বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১৩): চাঁদের দেশের মেয়েরা  

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত সপ্তাহে আমরা চন্দ্রায়ন-৩ এর চন্দ্রে অবতরণ নিয়ে লিখেছিলাম। বলেছিলাম এ নিয়ে সে সময় সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু বিষয় সামনে চলে আসে। তবে গত সপ্তাহে আমরা ইসরো প্রধান এস সোমনাথের একটি বক্তব্যের মধ্যেই মূলত আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম। আজ আমরা বাকী বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলব। কী ছিল বাকী বিষয়গুলো? তুলনামূলক কম খরচে ভারতের এই সফল অভিযান এবং প্রচুর সংখ্যক নারীর সেখানে সক্রিয় অংশগ্রহণ, কেউ কেউ আবার হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিনিধিত্বকারী নরেন্দ্র মোদি কতটুকু বিজ্ঞানের পক্ষের মানুষ সে প্রশ্ন তুলেছে, আবার ভারতেরই কোন কোন রাজনৈতিক নেতা এই বিজয়কে খাটো করার জন্য রাকেশ রোহণের কথা বলেছেন, যদিও সেটা হবে রাকেশ শর্মা। উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাকেশ শর্মা ১৯৮৪ সালে ০৩ এপ্রিল সোভিয়েত নভোযানে প্রথম ভারতীয় হিসেবে মহাশূন্যে যান এবং সাত দিনের জন্য কসমিক স্টেশন সাল্যুত-৭ এ অবস্থান করেন। তখন আমি মস্কো ছিলাম। পরে ওনাকে প্যাট্রিস লুমুম্বা গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। অনেকের সাথে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। যেকোনো কাজ, বিশেষ করে চন্দ্রে অভিযানের মত বড় কাজ কোন একক কৃতিত্ব নয়, এর পেছনে থাকে হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘ দিনের অবিরাম পরিশ্রম। তাই এর সাফল্য শুধু দেশের নেতাদের সাফল্য নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এক বিশাল কমিউনিটির বিজয়। সমগ্র দেশের মানুষের বিজয়। আমি তো বলব এটা বিশ্ব মানবের জয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞান দেশের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না, এ ধরণের অভিযানের ফলাফল সারা বিশ্বের জন্যই নতুন জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে দেয়। তাই যে সমস্ত রাজনীতিবিদ এই সাফল্যকে ছোট করতে চায় তারা আসলে দেশকে, দেশের জনগণকেই ছোট করে, নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারে।

চন্দ্রায়ন-৩ চাঁদে অবতরণের মাত্র কয়েকদিন আগে রুশ নভোযান লুনা-২৫ চাঁদের ঠিক একই এলাকায় নামার ব্যর্থ  চেষ্টা করে। এটা ছিল সভিয়েতোত্তর রাশিয়ার প্রথম চন্দ্র অভিযান। এটা এক ধরণের বাড়তি চাপের সৃষ্টি করে। তবে শেষ মুহূর্তে মিশন ব্যর্থ হলেও এ নিয়ে এখানে অবশ্য খুব বেশি একটা কথাবার্তা হয়নি। কারণটা মনে হয় দেশ যেহেতু যুদ্ধে জড়িত তাই এই ব্যর্থতা নিয়ে কথা বললে পাছে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয় সেজন্যেই এটাকে ততটা সামনে আনা হয়নি, যদিও তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে, প্রাথমিক ফলাফল পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে, হচ্ছে। কারণ ব্যর্থতা ব্যর্থতাই। আর সব ব্যর্থতাই এক ধরণের অস্বস্তি তৈরি করে। তবে এখানে দুটো জিনিস আমি বলতে চাই – পশ্চিমা বিশ্বের স্যাঙ্কশনের পরেও এ রকম একটা বড় প্রজেক্ট চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। শুধু তাই নয়, এই ব্যর্থতার পরেও তারা আগামী কয়েক বছরে আরও তিনটি মিশন চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা অপরিবর্তিত রেখেছে। যদি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধের অজুহাতে বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক কর্মসূচী গুঁটিয়ে আনছে রাশিয়া সেক্ষেত্রে এসব উল্টো সম্প্রসারিত করছে। তাই এই সময়ে চাঁদে মিশন পাঠানো, ব্যর্থতার পরেও সেটা চালিয়ে যাওয়া এটা তাদের দীর্ঘস্থায়ী পলিসির কথাই বলে।

ফেসবুকে দেখলাম ভারতের গুজরাটে ইদানীং স্থাপিত ঐক্য মূর্তির পেছনে এই চন্দ্র বিজয়ের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। দেশের কৃতি সন্তানদের সম্মান দেওয়া অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেই অর্থ যদি এসব কৃতি সন্তানদের নামে উৎসর্গীকৃত কোন বিজ্ঞান প্রজেক্টে ব্যয় করা হত তাতে মনে হয় দেশ, দেশের মানুষ আরও বেশি লাভবান হত, আর এসব মানুষের কীর্তি আরও উজ্জ্বল হত। এটা অবশ্য আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত এবং যেকোনো দেশের জন্যই প্রযোজ্য। চন্দ্রায়ন-৩ দীর্ঘ সময় নিয়ে এই অভিযান সম্পন্ন করেছে, কারণ এক্ষেত্রে গ্র্যাভিটি আসিস্ট বলে একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্ধতি খরচ কমাতে সাহায্য করেছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু হয়। এই পদ্ধতি সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৫৯ সালে যখন সোভিয়েত মহাকাশযান লুনা-৩ চন্দ্রের দূরবর্তী পৃষ্ঠের ছবি তোলে। পরে মেরিনার-১০ এবং ভয়েজার-১  ও ভয়েজার-২ এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে নভোযানের গতি বাড়ানো বা কমানোর জন্য অথবা কক্ষপথ পরিবর্তনের জন্য সূর্য বা গ্রহের মহাকর্ষ বল ব্যবহার করা হয়। মহাকর্ষ বল সম্পন্ন বস্তু যেহেতু মহাকাশযানকে আকর্ষণ করে তাই সে নিজের গতির দ্বারা নভোযানকে গ্র্যাভিটি আসিস্ট বা মহাকর্ষ সহায়তা প্রদান করতে পারে। মহাকাশযান কোন মহাকর্ষ বল সম্পন্ন বস্তুর পাশ দিয়ে যাবার সময় যে গতি শক্তি বা রৈখিক ভরবেগ অর্জন করে বা হারায় নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী সেই পরিমাণ গতিশক্তি বা ভরবেগ মহাকর্ষ সম্পন্ন বস্তু হারায় বা লাভ করে। এই শক্তিকে ব্যবহার করে মহাকাশযানের জ্বালানি সাশ্রয় করা যায়। এটা অনেকটা ব্যাটের হালকা ছোঁয়ায় দ্রুত গতির বলের গতি বাড়ানো বা কমানো অথবা এর গতিপথ পরিবর্তন করার মত। এ ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যান নিজের শক্তি রক্ষা করে। গ্র্যাভিটি আসিস্ট পদ্ধতি ব্যবহার না করে নভোযানের নিজস্ব জ্বালানি শক্তি ব্যবহার করেও মাহাকাশযানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটাকে আমরা স্ট্রেইট ড্রাইভের সাথে তুলনা করতে পারি। তবে এটা শুধুই উদাহরণ। আসল ঘটনা আরও জটিল।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১২): বেদে সব আছে - বিজন সাহা

এবার আসি মেয়েদের অংশগ্রহণের কথায়। চন্দ্রায়ন-৩ এর সফল মিশনের পর নাম শোনা গেছে সাজি নিগারের। কৃষক পরিবার থেকে বেড়িয়ে আসা এই মহিলা ভারতের সূর্য অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিছুদিন আগে একটা বইয়ে মেয়েদের উপর দেশ ভাগের প্রভাব নিয়ে পড়েছিলাম। এই মুহূর্তে যেটুকু মনে করতে পারছি সেটা ছিল কোন স্বনামধন্য কবি বা সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার। তবে তাঁর নাম বা সাক্ষাৎকার গ্রহনকারীর নাম মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভব ফেসবুকেই সেটা দেখেছিলাম। তার মূল কথা হল যে দেশভাগের পর মুহূর্তে পূর্ব বাংলা থেকে আসা মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়েছিল আর এই কাজে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও হাত লাগিয়েছিল। এটা স্থানীয় মেয়েদেরও বাধ্য করেছিল ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে, কাজে নামতে। অর্থাৎ দেশ ভাগের আগে যদি মেয়েরা কমবেশি অন্দর মহলের বাসিন্দা ছিল, নতুন ভারতে মেয়েরা ছেলেদের পাশাপাশি কাজ করতে শুরু করে। আজ যে তারা চন্দ্র বিজয়ে বিশাল ভূমিকা রাখছে সেটার বীজ সেই সময়ই বপন করা হয়েছিল। তবে সেটা কোন মতেই দেশ ভাগের ফল নয়, সদ্য স্বাধীন দেশের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা। আমাদের দেশ যে পিছিয়ে ছিল তা নয়। স্বাধীনতা পূর্ব বা স্বাধীনতা উত্তর বাঙালি মেয়েদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে পড়াশুনা করলে, তাদের ছবি দেখলে সেটা বোঝা যায়। এখনও যে তারা পিছিয়ে আছে তা নয়। তারাও সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দেশের ট্রেন্ড এখন উল্টোমুখী, মেয়েকে ঘরে বন্দী করার পক্ষে এখন কাজ চলছে। আমরা যদি আমাদের মেয়েদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রনী ভুমিকায় দেখতে চাই সবার আগে দরকার সামাজিক সাইকোলজি বদল করা। আমাদের দেশে কী ছেলে, কী মেয়ে – মেধার অভাব নেই, অভাব আছে সেটা নারসিং করার, পরবর্তীতে তাদের মেধার উপযুক্ত ব্যবহারের। আমাদের দেশে মডেল মসজিদ, পূজা ইত্যাদির পেছনে যে পরিমাণ সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয় তার কিছুটাও যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পেছনে খরচ করা হত তাহলে দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা ইউরোপ আমেরিকায় যেত না ভাগ্যের সন্ধানে। এটা ঠিক যে আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, তবে ভোটের জন্য ধর্মের পেছনে অর্থ না ঢেলে দেশের সত্যিকারের উন্নতির জন্য, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানের পেছনে অর্থ ব্যয় করাই আধুনিকতা, দেশপ্রেম।

আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। চন্দ্রায়ন-৩ এর সফল ভাবে চাঁদে অবতরণের পরে ভারতের মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডায় মানুষ প্রার্থনা করেছে বলে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ব্যাপারখানা এই তোমরা যেহেতু বিজ্ঞানে বিশ্বাস কর না তোমাদের এ নিয়ে এত লাফালাফির কী আছে? কিন্তু যদি কেউ ঢাকঢোল বাজিয়ে বা উপাসনালয়ে উপাসনা করে চন্দ্রায়নকে স্বাগত জানায় তাতে আমি কোন সমস্যা দেখি না। সমস্যা হত যদি উপাসনালয় থেকে বেরিয়ে তারা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে মিছিল করত যেমন হয়েছিল মধ্যযুগীয় ইউরোপে। তখন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে নাকি সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে এই প্রশ্ন অনেককেই এমনকি জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। আজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতবাদ প্রমোট করে। আমরা কেন আমাদের উৎসবে তাদের ডাকব না,  এই সুযোগে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানের মাহাত্ম্য প্রচার করব না?

অনেকেই বলার চেষ্টা করেছে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিনিধিত্বকারী নরেন্দ্র মোদি কি বিজ্ঞানের পক্ষের মানুষ হতে পারেন? সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রেণী তত্ত্বের সাথে যায় না বলে জেনেটিক্স নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ভারত যদি ধর্ম কর্ম করার পরেও বিজ্ঞান প্রযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ করে সেটা তো ভালো বলেই আমার মনে হয়। সোভিয়েত আমলে মনে হত বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত। এখন মনে হয় বিশ্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি দ্বিধা বিভক্ত। অথচ পৃথিবী মাত্র একটাই। তাছাড়া আমরা সবাই বিভিন্ন ভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাই সবাইকে সবার জন্য স্পেস করে দিতে হবে আর সেটা মাথায় রেখেই সমাধান খুঁজতে হবে। মনে রাখবেন এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকটিও সবচেয়ে গরীব লোকটির উপর নির্ভরশীল। যদি সবাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তাহলে আর আদান প্রদান থাকবে না, স্রোত থাকবে না। আর যখন স্রোত না থাকে নদী তখন ডোবায় পরিণত হয়, মরে যায়। তাই স্বনির্ভরতার পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতাও সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যতের অন্যতম চাবিকাঠি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো