বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১২): বেদে সব আছে

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত ২৩ আগস্ট ২০২৩ ভারত পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রায়ন-৩ পাঠিয়েছে, এটা শুধু ভারতের নয়, মানুষের জয়, সারা বিশ্বের বিজ্ঞানের জয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীনের পর চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত সফল ভাবে চন্দ্র অভিযান সম্পন্ন করল – অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক দেশই এই কাফেলায় যোগ দেবে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য ভারতবাসীকে অভিনন্দন! অভিনন্দন ভারতীয় বন্ধুদের। জয় হোক বিজ্ঞানের, জয় হোক মানুষের! হ্যাঁ, বিজ্ঞানের প্রতিটি জয়ই মানব সভ্যতার জয়, মানুষের আত্মবিশ্বাসের জন্য। বিজ্ঞান হল মানুষের বুদ্ধিমত্তা, মানুষের শক্তিকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

ভারতের সফল চন্দ্র অভিযানে যে কয়েকটি ব্যাপার দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেগুলো হল তুলনামূলক কম খরচে ভারতের এই সফল অভিযান, প্রচুর সংখ্যক নারীর সেখানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন (ইসরো) প্রধান এস সোমনাথের বেদ নিয়ে কিছু কথা।

ইসরো প্রধান, যার নেতৃত্বে বলেছেন যে চন্দ্রায়ন – ৩ চাঁদে পৌছুলো, বলেছেন যে সব কিছু বেদে লেখা আছে। তবে তিনি মেঘনাধ সাহার মত ব্যঙ্গ করে কথাটা বলেননি। এর মধ্য দিয়ে উনি আসলে কি বুঝিয়েছেন সেটা তাঁর ব্যাপার। যেহেতু সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে তাই আমি একটু অন্য দিক থেকে সেটা দেখার চেষ্টা করছি। মনে রাখতে হবে যে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, বিশেষ করে কোরআন যদি ঈশ্বর প্রদত্ত হয়, সেখানে বেদ মানুষের লেখা। মানে সেখানে যা কিছু আছে সেটা মানুষের লব্ধ জ্ঞান। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি বেদকে রুশ ভাষায় বলে ভেদা যার উৎপত্তি ভেদাত শব্দ থেকে। এর অর্থ জানা বা জ্ঞান। এখানে বেদকে তাই সেই সময়ের মানুষের অর্জিত জ্ঞানের ভাণ্ডার বলে মনে করা হয়। আমার ধারণা যদি বেদে ধর্মীয় মলাট না থাকত বা এর কোন একক লেখক থাকত তবে বেদকে আমরা প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের রচনা যেভাবে দেখি সেভাবেই দেখতে পারতাম। একই কথা বলা চলে ইলিয়াড, অডিসি আর রামায়ণ, মহাভারতের ক্ষেত্রেও। স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছিলেন “আমি অনেক দূর দেখি কারণ আমি দৈত্যদের কাঁধে বসে আছি।” একশ বা পাঁচ শ বছর নয়, হাজার হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতা প্রতিনিয়ত যে জ্ঞান অর্জন করেছে সেটাকে পুঁজি করেই আমরা বর্তমানে এসেছি, আজকে আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সাফল্য তার পেছনে আছে মানব সভ্যতার শুরু থেকে তিলে তিলে অর্জিত সব অভিজ্ঞতা, সব জ্ঞান। তাই অতীত থেকে কোন কিছুই বাদ দিলে চলবে না। সে অর্থে আমরা আমাদের বর্তমানের জন্য সমস্ত গ্রন্থের কাছেই দায়বদ্ধ যেখানে কোন না কোন ভাবে জ্ঞানের কথা বলা আছে, যেখানে মানুষ তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। এক দিনে নিউটন বা আইনস্টাইনের তত্ত্ব সৃষ্টি হয়নি। মানব সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ একটু একটু করে এই জায়গায় এসেছে। বেদ মানুষের লেখা। সেই সময়ের জ্ঞানী মানুষদের চিন্তা ভাবনার সমাবেশ।‌ সে অর্থে বেদ জ্ঞানার্জনের পথে একটা  মাইলস্টোন। যদি বিষয়টা এইভাবে দেখি তাহলে আমি এস সোমনাথের কথার মধ্যে কোন কন্ট্রাডিকশন দেখি না কারণ আজকের আমি অতীতের আমির প্রতিফলন, আজকের আমরা এটা আমাদের অতীতের দীর্ঘ সাধনার ফসল। আজকে আমাদের যা কিছু আছে তার জন্য আমরা অতীতের কাছে দায়বদ্ধ।  জুল ভার্ন পড়ে যদি রাইট ভ্রাতৃদ্বয় বিমান আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকেন এতে কি সমস্যা আছে? রবার্ট ওপেনহাইমার গীতা নিয়ে কথা বললে আমরা সেটা গুরুত্ব দেই কিন্তু নিজেদের কেউ বললে ট্রল করি।

তাছাড়া এর অন্য একটা দিকও থাকতে পারে। যেকোনো কাজের শুরুতে আমরা রিল্যাক্স করার কথা বলি। রিল্যাক্স মানে মনকে শান্ত করা। কেউ মনকে শান্ত করতে রবীন্দ্রনাথ পড়ে, কেউ মিউজিক শোনে। কেউ যদি গীতা বা বেদ বা কোরআন বা বাইবেল পড়ে তাতে সমস্যা কোথায়? অনেকেই বাসা থেকে বেরুনোর আগে সুরা বা মন্ত্র পড়ে। এটা যদি তাকে মানসিক শক্তি দেয়, স্বস্তি দেয় তাতে সমস্যা কি? অর্থাৎ আমরা যদি সবকিছুকে একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখি তাহলে অনেক কিছুই অনেক সহজ হয়ে যায়। আসলে প্রতিটি মানুষের কিছু গ্লোবাল এইম থাকে, থাকে লক্ষ্য। সেটা অর্জনের জন্য সে বিভিন্ন ভাবেই নিজেকে তৈরি করতে পারে যার অনেক কিছুই আপাত দৃষ্টিতে মূল কাজের সাথে সম্পর্কিত নয়। যেমন ছবি তোলার সাথে আমার রিসার্চের সরাসরি সম্পর্ক নেই, যেমন আইনস্টাইনের তত্ত্বের সাথে বেহালার সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। প্রায় প্রতিটি মানুষের কোন না কোন হবি থাকে যেটা তাকে মূল কাজ করতে পরোক্ষ ভাবে সহায়তা করে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১৩): চাঁদের দেশের মেয়েরা  -বিজন সাহা

ইসরোর প্রধান যাই বলুন না কেন তাতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁকে খাঁটো করা ঠিক নয়। অন্তত এক্ষেত্রে আমি তাঁর কথার চেয়ে কাজকেই বেশি গুরুত্ব দেবার পক্ষপাতী। নোবেলজয়ী প্রফেসর আব্দুস সালাম ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন, কোরআনকে সম্মান দিতেন। এতে কি পদার্থবিদ হিসেবে তিনি ছোট হয়ে গেছেন। এরা কেউই না বেদ, না কোরআনে পদার্থবিদ্যার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন, এরা এসব গ্রন্থে বিশ্বাস রেখেও প্রথম সারির বিজ্ঞানী। বরং আমরা যারা বিজ্ঞানে তেমন কিছু করতে পারিনি তারা তাঁদের এসব নিয়ে ট্রল করে নিজেদের অবিজ্ঞান সুলভ মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছি। বিজ্ঞান পরমতসহিষ্ণু, সে যুক্তি দিয়ে সব কিছু গ্রহণ করে কিন্তু অন্যের মত শুনতে দ্বিধা করে না। আমরা তো আমাদের আজকের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করেই নতুন বিশ্বাস বা তত্ত্বে উপনীত হই। এই যে আমরা আজ যারা আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছি তারা যদি আইনস্টাইনকে শেষ সত্য বলে মনে করতাম, তাহলে কি গবেষণা করতে পারতাম?

আমাদের অনেকেই মনে করে যে বিজ্ঞানীরা যেটা বলে সেটাই একমাত্র সত্য। আর বিজ্ঞানীদের নির্দেশিত পথে চলা মানেই বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া। বিজ্ঞানীরা কিন্তু সেভাবে ভাবে না। প্রতিটি  ক্রিকেটার যেমন জানে যে তার রেকর্ডটা আজ হোক কাল হোক ভাঙবেই সেটা শুধু সময়ের ব্যাপার, কারও রেকর্ড দীর্ঘস্থায়ী হবে, কারও রেকর্ড স্বল্পস্থায়ী, প্রতিটি বিজ্ঞানীও তেমনি জানেন যে তার তত্ত্ব সাময়িক, শুধু তাই নয় তিনি নিজেই নিজের তত্ত্ব আরও সঠিক করার জন্য অনবরত কাজ করে যান। এটাই মনে হয় ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের মূল পার্থক্য। ধর্ম শাস্ত্রে যা লেখা আছে সেটাকে আঁকড়ে থাকে, সেটাই একমাত্র সত্য বলে বিশ্বাস করে, বিজ্ঞান প্রত্যেকটা নতুন আবিষ্কারের পরে সেটার উৎকর্ষ সাধন করার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ, যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত নয় অর্থাৎ যারা সরাসরি গবেষণা করে না তারা এগুলো মিস করে এবং বিজ্ঞানের বা কোন বিজ্ঞানীর যেকোনো ব্যাখ্যাকেই সঠিক বলে মনে করে। অনেকে আবার মনে করে বিজ্ঞানী মাত্রই অবিশ্বাসী, সন্দেহপ্রবন। বাস্তবে কিন্তু তা নয়।  বিজ্ঞান সবকিছু গ্রহণ করার আগে যাচাই-বাছাই করে, যাকে বলে “বিশ্বাস করার বা গ্রহণ করার আগে সেটা যাচাই করে নেয়।” আমাদের মনে রাখা দরকার যে বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বিবর্তন ইত্যাদি অনেক ব্যাপারে একাধিক তত্ত্ব আছে এবং সবগুলোর পক্ষেই বিভিন্ন ধরণের যুক্তি আছে, বিশেষ করে ডার্ক এনার্জির ব্যাপারে। এবং এদের প্রতিটিরই সঠিক হবার সম্ভাবনা আছে। তবে এটা ঠিক যে সবার সঠিক হবার সম্ভাবনা থাকার পরেও সঠিক হবে একটাই। এটা অনেকটা একটা বিন্দু থেকে আরেকটা বিন্দুতে যাওয়ার অসংখ্য পথের মত – সম্ভাব্য পথ অনেক কিন্তু যায় কোন একটা নির্দিষ্ট পথে। তবে সব সময় সব সম্ভাবনাগুলোকে বিচারের মধ্যে নিয়েই কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে হয়।

 

আমাদের অনেকের ধারণা বিজ্ঞান মানেই মঙ্গলময়, বিজ্ঞান মানেই কল্যাণকর। আসলে বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সত্যের সন্ধান করা। মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করা। তার আবিষ্কার মঙ্গলময় হবে নাকি ক্ষতিকর হবে সেটা বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্র অথবা সেই সব মানুষের উপর যারা বিজ্ঞানের আবিষ্কার ব্যবহার করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পারমাণবিক বোমার কথা। একই ভাবে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষকে যেমন সুশিক্ষিত করা যায় আবার এই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখা যায়, যেমন করে ওয়াজিরা। বিজ্ঞান আসলে একটা পদ্ধতি। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কেনই বা জন্ম? কে, কি, কেন – অনবরত এসব প্রশ্ন করে কোন কিছুকে জানার ও বোঝার অন্তহীন প্রক্রিয়াই বিজ্ঞান। বাকীটা জীবনের নিরস গদ্য।

তাই এস সোমনাথ বেদ নিয়ে কি বললেন তারচেয়েও বড় কথা তিনি কি করলেন। এর মধ্য ফেসবুকের কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর একটা লেকচার শুনলাম। তাতে মনে হল বেদ সম্পর্কে তাঁর এই উক্তি আসলে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ট্রেন্ডকে মাথায় রেখে একটা কূটনৈতিক চাল মাত্র। কারণ ক্ষমতাসীনরা অর্থ অনুমোদন না করলে বিজ্ঞান গবেষণা খুব বেশি দূর যেতে পারে না।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো