যায় অন্যায় অথবা রাষ্ট্রীয় আইনে যা বৈধ অবৈধ তার সাথে সাংঘর্ষিক।

অন্য দিকে রাশিয়ায় মূল প্রশ্ন ন্যায় অন্যায়। পাপ – পুন্যের বিচার যদি ঈশ্বর করে, ন্যায় অন্যায়ের বিচার করে সমাজ, সামাজিক মোরাল যেটা হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে। দীর্ঘ দিন এদেশে বসবাস করে, এদেশের সাহিত্য পড়ে সেটাই বুঝেছি। রুশ দেশের প্রায় সব লেখকের লেখায় দেখবেন তাদের সহানুভূতি যায় তার প্রতি যার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। সে ধনী না গরীব, তার সামাজিক অবস্থা কেমন সেটা কোন ব্যাপার নয়। এই ন্যায় অন্যায়ের ধারণা এক দিনে গড়ে ওঠেনি। সময়ের সাথে সেটা বদলিয়েছে, তবে সেটা বদলিয়েছে সমাজের বিবর্তনের সাথে সাথে। সোভিয়েত আমলে সেসব জিনিস অন্যায় মনে করা হত, নতুন রাশিয়ায় তার অনেক কিছুই অন্যায় মনে করা হয় না। তবে নতুন ধারণা সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য হতে বেশ সময় নিয়েছে। অবশ্য এর বেশির ভাগই অর্থনীতির সাথে জড়িত, কেননা সমাজতান্ত্রিক ও বাজার অর্থনীতির অনেক ধারণার মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য বিদ্যমান আর সেখান থেকেই এসব ক্ষেত্রে ন্যায় অন্যায়ের ধারণা গড়ে উঠেছিল। তবে সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায় অন্যায়ের যে ধারণা তার বেশির ভাগই কালোত্তীর্ণ, শত শত বছরে গড়ে ওঠা। এ সব মনে হয় রুশ সমাজের গঠন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তাই এসব ক্ষেত্রে আমরা দেখি জারের রাশিয়া, সোভিয়েত আমল বা বর্তমান কালের রাজনৈতিক পটভূমি ভিন্ন হলেও ন্যায় অন্যায়ের ধারণাগুলো প্রায় অপরিবর্তনীয়। আর পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার আদর্শগত পার্থক্য এখানেই। এই পার্থক্য থেকেই বিগত প্রায় ৫০০ বছর ধরে অন্তহীন সংঘর্ষ। আজকের যে ইউক্রেন যুদ্ধ সেটার মূলেও এই সামাজিক বৈশিষ্ট্য।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১৩): চাঁদের দেশের মেয়েরা  -বিজন সাহা

অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় আইন। সেখানে আইনকে সবার উপরে স্থান দেয়া হয়। পাপ পুণ্য বা ন্যায় অন্যায় নয় – রাষ্ট্রের আইনই সামনে চলে আসে। তবে এটা মনে রাখা দরকার এই আইন প্রণয়ন করে অল্প কিছু মানুষ, সমাজের এলিট শ্রেণী। তারা এসব করে একান্তই নিজেদের স্বার্থে। সম্রাট আকবর বাংলা পঞ্জিকার প্রচলন করেছিলেন সাধারণ মানুষের ভালো মন্দ মাথায় রেখে নয়, নিজের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। আমেরিকার সংবিধান সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বললেও নারী বা আফ্রো-আমেরিকানরা ভোটাধিকার পেয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে। ইংরেজরা ভারতবর্ষে যে আইন প্রণয়ন করেছিল সেটা এ দেশের মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবে নয়, কীভাবে আরও বেশি করে এ দেশকে, এ দেশের মানুষকে শোষণ করা যায় সেটা মাথায় রেখে। এমনকি আজ তৃতীয় বিশ্ব তো দূরের কথা, এমনকি উন্নত বিশ্বের দিকেও তাকাই দেখব সমস্ত আইন করা হয় সমাজের সেই শ্রেণীর জন্য যারা কোন না কোন ভাবে ক্ষমতার সাথে জড়িত। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ রিসিভিং এন্ডে থাকে।

তার মানে এই নয় উপমহাদেশ বা রাশিয়ায় আইন নেই, রাশিয়া বা পশ্চিমা বিশ্বে পাপ পুন্যের ধারণা নেই। মূল কথা হচ্ছে যদিও প্রতিটি সমাজেই পাপ পুণ্য, ন্যায় অন্যায়, বৈধ অবৈধ এসব ধারণা আছে, কিন্তু একেক সমাজে একেক ধারণা ডমিনেট করে। যখনই কোন সমাজে এই তিন আপাত এক কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী ধারণাগুলোর কোন একটা ডমিনেট করতে শুরু করে তখনই সেই সমাজে ভারসাম্য নষ্ট হয়। যখন পরস্পরের পরিপূরক না হয়ে এই ধারণাগুলো পরস্পরের শত্রু রূপে আত্মপ্রকাশ করে তখন দেখা দেয় অরাজকতা। তাই আমরা যদি আমাদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে এসব বৈশিষ্ট্য মাথায় না রাখি তাহলে সেখানে স্থায়ী ভাবে জয়লাভ করা খুবই কঠিন। এমনকি জয়লাভ করার পরেও এসব ধারণাকে কীভাবে পরস্পর বিরোধী না করে পরস্পরের সম্পূরক করা যায় সেটা ভেবে দেখাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রসঙ্গে আরও দুটো কথা বলি। লেনিন বলেছিলেন যে “তালস্তই রুশ বিপ্লবের আয়না।” কেন? কারণ তালস্তই রুশ সমাজের তৎকালীন চিত্র এঁকেছিলেন যার মধ্যে রাজনীতি, ধর্ম, দুর্নীতি, সমাজের উপরের তলার ব্যাভিচার, নীচ তলার মানবেতর জীবন সব কিছুই স্থান পেয়েছিল। আসলে যেকোনো কালজয়ী লেখকই খুব ভালো সাইকোলজিস্ট যিনি সমাজকে খুব ভালো ভাবে পড়তে পারেন, বুঝতে পারেন, বিশ্লেষণ করতে পারেন। আর যেহেতু রাজনীতির অন্যতম প্রধান কাজ সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সামাধান করা তাই রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব হল সমাজটা বোঝা। এটা ডাক্তারদের অসুখের ডিয়াগনসিস করার মত, রোগের সঠিক ডিয়াগনসিসের উপর নির্ভর করে চিকিৎসার সাফল্য। কারণ আপনি সমস্যাটা ভালো ভাবে না বুঝলে তার সঠিক সামাধান দেবেন কিভাবে? লেনিন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সমাধান বের করেছিলেন, সত্যি বলতে কি সেই রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য সবচেয়ে সুন্দর সমাধান তিনি দিয়েছিলেন। কেন সেটা পরবর্তীতে ধরে রাখা গেল না সেটার দায়িত্ব তাঁর উত্তরসুরীদের, তাঁর নয়। তালস্তই সম্পর্কে লেনিনের বক্তব্য তাই প্রমাণ করে সামাজিক বিপ্লব সফল করার জন্য সমাজটাকে বোঝা এবং সেটা বুঝে তত্ত্বের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার কতটা জরুরি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো